ছোটোদের চাঁদের হাসি / জেনে নিতে মানা নেই / এপ্রিল ২০২৪

মাস্টারমশাইয়ের নাম ডিরোজিও

শ্রদ্ধায়, স্মরণে

 

রবীন্দ্রনাথের নাম তোমরা শুনেছ, নেতাজীর নাম শুনেছ, বিবেকানন্দের নাম শুনেছ, কাজী নজরুলের নাম শুনেছ, জগদীশচন্দ্র বসুর নামও শুনেছ। এঁদের মধ্যে কেউ কবি, কেউ সমাজসেবী, কেউ দেশপ্রেমিক, কেউ বা বিজ্ঞানী। এঁরা দেশের মুখোজ্জ্বল করেছেন। তাই এঁরা প্রণম্য।

 

আজ আমি তোমাদের একজন শিক্ষক বা মাস্টারমশাইয়ের কথা বলব, যাঁর নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখার মতো। তিনি ডিরোজিও। পুরো নাম হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। নাম শুনে অনেকে মনে করতে পারো, ডিরোজিও সাহেব বিলেত থেকে হ্যাট-কোট পরে জাহাজে করে কলকাতা এসেছিলেন। ইংরেজদের আমলে কত সাহেবই তো এসেছিলেন। তিনিও বোধহয় তাঁদের মতোই কেউ হবেন। কিন্তু মোটেই তা নয়, তিনি আমাদের কলকাতারই মানুষ। কলকাতাতেই তাঁর জন্ম। এখানেই তিনি মাস্টারি করেছেন। এখানেই তাঁর মৃত্যু।

 

বিলেত কেমন দেখতে, তোমাদের অনেকের মতো তিনিও চোখে দেখেননি। আর তিনি খাঁটি ইংরেজও নন। তিনি ছিলেন পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত। জানো বোধহয়, ইংরেজদের অনেক আগে এদেশে পর্তুগিজরা এসেছিল বাণিজ্য করতে। ভাস্কো ডা গামার নাম তো শুনেছ তোমরা। তিনি নতুন দেশ আবিষ্কারের অভিযানে নেমে পর্তুগাল থেকে জাহাজে করে এ দেশে আসেন ১৪৯৮ সালে। ইংরেজরা তখন কোথায়? তোমরা নিশ্চয়ই ব্যান্ডেল চার্চ দেখেছ ! চুঁচুড়া, চন্দননগর, শ্রীরামপুরের মত ব্যান্ডেলও একটা শহর। সেই ব্যান্ডেল চার্চও পর্তুগিজদের তৈরি (১৫৯৯)।

 

কাজেই, পর্তুগিজরা অনেকদিন আগেই এদেশে এসেছে। জানা গেছে ডিরোজিওদের পরিবার চার পুরুষ ধরে কলকাতায় বসবাস করেছেন। আরো বেশিও হতে পারে। ডিরোজিওর ঠাকুরদা মাইকেল ডিরোজিও বেশ বড় পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ছিলেন। ডিরোজিওর বাবা ফ্রান্সিস একটা ব্রিটিশ কোম্পানিতে বড় চাকরি করতেন। কলকাতায় তাঁদের সম্পদ, সম্পত্তি, বাড়ি, গাড়ি সবই ছিল।

 

কলকাতায় শিয়ালদহের কাছে মৌলালিতে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডে ছিল ডিরোজিওদের বাড়ি। সেখানেই তাঁর জন্ম ১৮০৯ সালের ১৮ এপ্রিল। এখন যেটা জগদীশ চন্দ্র বসু রোড বা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড নামে পরিচিত–সেটা ছিল আসলে একটা খাল। নাম ছিল মারাঠা খাল। একসময় বর্গী বা মারাঠা দস্যুদের আক্রমণ হতো বাংলার বিভিন্ন জায়গায়। তাদের ভয়ে জুজু হয়ে থাকত বাংলার মানুষ। কলকাতার পশ্চিম দিকে ভাগীরথী বা গঙ্গা। মারাঠা দস্যুরা লুটপাট করতে আসত ঘোড়া ছুটিয়ে। পশ্চিমে নদী থাকায়, কলকাতা সেদিক থেকে সুরক্ষিত ছিল। পূর্ব দিক থেকে তারা যাতে আসতে না পারে, সেজন্য একটা খাল কাটা হয়। সেই খালই মারাঠা খাল।

 

বর্গীর ভয়ে রাজা-জমিদাররা নানা জায়গা থেকে কলকাতায় চলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। কলকাতা ছিল ইংরেজদের দখলে। তাদের কামান-টামান আছে। তাদের উপনিবেশিত শহর অনেকটা নিরাপদ বলে অনেকে এখানে চলে আসে। তারপর বর্গীর ভয় প্রশমিত হলে মারাঠা খাল বুজিয়ে তৈরি হয় প্রথম বড় পাকা রাস্তা। প্রথমে এর নাম হয়েছিল সার্কুলার রোড। খিদিরপুর থেকে বাগবাজার পর্যন্ত বৃত্তাকার এই রাস্তা তখন ছিল কলকাতার বাইরের দিকে সীমানা। তো এই সার্কুলার রোডের পাশেই বাইরের দিকে ছিল ডিরোজিওদের বাড়ি। ৬ বিঘে জমির উপর পুকুর-বাগান সমেত বিরাট দোতলা বাড়ি। সেই বাড়িটা এখনও আছে–১৫৫ এ আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোড। লালরঙের তিনতলা বাড়ি। তখন দোতলা ছিল। এই বাড়িতেই ডিরোজিওর জন্ম ও মৃত্যু। তিনি মারা গেছেন কত বছর বয়সে জানো? মাত্র ২২ বছর ৮ মাস ৮ দিন বয়সে। কলেরায় আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান ১৮৩১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। সে বড় দুঃখের কথা।

 

হেনরি ডিরোজিও পড়াশুনো করেছিলেন ধর্মতলা স্ট্রিটে (এখন নাম লেনিন সরনি) ডেডিড ড্রামণ্ডের স্কুলে। স্কুলের নাম ধর্মতলা একাডেমি। ডেভিড ড্রামণ্ড এসেছিলেন স্কটল্যান্ড থেকে। অসামান্য এক মাষ্টারমশাই। হেনরি ডিরোজিও তাঁর হাতে তৈরি ছাত্র। যেমন মাস্টার তেমনি ছাত্র। ডিরোজিওকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। স্কুলের ছাত্ররাও ভালোবাসত তাঁকে। একবার হয়েছিল কী অসুস্থ হয়ে ডিরোজিও কয়েক দিন স্কুলে আসেননি। ক'দিন পর স্কুলে এলে, ছাত্রবন্ধুরা তাঁকে হৈহৈ করে ঘিরে ধরেছিল। এতে বোঝা যায়, তাঁকে তাঁর বন্ধুরা কীরকম ভালোবাসত। ডিরোজিও ছিলেন খুব বুদ্ধিমান ছাত্র। ৯ বছর বয়স থেকেই তাঁর নাম কাগজে বের হতো। ভালো আবৃত্তি, ভালো ফলাফলের জন্য কখনো স্বর্ণপদক, কখনো বই উপহার পেতেন।

 

ড্রামণ্ডের স্কুল থেকে পাশ করে প্রথমে কিছুদিন বাবার অফিসে কেরানির চাকরিতে ঢোকেন। ভালো না লাগায় চলে যান ভাগলপুরে। তাঁর মামা আর্থার জনসন নীলকুঠির মালিক ছিলেন। সেখান থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন অল্প কিছুদিনের মধ্যেই, ইন্ডিয়া গেজেট নামে একটা পত্রিকার চাকরি নিয়ে। মাস কয়েক সে চাকরি করার পর যোগ দেন হিন্দু কলেজের শিক্ষক পদে (১৮২৬)। বোঝা যায় কেরানি হবার জন্য বা নীলকুঠিতে চাকরি করার জন্য ডিরোজিওর জন্ম হয়নি। তিনি হচ্ছেন ডেভিড ড্রামণ্ডের মত জাত মাস্টার। হিন্দু কলেজে যোগ দেওয়ায় তাঁর জীবনের সঙ্গে জীবিকার সম্পর্ক স্থাপিত হলো।

 

১৮১৬ সালে স্থাপিত হিন্দু কলেজ ছিল এদেশীয় ছাত্রদের জন্য প্রথম আধুনিক স্কুল। এটা স্থাপন করেছিলেন এদেশের ধনবান সমাজপতিরা। আগে ছিল মুসলমান আমল। তখন ফার্সি শিখতেন এদেশের সম্পন্ন হিন্দু পরিবারের ছেলেরা। তাতে চাকরি বাকরি কাজকর্মের সুবিধা হত। এখন ইংরেজ আমল। ইংরেজি না শিখলে চলবে না। ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে দহরম মহরম করার জন্য ইংরেজি শেখা জরুরি ছিল। সেটা বুঝে সমাজপতিরা স্থাপন করেন হিন্দু কলেজ। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য স্থাপিত এই স্কুলেই ডিরোজিও পেলেন চতুর্থ শিক্ষকের চাকরি। তখন কে জানত, ১৭ বছরের এই পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত ছেলেটি হয়ে উঠবে হিন্দু কলেজের সেরা শিক্ষক। শুধু হিন্দু কলেজ কেন, উনিশ শতকের বাংলার সেরা শিক্ষক হয়ে উঠেছিলেন হেনরি ডিরোজিও। মাত্র বছর পাঁচেক শিক্ষকতার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। তার মধ্যেই তিনি ছাত্রদের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন হিন্দু কলেজের রক্ষণশীল পরিচালকমণ্ডলী।

 

ডিরোজিও শুধু সিলেবাসে থাকা বই পড়াতেন না,  রুটিন অনুযায়ী ক্লাসে শেষ করতেন না তাঁর পড়ানো। জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য-ইতিহাস ইত্যাদি নানা ধরনের বই ছাত্রদের হাতে তুলে দিতেন তিনি। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে স্কুলে হাজির হতেন। স্কুলের ছুটি হবার পরও স্কুলে থাকতেন। ক্লাসের বাইরে হতো আলোচনা, বিতর্ক সভা। যে কোনো ক্লাসের ছাত্ররা সেখানে হাজির হতো। চুম্বক যেমন লোহাকে টেনে নেয়, তিনি সেইভাবে ছাত্রদের আকর্ষণ করতেন। তিনি স্কুলে আসা মাত্র ছাত্ররা তাঁকে ঘিরে ধরত। নানা বিষয়ে ডিরোজিওকে জিজ্ঞাসা করত। স্কুল শেষ হবার পরও তাঁকে ছাড়তে চাইত না ছাত্ররা। তারা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাড়িতেও চলে যেত তারা।

 

এসব পছন্দ না হওয়ায় স্কুলের পরিচালকরা একসময় বলে দিলেন, স্কুলে এসব চলবে না। তখন মানিকতলায় শ্রীকৃষ্ণ সিংহের বাগান বাড়িতে তিনি স্থাপন করলেন বিতর্ক সভা। সভার নাম 'একাডেমিক এ্যাসোসিয়েশন’। প্রতি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সেখানে বসত সান্ধ্য বিতর্কসভা। কোনো একটি বিষয় নিয়ে ছাত্রদের একটি পক্ষ উপস্থাপন করত তাদের একরকম বক্তব্য। অন্যদল উপস্থাপন করত তার বিরুদ্ধ বক্তব্য। এইভাবে জমে উঠত তর্ক-বিতর্ক। আর সেই উচ্চমানের বিতর্ক শুনতে আসতেন বিচারপতি, লাট সাহেবের সেক্রেটারি, বিজ্ঞান মিশনারি, অধ্যক্ষ বা যে কোনো আগ্রহী মানুষ। ডেডিড হেয়ার নিয়মিত আসতেন। বুদ্ধির তরবারি খেলা চলত এই বিতর্কসভায়। ডিরোজিও ছাত্রদের বলতেন কোনো কিছু বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া ঠিক নয়। যুক্তি দিয়ে বিচার করে নিতে হবে সব কিছু। নানারকম প্রশ্নের আলো ফেললে একটা জিনিসকে সবদিক থেকে দেখা যায়। তখন কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা বিচার করা যায়। সেইজন্যই বিতর্কসভা।

 

তিনি বলতেন এযুগে বিশ্বাস নয়, জ্ঞানই শক্তি। কে কোন বংশে জন্মেছে? কার কি জাতি? কোন আদিম যুগে কে কি বলে গেছে? সমাজে কত মানুষ কি কি মেনে চলে?–সে সব নির্বিচারে মেনে চলা কোনো কাজের কথা নয়। সব কিছুকে প্রশ্ন করতে হবে। তবে সত্যকে আনা যাবে। বুদ্ধিকে ক্রমাগত শাণিত করতে হবে। তবে বোঝা যাবে কোনটি ঠিক,কোনটি ঠিক নয়। আমাদের হতে হবে আধুনিক, যুগোপযোগী, মানবিক। তবেই মানব সভ্যতার অগ্রগতি ঘটবে। তিনি ছাত্রদের শুধু পাশ করার প্রশ্নোত্তর শেখাননি, তিনি তাদের বুদ্ধিকে জড়তা মুক্ত করার পথ বাতলে দিয়েছেন।

 

তিনি মুক্তবুদ্ধির দিশারি। ছাত্রদের মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে, তাকে যত্ন করার জন্য বলেছিলেন, জ্ঞানের চর্চা করতে হবে। বাক্শক্তি ও লিখন শক্তির মধ্যে দিয়ে নিজেদের প্রকাশ করতে হবে। মিথ্যা, অপবিশ্বাস, কুসংস্কার, অমানবিকতাকে আঘাত করতে হবে। বাকশক্তির চর্চার জন্য বিতর্কসভা ও লিখনশক্তির চর্চার জন্য পত্র-পত্রিকা। বলা ও লেখার মধ্যে দিয়ে জ্ঞান ও সত্যকে সমাজে সঞ্চারিত করলে, তবে, একটা সমাজ আলোকিত হবে, জড়তামুক্ত হবে, মানবিক হবে। ডিরোজিও শুধু মাত্র ক্লাসরুমের মাস্টার ছিলেন না। তিনি ছিলেন তাদের 'ফ্রেন্ড, ফিলোজফার এবং গাইড’। সমাজকে সচল, সজীব ও প্রগতিশীল করার জন্য তিনি ছাত্রদের ব্যবহার করেছিলেন অস্ত্রের মত। 'ওল্ড বেঙ্গল’ কে তিনি করে তুলেছিলেন 'ইয়ং বেঙ্গল’। তাই তাঁকে বলা হয় নব্যবঙ্গের দীক্ষাগুরু, মুক্তচিন্তার দিশারি। আদর্শ মাষ্টার বা শিক্ষক কেমন হওয়া দরকার, তা ডিরোজিওকে দেখলে বোঝা যায়। তাই তাঁর জীবন ও জীবনী প্রতিটি ছাত্রের পড়া দরকার।

 

তোমরা বড় হয়ে, যখন তাঁর জীবনী পড়বে, তখন জানতে পারবে এই তরুণ শিক্ষক ছিলেন একজন বিরল প্রতিভার মানুষ। এমন মাস্টার যে এক সময় কলকাতার একটি প্রতিষ্ঠানে মাস্টারি করেছিলেন, ছাত্রদের নবজীবনের দীক্ষা দিয়েছিলেন, সে বড় ভাগ্যের কথা। এমন মাস্টারকেও স্কুল থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। যেদিন কলেরায় আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়, সেদিন তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল কলকাতার সেরা মানুষরা–তাঁর প্রিয় ছাত্ররা। সে সব পড়লে চোখে জল এসে যাবে।

 


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up