সবরমতী নদীর তীরে গান্ধীজির ‘সবরমতী আশ্রম’
মৃণালিনী ঠাকুর
ইতিহাস আহমেদাবাদ শহরের পরতে পরতে, আর তার মধ্যমণি নিঃসন্দেহে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস সংগ্রামের কেন্দ্রস্থল বিশ্বখ্যাত ‘সবরমতী আশ্রম’! এক সকালে পৌঁছে গেলাম এই কেন্দ্রে, উদ্দেশ্য গান্ধীজির কর্মকাণ্ডের এক ঝলক স্বচক্ষে অবলোকন ! তোমরা সকলেই জানো, গত ২রা অক্টোবর ছিল জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন। পুরো নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার কথা আমরা সকলেই জানি। আজ বলব গান্ধীজি প্রতিষ্ঠিত সবরমতী আশ্রমের কথা। ১৯১৭ সালে স্থাপিত এই আশ্রমের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে। গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরের কাছে সবরমতী নদীর তীরে অবস্থিত এই আশ্রমটি গান্ধীজির শান্তি, অহিংসা এবং সত্যাগ্রহের মূলনীতি প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকায় দীর্ঘ সময় কাটিয়ে ভারতে ফিরে আসার পর সবরমতী আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন গান্ধীজি। তিনি এমন একটি জায়গা খুঁজছিলেন, যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে পারেন এবং অহিংস আন্দোলনের জন্য লোকজনকে সংগঠিত করতে পারেন। এখানে তিনি চাষবাস, তাঁত বোনা, ও চরকা চালানোর মতো স্বনির্ভরতার বিভিন্ন কাজও শুরু করেন। ১৯২০ সালে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং এখান থেকেই গান্ধীজি সাধারণ মানুষকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিবাদে অংশ নিতে আহ্বান জানান। অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে গান্ধীজি ভারতীয়দের ব্রিটিশ পণ্য বর্জন এবং স্বদেশী পণ্য ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেন।
সবরমতী আশ্রমের আরেকটি বড় ঐতিহাসিক গুরুত্ব হলো ১৯৩০ সালের ডান্ডি অভিযান। ১৯৩০ সালের ১২ই মার্চ গান্ধীজি এই আশ্রম থেকে প্রায় ৭৮ জন অনুসারীকে নিয়ে ব্রিটিশদের লবণ আইন ভাঙার উদ্দেশ্যে ২৪০ মাইল দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করেন। একেই বলে ডান্ডি অভিযান। এই অভিযানের ফলে পুরো ভারত জুড়ে স্বাধীনতার দাবিতে এক নতুন চেতনার সঞ্চার হয়। আশ্রমে বসবাসকারীরা গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বনির্ভরতার শিক্ষা গ্রহণ করেন। এই আশ্রমের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের অন্যতম ছিল চরকা কেটে সুতো তৈরি। চরকা হলো তুলো থেকে সুতো তৈরির হস্তচালিত একরকম যন্ত্র। এছাড়াও চাষাবাদ, বস্ত্র তৈরির কাজ এবং অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো এখানে। গান্ধীজি বিশ্বাস করতেন যে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিকে আত্মনির্ভর হতে হবে, এবং এই শিক্ষাই তিনি আশ্রমে প্রচার করতেন।
বর্তমানে সবরমতী আশ্রম একটি সংগ্রহশালা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে মহাত্মা গান্ধীর জীবন, কর্ম, এবং সংগ্রামের বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। এখানে গান্ধীজির ব্যবহৃত ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, তাঁর চিঠিপত্র ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাগুলির ফটোগ্রাফ সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেইসব দেখতে দেখতেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। শান্ত, স্নিগ্ধ পরিবেশ। প্রাচীন বিশাল বিশাল গাছের ছায়ায় ঢাকা পুরো চত্বর। সবুজ ঘাসের গালিচায় ঢাকা আশ্রমের বেশিরভাগ অংশ। ঘাস ছাড়া উন্মুক্ত কিছু অংশও রয়েছে। বেশ কয়েকজন কর্মী সারাদিন ধরে পরিষ্কার করছে সর্বত্র। ফলে, চূড়ান্ত পরিচ্ছন্নতা বিরাজমান। নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাখপাখালি আর কাঠবিড়ালির দল। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে বিশাল চওড়া সবরমতী নদী। নদীর নামেই আশ্রমের নামকরণ। বলা বাহুল্য আশ্রমটি এখন এই শহর তথা গোটা গুজরাতের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। আমাদের সঙ্গেই এদিন অজস্র দর্শনার্থী পর্যটক ছিলেন। সকলেই সুশৃঙ্খলভাবে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন সব। একবার তোমরাও পারলে ঘুরে যেও অবশ্যই।
***ছবি ঋণ ইন্টারনেট
পাঠকদের মন্তব্য
250