ছোটোদের চাঁদের হাসি / জেনে নিতে মানা নেই / নভেম্বর ২০২৪

চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন ও তাঁর নোবেল প্রাপ্তি

 

(১৮৮৮-১৯৭০)

নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সুদীর্ঘ ১২৪ বছরের ইতিহাসে কেবলমাত্র একজন ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। আমজনতার দরবারে তিনি সি ভি রমন নামে পরিচিত হলেও পিতৃদত্ত নাম চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন। জন্ম ১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর। দক্ষিণ ভারতের সেকালের ত্রিচিনোপল্লির কাছে অবস্থিত ছোট্ট গ্রামে যে টালির চালের বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, সেই ঐতিহাসিক বাড়িটি বর্তমানে মাটিতে মিশে গেলেও, তার একটি মাত্র ছবি ধরা আছে বেঙ্গালুরুর রমন ইন্সটিটিউটে। তাঁর পিতা রমানাথন চন্দ্রশেখর  আইয়ার ছিলেন কলেজের অধ্যাপক, অসীম জ্ঞানপিপাসু ও স্বাস্থ্যচর্চায় প্রবল উৎসাহী। মাতা পার্বতী আম্লান ছিলেন গৃহবধূ।

 

শৈশবেই দেখা গেল রমন অত্যন্ত মেধাবী। তিনি যে কেবলমাত্র বিরল মেধার অধিকারী ছিলেন, তা নয়, প্রবল জাত্যাভিমানীও ছিলেন। আজীবন মাথায় দক্ষিণ ভারতীয় পাগড়ি ব্যবহার করেছেন। পরবর্তীকালে দেশ-বিদেশ ঘুরেছেন, সাহেবদের সাথে ওঠাবসা করেছেন। কিন্তু মাথার পাগড়ি কখনো স্থানচ্যুত হয়নি। রমন মাত্র ১৩ বছর বয়সে স্কলারশিপসহ মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। অল্প কদিনের মধ্যেই অধ্যাপকেরা বুঝতে পারলেন, ছেলেটি কি অকল্পনীয় মেধার অধিকারী। কলেজের বিএ পরীক্ষায় যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করবেন, তা নিয়ে কারোর সন্দেহ ছিল না। বলার বিষয়, তিনি একাই কলেজের সব পুরস্কারের দখল নেন।

 

সেকালে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা ইংল্যান্ডে আইসিএস পরীক্ষা দিতে যেত। ফলে পিতা-মাতা ও অধ্যাপকদের উৎসাহে রমনও এই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেবার জন্য ইংল্যান্ড যাবার প্রস্তুতি শুরু করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য (?), এক স্থানীয় সিভিল সার্জেনের কাছে মেডিকেল পরীক্ষায় তিনি অনুত্তীর্ণ হন। সারা জীবনে এই একটি পরীক্ষায় তিনি পাশ করতে পারেননি। এতে অবশ্য শাপে বর হলো। রমন পরে ঠাট্টার ছলে বলেছেন, এই ব্যক্তিটির কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। বিলেত যখন যাওয়াই হলো না, অগত্যা তিনি প্রেসিডেন্সিতেই ভর্তি হলেন এমএ ক্লাসে। বিষয় হিসেবে বেছে নিলেন পদার্থ বিজ্ঞান। অধ্যাপকেরা তাঁর মেধার পরিচয় আগেই পেয়েছিলেন। তাই বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক জোন্স তাঁকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন ক্লাসে যোগ দেবার বিষয়ে। রমন নিজেই স্বীকার করেছেন, আমি দুবছরে মাত্র একদিন ক্লাস করেছিলাম। তাহলে তিনি কি করতেন? ক্লাসে যাবার বদলে যেতেন লাইব্রেরীতে বসে বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের লেখা বই নিয়ে পড়তেন। নির্দিষ্ট সিলেবাসের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে গোগ্রাসে জ্ঞান সংগ্রহ করতেন।

 

 

তখন তাঁর কতই বা বয়স–মাত্র ষোলো । ওই বয়সেই তিনি বিশ্ববিখ্যাত ‘দ্য ফিলসফিক্যাল ম্যাগাজিন’-এ গবেষণাপত্র লিখে সবাইকে চমকে দেন। প্রেসিডেন্সির ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম। যেখানে পেপার ছাপা হলে নামী বিজ্ঞানীরাও শ্লাঘা অনুভব করেন, সেখানে লিখছেন কিশোর রমন, একক চেষ্টায়, অধ্যাপকের সাহায্য ছাড়াই। কিছুদিন পরে লর্ড কেলভিনের বালটিমোর বক্তৃতায় অনুপ্রাণিত হয়ে তরলের ‘সারফেস টেনসন’ বিষয়ে আরো একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ১৯০৭ সালে তিনি যথারীতি এমএ পরীক্ষাতেও প্রথম স্থান অর্জন করেন। সেই সঙ্গে জিতে নেন জাতীয় পুরস্কার।

 

১৯০৭-১৭–এই এগারো বছর রমেনকে মনোযোগ দিতে হয়েছে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী কাজে। চাকরি সূত্রে তিনি সারাদিন ব্যস্ত থেকেছেন সরকারি হিসাবপত্র নিয়ে। আর ভোর ৫টা থেকে বেলা ৯.৩০ পর্যন্ত এবং বিকেল ৫টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ত থেকেছেন পদার্থবিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে। রমনের প্রথম কালের গবেষণার বিষয় ছিল শব্দ বিজ্ঞান, বিশেষত বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে। লর্ড র‍্যালের বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক গবেষণার উপর ভিত্তি করে রমন প্রথমে ‘একতারা’ নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেন। কিছুদিন পরে হেল্পহোল্জ্-এর গবেষণাপত্র পড়ে বিদেশি বাদ্যযন্ত্র ভায়োলিন নিয়ে গবেষণায় আগ্রহী হন। পরে রমন তম্বুরা, বীনা, মৃদঙ্গম, তবলা ইত্যাদি নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। এজন্য রমন আমেরিকার ক্যাটগাট অ্যাকস্টিক্যাল সোসাইটির সম্মানিক সদস্যপদ লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞানে অসামান্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী রমনের কাছে অর্থ-বিলাস সবই ছিল তুচ্ছ। অধ্যাপনা ও গবেষণাই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য।

 

১৯১৭ সালে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেবার পর, তাঁর  জীবনধারা আবার নতুন খাতে বইতে শুরু করে। তিনি হিসাবশাস্ত্র ছেড়ে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেন গবেষণায়। কেবলমাত্র তাঁর আকর্ষণে ACS-এ গবেষণা করতে আসেন ভারতের শ্রেষ্ঠ মেধাসম্পন্ন তরুণেরা। রমন গবেষণাপত্র লেখার সুবাদে বিশ্বের বিজ্ঞানীদের কাছে সুপরিচিত হলেও, তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রী ছিল না। তাই ১৯২১ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিগ্রী প্রদান করে। ওই বছরই তিনি প্রথম সাগর পাড়ি দিয়ে লন্ডন যান। এরপর থেকেই তিনি ঘন ঘন বিদেশ থেকে বক্তৃতা দেবার আমন্ত্রণ পেতে থাকেন।  এর অন্যতম কারণ তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতা।

 

১৯২৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। ওইদিনই তিনি ও কৃষ্ণান নিশ্চিতভাবে আবিষ্কার করেন আলোকরশ্মি কোন কণায় ধাক্কা খেয়ে ভিন্ন তরঙ্গের বিকিরণ সৃষ্টি করে, যা পরে ‘রমন এফেক্ট’ নামে বিশ্ব-পরিচিতি লাভ করে । রমন ওইদিনই বুঝে যান তিনি এই কাজের জন্য নোবেল পুরস্কার পাবেনই। প্রায় একই সময়ে একই কাজ করছিলেন রাশিয়ার দুই বিজ্ঞানী।

 

১৯৩০ সালে সমুদ্র তরঙ্গের মত আছড়ে পড়তে লাগল সুইডিশ নোবেল কমিটির কাছে রমনের নাম। মোট দশজন বিজ্ঞানী রমেনের নাম প্রস্তাব করেন। এঁরা সবাই বিশ্বখ্যাত। নোবেল কমিটির নিয়ম অনুযায়ী কোনো বিশেষজ্ঞ নমিনির গবেষণা নিয়ে সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট পেশ করবেন। রমনের এই আবিষ্কার নিয়ে রিপোর্ট পেশ করেন ফিজিক্যাল ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর, স্টকহোলম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নোবেল কমিটির সদস্য এরিক হাল্ডেন। রিপোর্টের শিরোনাম, ‘The Complete Explanation of the Raman Effect (মূল লেখা সুইডিশ ভাষায়)’। উল্লেখ্য ওই বছর ৩৯ জন স্বীকৃত প্রস্তাবকের মধ্যে ২১ জন বিজ্ঞানীর নাম প্রস্তাব করেন। এঁদের মধ্যে দশজনই রমনের পক্ষে প্রস্তাব দেন।

 

বাকি কাহিনি ইতিহাস। প্রায় সবারই জানা। কিন্তু এই পুরস্কার প্রাপ্তির আনন্দের মাঝে ছিল তীব্র বিষাদ। পুরস্কার প্রাপকের সম্মানে জাতীয় পতাকা হিসেবে রমেনের পাশে ছিল ব্রিটেনের ইউনিয়ন জ্যাক। কারণ ভারত তখনও পরাধীন। নিজস্ব কোন জাতীয় পতাকা নেই। আমেরিকার চার্জ-দ্য-অ্যাফেয়ার সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন, Sir C.V Raman…after receiving the prize from the hands of the king was visibly moved by his emotion and sat with tears streaming down his face. ভারতের (স্বাধীন) জাতীয় পতাকা বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে পারেননি বলে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। নিজের মাতৃভূমিকে এতটাই ভালোবেসে ছিলেন, নিজের দেশ নিয়ে এতটাই গর্বিত ছিলেন রমন। এই মহান বিজ্ঞানসাধক যে নভেম্বরে এই ধরাধামে এসেছিলেন, সেই নভেম্বরেরই ২১ তারিখে (১৯৭০) গবেষণাগারে  কাজ করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ভারত সরকার রমন এফেক্ট আবিষ্কারের দিন ২৮ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় বিজ্ঞানদিবস হিসাবে ঘোষণা করেন। এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর কি হতে পারে?

 

ছবি ঋণ ইন্টারনেট


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up