ছোটোদের চাঁদের হাসি / হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা / নভেম্বর ২০২৪

ঝর্নারা চঞ্চল এখানে

 

ওড়িশার ভঞ্জ রাজাদের নামেই ময়ূরভঞ্জ জেলার নামকরণ। জলা জঙ্গলের দেশ। মানুষের বাস ছিল কম। বিস্তৃত ছিল কেন্দ পাতার জঙ্গল। সেই থেকেই জেলার নাম হয় কেন্দুয়াঝার, এখন মুখে মুখে হয়ে গিয়েছে কেওনঝার (ঝার মানে জঙ্গল)। পরবর্তীকালে এই বিস্তৃত জঙ্গল অঞ্চল অর্থাৎ কেওনঝার একটা আলাদা জেলায় পরিণত হয়। বর্তমানে লোহা, অভ্র সহ বিভিন্ন খনি অঞ্চল এখানে রয়েছে। এই কেওনঝারে হলো আদ্যন্ত ঝর্নার রাজত্ব। কত শত ঝর্না আর কী তাদের রূপ। মন একেবারে পাগলপারা হয়ে যায়।

 

পুরীগামী শতাব্দী এক্সপ্রেস ধরে সাড়ে আটটা নাগাদ নেমেছিলাম জাজপুর স্টেশনে। নেমেই একেবারে কাকভেজা হয়ে গেলাম দুরন্ত বৃষ্টিতে। গাড়ি বলা ছিল আগেই। কিন্তু তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে একনম্বরে যাওয়াই হয়ে গেল সমস্যা। বের হবার রাস্তা ওদিক দিয়েই। যাই হোক, আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর গাড়িতে চেপে বসলাম। বুকিং ছিল পান্থনিবাসে, ওড়িশা পর্যটন উন্নয়ন নিগমের গেস্ট হাউস। সেখানে পৌঁছতে অনেকটাই রাত হয়ে গেল। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু এখানেই আলো জ্বলছে। খেয়ে নিয়েই ঘুমের দেশে ডুব।

 

 

পরদিন সকালে উঠে বাইরে বের হতেই সব ক্লান্তি উধাও। পান্থনিবাসের চৌহদ্দিতে ফুলের মেলা বসে গিয়েছে। পিছনে জঙ্গল আর ছোট পাহাড়ের আভাস। যে গাড়িতে জাজপুর থেকে এসেছিলাম, তার চালক সুধীর দেখি একমুখ হাসি নিয়ে এগিয়ে আসছে–বলল, বেড়াতে যাবেন তো? আমার গাড়িতে যাবেন? ভদ্র ছেলেটিকে আমাদের আগেই ভালো লেগেছিল। ওকে অপেক্ষা করতে বলে, তাড়াতাড়ি স্নান সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে যাব বড়া ঘাগড়া ড্যাম আর ঝর্নায়।

 

বর্ষায় জঙ্গল ঘন সবুজ। দুদিকে জঙ্গল, মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছি আমরা। একটা ছোট্ট সাঁকো পেরিয়ে পায়ে হেঁটে এবার বাঁধের নিচে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেই, সামনে বিশাল জলাধার। বড়া ঘাগড়া। বাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ডানদিকে নিচে দেখা গেল লাল-সবুজ রঙের ছোট্ট মন্দির। পায়ের ব্যথা ভুলে বাঁধের ঢালে সবুজ আগাছায় প্রায় গড়িয়ে নেমে গেলাম সেই মন্দিরের পায়ের কাছে। দেখলাম, সেটি এক শিব মন্দির। তারপর পায়ে পায়ে নেমে এসে হঠাৎ চোখের সামনে জেগে উঠল জলস্রোত, বহুদূর থেকে এসে ঝাঁপিয়ে নামছে আরো নিচে। সে কেবল আড়াল খুঁজছে জঙ্গলের।

 

 

এখান থেকে আবার চলা। এবার কোথায় বলো তো? রামায়ণের লব-কুশের জন্মস্থান আর সীতাভিঞ্জি। বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে পাহাড়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠতে হলো। কথিত, বিশালাকার পাথরের খাঁজে সিঁদুর-ফুলে ঢাকা জায়গায় নাকি লব আর কুশের জন্ম হয়েছিল। প্রবাদ যাই হোক, পাহাড়টা অনবদ্য। দুবরাজপুরের মামাভাগ্নে পাহাড়ের সঙ্গে খুব মিল। সামান্য দূরে রয়েছে একটি বিশাল পাথর, যার উচ্চতা প্রায় ১৫০ ফুট এবং আকৃতি একটা আস্ত মন্দিরের মতো। পাশে রয়েছে একটা ছাতার আকৃতির মস্ত বড় পাথর, যার ছাদের নিচের অংশে এখনো লক্ষ করলে দেখা যায় প্রায় বিলীয়মান ফ্রেস্কো। এই ফ্রেস্কো কী জানো তো? ভেষজ রং দিয়ে আগেকার শিল্পীরা গুহাচিত্র আঁকতেন। অনেকে মনে করেন যে, সীতাভিঞ্জির এই ফ্রেস্কো গুপ্তযুগের। বর্তমানে এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে ওড়িশা সরকার।

 

এবার যাব গোনাসিকা। আসলে গো-নাসিকা। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে জলের ক্ষীণধারা দেখা গেল। এটা গোনাসিকা ফলস। পাহাড়ের ওপরে গোটা তিরিশ-চল্লিশ সিঁড়ি ভেঙে উঠে একটি মন্দির। প্রচলিত গল্পে না-ই বা গেলাম। সেখানে বহুদিন ধরে জলধারায় পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে একেবারে গরুর নাকের আকৃতি ফুটে উঠেছে। তার থেকেই নাম গোনাসিকা। ধারাজল নাকের দুই ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে এসে একটি ঝর্না বা প্রপাতের সৃষ্টি করেছে। জল-জঙ্গল-পাহাড়ের পটভূমিতে ছোট্ট মন্দিরটি বেশ ভয় আর সম্ভ্রম আদায় করে নেয়।

 

 

প্রথমদিনের বেড়ানোর শেষ জায়গা ছিল সানা ঘাগড়া। সানা বা সানো বা ছোট ঝর্নার  গতি দেখে ঘোর লেগে গেল। প্রথমে তো দেখি একটা বিনোদন পার্ক। এখানে ঝর্না কোথায়? শিবঠাকুরের মূর্তি বসানো জলাশয়ে বোটিং এর ব্যবস্থা। জলাশয়ের একদিক দিয়ে জঙ্গলের ভিতরে পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা ওঠার পর ঝরঝর আওয়াজে কান পাতা দায়। উল্টোদিকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে একেবারে সানা ঘাগড়ার পায়ের তলায়। বিপুল বেগে জলরাশি কোথা থেকে দৌড়ে এসে ঝরে পড়ছে। তারপর একটু ঝুঁকে দেখি, সে আরো বিপুল বেগে আরো নিচের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোথায় যেন ছুটে চলেছে। বাকরুদ্ধ হয়ে কতক্ষণ যে কেটে গেল। সন্ধে হয়ে এলে বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হলো। আজকের মতো ইতি।

 

দ্বিতীয় দিনে প্রথমেই গেলাম কাঞ্ঝাড়ি জলাধার। পাহাড়ঘেরা এই জলাশয়ের দৃশ্য অপূর্ব। তারপর খণ্ডাধার জলপ্রপাত। বহুদূর থেকেই অতিকায় ঝর্নার ঝরে পড়া দেখা যাচ্ছিল। ঝর্নাটির একদম কাছে পৌঁছে যেতে হলে অনেকগুলো সিঁড়ি পেরোতে হয়। চলার পথের দুধারে কত রকমের গাছ, ফুল আর মাশরুমের মেলা। আর কাছে পৌঁছে তার রূপ দেখে বিভোর হবে না, এটা হতেই পারে না। তার ঝরে পড়া জলের ছিটেয় আমরা ভিজে একশা। এখানে আছে একটি নেচার ক্যাম্প। চারদিক সবুজে সবুজ।

 

 

এরপর তারিণী মন্দিরে পুজো দিলাম। দেবী তারিণী মূলত দেবী চণ্ডী। প্রসাদও পাওয়া গেল। এখন যাত্রা গুণ্ডিচা ঘাগির দিকে। এই ঝর্নাগুলো একে অপরের সঙ্গে দুষ্টুমিতে পাল্লা দিয়ে লড়াই করছে যেন। এর ঝরে পড়ার আওয়াজে নিজেদের মধ্যে কথা বলাই যাচ্ছে না। যারাই ওর কাছাকাছি যাচ্ছে, খিলখিল করে হেসে জল ছিটিয়ে সকলকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। কী তার ব্যাপ্তি বলে বোঝানো মুশকিল। মজা হচ্ছে এই ঝর্নারা সকলেই জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে বসে আছে। এরপর আর এক জংলি দুষ্টু ঝর্না অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য, নাম তার ভীমকুণ্ড। একটা বিশাল এলাকা জুড়ে এর রাজত্ব। বৈতরণী নদীর উৎস। যতদূর চোখ যায়, বিভিন্ন দিক থেকে ভীম বেগে বর্ষার রাঙা জল ছুটে এসে সব ধারা একসঙ্গে হয়ে বয়ে চলেছে আরো দূরে।

 

 

কেওনঝার শহরের মধ্যে আছে শ্রী জগন্নাথদেবের মন্দির। খুব সুন্দর মন্দিরটি। মন্দিরে যাওয়ার পথেই পড়ল কেওনঝার রাজবাড়ি। তৃতীয় দিনে সকালে বেরিয়ে প্রথমে জগন্নাথদেবের মন্দির দেখে চলে গেলাম ময়ূরভঞ্জ জেলার খিচিং-এ। এখানে আছে কিচকেশ্বরী মন্দির। সম্পূর্ণ স্লেট পাথরে তৈরি মন্দিরটি তৈরি করিয়েছিলেন ভঞ্জ রাজারা, প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে। কিচকেশ্বরী মা দুর্গার এক রূপ। ফেরার পথে যখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে, সাদা কাশফুলের সমুদ্রে লালচে রং লেগেছে, সেই সময় হাইওয়ের ধারে জঙ্গল শুরু হওয়ার আগে এক টুকরো ঘাস জমিতে রাজার মতো শুঁড় উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন গজরাজ। পরপর অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়তে তিনি হেলেদুলে জঙ্গলে ঢুকে গেলেন। পুরো বেড়ানোতে বৃষ্টি আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি, কখনও জোরে আবার কখনো বা ধীরে।

 

হাওড়া থেকে বড়বিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস ধরে সোজা বড়বিল। সেখান থেকে গাড়িতে কেওনঝার। এছাড়া পুরীগামী বা দক্ষিণ ভারতগামী যে কোনো ট্রেনে জাজপুর নেমে সেখান থেকে গাড়িতে যেতে পারো কেওনঝার। পর্যটকের থাকার জন্য একমাত্র থাকার জায়গা ওড়িশা পর্যটন উন্নয়ন নিগমের পান্থনিবাস। পান্থনিবাসে জানালে গাড়ির ব্যবস্থা ওরা করে দেন।

 


পাঠকদের মন্তব্য

শ্রীকুমার লাহিড়ী লিখেছেন... ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
ভীমকুন্ড যে বৈতরণী নদীর উৎস এই তথ্য কোথায় পেলেন ?
উত্তরে Admin লিখেছেন... ০১লা মার্চ, ২০২৫
লেখকের জবাব : প্রাপ্তি সূত্র গুগল। এছাড়া ওখানকার গাইডও বলেছেন। আসলে বৈতরণী নামের নদী ভারতবর্ষে অন্তত পাঁচটি পাওয়া যায়। তারমধ্যে মধ্যপ্রদেশের ভীমকুন্ড বেশি বিখ্যাত।

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up