ছোটোদের চাঁদের হাসি / জেনে নিতে মানা নেই / ডিসেম্বর ২০২৪

শতাব্দী প্রাচীন ব্যান্ডেল চার্চ

 

ডিসেম্বর মাসটা বেশ একটা ছুটি আর উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। বড়দিন, বছর শেষ ও নতুন বছর শুরুর আবাহন উদযাপনে মেতে ওঠে সারা বিশ্ব। তোমরাও নিশ্চয়ই নানারকম ভাবে আনন্দে কাটাবার কথা ভাবছ। এই ডিসেম্বরে ঘুরে আসতেই পারো, ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যান্ডেল চার্চে। আসল নাম ব্যাসিলিকা অফ দ্য হোলি রোজারি (Basilica of the Holy Rosary)! প্রচলিত নাম ব্যান্ডেল চার্চ। এটি পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন খ্রিস্টান গির্জাগুলির মধ্যে অন্যতম। প্রসঙ্গত, এই গির্জা মাতা মেরিকে উৎসর্গ করা হয়েছে। এই সময়টায় পুরো গির্জা অতি মনোরম আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে ওঠে।

 

হুগলি জেলার ব্যান্ডেল শহরে অবস্থিত এই গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫৯৯ সালে, যা বাংলায় পর্তুগিজদের বসতির চিহ্ন-স্বরূপ আজও দাঁড়িয়ে। এটি এক অসাধারণ ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ, যা শিল্পসৌকর্যেও অতুলনীয়। ইতিহাস বলে, ১৫০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পর্তুগিজরা বন্দর হিসেবে ব্যান্ডেলকে ব্যবহার করতে শুরু করে। ১৫৭১ সালের কাছাকাছি সময়ে মুঘল সম্রাট আকবরের কাছ থেকে হুগলিতে একটি শহর স্থাপন করার অনুমতি পায় তারা। পর্তুগিজরা এখানে বসতি স্থাপন করার পর থেকেই তাদের ধর্মযাজকরা স্থানীয় মানুষদের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করতে থাকেন। ১৫৯৮ সালের মধ্যে হুগলিতে প্রায় পাঁচ হাজার ক্যাথলিক বাস করতেন, যার মধ্যে স্থানীয় এবং মিশ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

 

 

১৫৭৯ সালে পর্তুগিজরা হুগলি নদীর তীরে একটি বন্দর এবং ফোর্ট উগোলিম নামে একটি দুর্গ নির্মাণ করে। পরের বছর, ক্যাপ্টেন পেড্রো টাভারেস সম্রাটের কাছ থেকে সর্বসম্মতভাবে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার ও চার্চ নির্মাণের অনুমতি পান। এর ফলস্বরূপ, ১৫৯৯ সালে ব্যান্ডেল চার্চ নির্মিত হয়। তবে, প্রথম গির্জাটি ১৬৩২ সালে মুসলিমদের দ্বারা হুগলি আক্রমণের সময় ধ্বংস হয়ে যায়। পরে ১৬৬০ সালে গোমেজ দে সোতো তার ওপর নতুন একটি গির্জা নির্মাণ করেন। পুরানো গির্জার একটি প্রস্তরখণ্ড এখনও গির্জার পূর্বদ্বারে দৃশ্যমান, যাতে ১৫৯৯ সাল খোদাই করা রয়েছে।

 

গির্জার অভ্যন্তরে খ্রিস্টের জীবনকে দৃষ্টিনন্দন চিত্রকর্মের মাধ্যমে চিত্রিত করা হয়েছে। মাতা মেরির মূর্তিটিও সুন্দর সজ্জাসহ বেদীতে রাখা আছে। গির্জার ভিতরে ছবি তোলার নিয়ম নেই। অর্থাৎ এর অনন্যতা স্মৃতিতেই ধরে রাখতে হবে। মূল গির্জার ভিতরে একটি বিশাল ঝাড়বাতি রয়েছে এবং জানালাগুলি রঙিন কাঁচের কাজ দিয়ে সজ্জিত। গির্জার প্রাঙ্গণে একটি ফোয়ারা রয়েছে। দর্শনার্থীরা এখানে এলে মোমবাতি জ্বালান, প্রার্থনা করেন এবং ইচ্ছাপূরণে ফোয়ারায় পয়সা ফেলেন। গির্জার সম্মুখে একটি জাহাজের মাস্তুল রয়েছে। কথিত আছে, একবার বঙ্গোপসাগরে একটি পর্তুগিজ জাহাজ প্রবল ঝড়ের মুখে পড়লে, মাতা মেরি জাহাজটিকে রক্ষা করেন। এরপর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ জাহাজের ক্যাপ্টেন মাস্তুলটি গির্জায় দান করেন। গির্জায় তিনটি প্রার্থনাবেদি, কয়েকটি সমাধিপ্রস্তর, একটি অর্গ্যান ও মাতা মেরির একটি সিংহাসন রয়েছে।

 

 

১৯৮৮ সালের ২৫ শে নভেম্বর পোপ জন পল দ্বিতীয় এই গির্জাটিকে একটি মাইনর বাসিলিকা (সারা বিশ্বের নিরিখে বিশেষ মর্যাদা) হিসাবে ঘোষণা করেন। কথিত আছে, এর অনির্বচনীয় স্থাপত্য, চূড়ান্ত ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও জনমানসে এই গির্জার বিপুল জনপ্রিয়তার কারণেই ব্যান্ডেল চার্চ এহেন মর্যাদা লাভ করে। বর্তমানে এটি প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। গির্জা পরিদর্শন করার জন্য কোন প্রবেশমূল্য নেই। কলকাতা ও অন্যান্য সব বড় শহর থেকে ট্রেনে বা গাড়িতে ব্যান্ডেল যাওয়া যায়। ব্যান্ডেল চার্চ দেখার সবচেয়ে ভালো সময় হলো শীতকাল। ক্রিসমাস এবং নববর্ষের কারণে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির প্রথম দিক পর্যন্ত প্রচুর পর্যটকের ভিড় হয় ব্যান্ডেল চার্চে।


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up