ছোটোদের চাঁদের হাসি / হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা / অক্টোবর ২০২৪

পাহাড় গাঁয়ের পুজো

 

সেটা বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখন পুজোর ছুটি মানেই ঠিকানা উত্তরবঙ্গের পাহাড়ী কোনও গ্রাম। এক চেনা এজেন্টের মাধ্যমে জানতে পারলাম সিলেরি গাঁওয়ের নাম। এখন এর নাম বহুল প্রচারিত। তখন কিন্তু একেবারে অচেনা। আমি জানি, তোমরাও খুব পাহাড় ভালোবাসো। তাই চলো, তোমাদের আজ সেই নির্জন পাহাড়ী গ্রামের গল্প শোনাই। দার্জিলিং মেলে সারারাতের জার্নি শেষ করে সকালে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে রিজার্ভ গাড়িতে রওনা দিয়ে সিলেরি গাঁও পৌঁছতে দুপুর গড়ালো। আর শান্ত সেই ছোট্ট গ্রামে পা দিয়েই মন ভালো হয়ে গেল। মাথার ওপর নীল আকাশের সামিয়ানা। সেখানে সাদা মেঘের ভেলায় ভাসমান শরতের অমল আনন্দ। পিছনে উঁচু পর্বতমালা খাড়া দাঁড়িয়ে, তারপর পাইনের ঘন সারি, সামনে ছড়ানো বিস্তৃত উপত্যকায় ছোট ছোট গ্রাম। তারই একটি এই সিলেরি গাঁও।

 

 

হোমস্টে-র নির্ধারিত ঘরে ঢুকে ব্যাগপত্র সামলে, স্নান করে লাঞ্চ সারতে সারতে অনেকটা বেলা হলো। সময়টা অক্টোবর। অতএব দিন ছোট। সামান্য বিশ্রাম নিয়েই ঘুরে দেখতে বেরিয়ে পড়লাম আশপাশ। দেখে আক্ষরিক ভাবেই মনে হলো, স্বর্গ আছে পৃথিবীর বুকেই। ঘন পাইনের অরণ্য ছাড়াও এখানে রয়েছে আরও নানা গাছগাছালি, সঙ্গে অজস্র রঙবেরঙের ফুলগাছ। একটু পরেই গোধূলির গোলাপী আলোয় আলোকময় হয়ে উঠল চরাচর। তারপর ঝুপ করে নেমে গেল অন্ধকার। ডিনারের আগে পর্যন্ত বসে রইলাম ঘরের লাগোয়া বারান্দায়। শুক্লপক্ষের মায়াবী চাঁদ ততক্ষণে সামনের আকাশে। প্রকৃতির যাবতীয় মনোরম অনুষঙ্গ মিশে গিয়েছিল উপত্যকার আলো-আঁধারি পরিবেশে। ডিনার সেরে ঘুমের দেশে যেতে যেতে টের পেলাম, থেমে গেছে সব শব্দ। শুধু শোনা যাচ্ছিল রাতচরা পাখিদের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ।

 

পরদিন অষ্টমী। কলকাতায় এখন কত না ঘটাপটা। সে হোক, এখানকার ছোট্ট পুজো প্যান্ডেলটি দেখে মন ভালো হয়ে গেল। একটু আগেই পুরি আর সবজি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরেছি। ঝকঝকে একটি দিন। হোমস্টে-র  বাগানে তখন ফুলেদের ওপর প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি শুরু হয়ে গেছে। আজ দেখতে যাব সাইলেন্ট ভ্যালি আর রামিতে ভিউ পয়েন্ট। গাড়ি রেডি। আমিও রেডি। গাড়িতে উঠতে যাব, একদল কচিকাঁচা এসে ঘিরে ধরল–ওদের পুজো দেখতে যেতে হবে। সামান্য হেঁটে, কিছুটা চড়াইগামী রাস্তায় উঠে পৌঁছলাম মণ্ডপে। হোমস্টে-র জমি থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে ছোট্ট এক সমতল ভূমি। একে মালভূমিও বলতে পারো। সেখানেই বাহারি কাপড়, ফুলের মালা, রঙিন কাগজের শিকল দিয়ে সাজানো পুজো প্যান্ডেল। প্যান্ডেলে তেমনই ছোট আকারের দুর্গা মূর্তি, ছেলেমেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আনন্দময়ী মা। মায়ের মুখের মধুর হাসিখানি আজও ভুলিনি। ভুলিনি পাহাড় গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের আন্তরিকতা।

 

 

তোমাদের জানিয়ে রাখি, সিলেরি গাঁও থেকে দুর্দান্ত কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ মেলে। আজ সকালে ঘুম ভাঙতে দেরি হওয়ায় তার দর্শন পাইনি। রোদ উঠে গেলে আর তাকে দেখা যায় না। অতএব আগামিকাল সকালে চেষ্টা চালাতে হবে। আপাতত আমাদের গাড়ি চলেছে রামিতে ভিউ পয়েন্টের দিকে। পৌঁছে এককথায় চমৎকৃত হলাম। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও তার আশেপাশের বরফে ঢাকা শৃঙ্গগুলি দৃশ্যমান। এছাড়া, তিস্তা নদীর সবচেয়ে দীর্ঘতম বাঁকের দৃশ্যও এখান থেকে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। তিস্তা এবং ঋষি নদীর সঙ্গমস্থলও রামিতে ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখা যায়, যা মনোমুগ্ধকর। রামিতে ভিউ পয়েন্ট সিলেরি গাঁও থেকে মাত্র ৩ কিমি দূরে, গাড়িতে করে বা ট্রেকিং এর মাধ্যমে এখানে পৌঁছন যায়। এবার যাব সাইলেন্ট ভ্যালি। যাওয়ার পথে জরুরি কিছু তথ্য। সিলেরি গাঁও হলো উত্তরবঙ্গের কালিম্পং জেলার পেডং-এর কাছে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই গ্রামটির মুখ্য আকর্ষণ অবশ্যই কাঞ্চনজঙ্ঘা। এছাড়াও অপূর্ব পাইনের শোভা, গ্রামের শান্ত ও নিস্তরঙ্গ জীবন মন ভালো করে দেয়।

 

 

সাইলেন্ট ভ্যালি পৌঁছে আরও একবার প্রকৃতির মোহময়ী রূপে বিমুগ্ধ হলাম। মূল রাস্তা থেকে অনেকটা নিচে ট্রেক করে নামতে হয়। নামা মাত্রই চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সবুজের মহোৎসব !! যথার্থই নিঃশব্দ এই উপত্যকা চারপাশে পাইনের অরণ্য, মাঝে সবুজ ঘাসের গালিচায় ঢাকা প্রান্তর। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ফেরার পথ ধরলাম। হোমস্টে-তে ফিরে একটু গল্পের বই পড়া। বাইরে রোদ চড়া। তাই বারান্দাতেই সময় কাটানো। একটু পর লাঞ্চের ডাক আসে। এই অবকাশে জানিয়ে দিই এখানকার খাবারদাবারের কথা। লাঞ্চ ও ডিনারে যা পাওয়া যায়–ভাত-রুটি, ডাল-ভাজা-সবজি, চিকেন বা ডিম কারি–এছাড়া আচার, স্যালাড, পাপড় থাকে সঙ্গে। ব্রেকফাস্টে রুটি, পুরি বা পাউরুটি, সঙ্গে সবজি, বাটার, ডিমের ওমলেট বা ডিম সেদ্ধ।

 

বিকেলটা এদিক ওদিক ঘুরে, সন্ধ্যায় বারান্দায় বসলাম। আজ বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। শীত পোশাক গায়ে জড়িয়ে উপভোগ করলাম রাতের পাহাড়ী গ্রামের নীরব সৌন্দর্য। সঙ্গে উজ্জ্বল চাঁদের রোশনাই আকাশ জুড়ে। ঠাণ্ডা বাড়ছিল ক্রমশ। অতএব ডিনার সেরে তাড়াতাড়ি বিছানায়। পরদিন ভোরে উঠে প্রথমেই ছুটে বাইরে। কাঞ্চনজঙ্ঘা তার অনির্বচনীয় রূপ নিয়ে দৃশ্যমান তখন। হোমস্টে-র বাকি ট্যুরিস্টরাও সেই রূপ দেখে মন্ত্রমুগ্ধ। এদিন যাওয়া হবে তিনচুলে ভিউ পয়েন্ট ও দামসাং দুর্গ। তাই এখন কাঞ্চনজঙ্ঘার কাছ থেকে ছুটি। দ্রুত ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়িতে ওঠার আগে আর একবার কালকের পুজো প্যান্ডেলে যাই। সেখানে তখন পুরোহিত মন্ত্র পড়ছেন মা দুর্গার সামনে।

 

 

মণ্ডপে একটু থাকার পর যাত্রা তিনচুলের দিকে। গাড়ি স্টার্ট দেয়। সিলেরি গাঁও-এর কাছেই এই তিনচুলে ভিউ পয়েন্ট। এটি সিলেরি গাঁও থেকে প্রায় ৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এবং ট্রেকিং করে সেখানে পৌঁছতে হয়। পাহাড়ি রাস্তা ধরে চড়াইয়ের দিকে ট্রেকিং করে ওঠা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ হিমালয়ের ৩৬০ ডিগ্রী দৃষ্টিকোণ উপভোগ করা যায়। পরিষ্কার আকাশে নাথুলা পাস এবং জেলেপ লা’র দৃশ্যও দেখতে পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে অনির্বচনীয়। এরপর চললাম দ্যামসাং দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখতে। এটি সিলেরি গাঁও থেকে প্রায় ৪ কিমি দূরে অবস্থিত এবং পাইন অরণ্যের মধ্য দিয়ে এক ঘণ্টার ট্রেক করে সেখানে পৌঁছতে হয়। ঐতিহাসিক গুরুত্বের এই দুর্গ দেখে আবার হোমস্টে-তে ফেরা। সন্ধ্যা নামলে নবমীর চাঁদ ওঠে আকাশে। পুজো প্যান্ডেল থেকে ঢাকের আওয়াজ, ঘণ্টার ধ্বনি ভেসে আসে। বুঝতে পারি আরতি হচ্ছে। কাল দশমী। মায়ের বিদায়ের মুহূর্ত এসে যায়।

 

 

আমারও আজই শেষ দিন এখানে। আগামিকাল কলকাতা ফেরার পালা। যারা আসতে চাও সিলেরি গাঁও, তাদের জেনে রাখা দরকার, শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেল, পদাতিক বা নিউ জলপাইগুড়িগামী যে কোনও ট্রেনে এসে, সেখান থেকে গাড়িতে সিলেরি গাঁও পৌঁছতে হয়। থাকার জন্য প্রচুর হোমস্টে রয়েছে। অক্টোবর থেকে এপ্রিল এখানে আসার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এলে পর্যাপ্ত শীত পোশাক সঙ্গে আনতে হবে।


পাঠকদের মন্তব্য

রিংকু চ্যাটার্জি শূর লিখেছেন... ১৬ই অক্টোবর, ২০২৪
অদ্ভুত সুন্দর সিলেরি গাঁও এর অদ্ভুত সুন্দর বর্ণনা মনে হচ্ছে যেন আমি পৌঁছে গেলাম আর প্রান ভরে প্রকৃতির বৈভবের অনুভব করতে লাগলাম, সুন্দর লেখাটির জন্য ধন্যবাদ

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up