কয়েকটা দিন সমুদ্র-শহর পুরীতে
অজন্তা সিনহা
সমুদ্র দেখার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি যার, দলের সেই কনিষ্ঠ সদস্যটি গাড়িতে খুশি খুশি মুখে উঠে বসতেই শুরু হয়ে গেল আমাদের যাত্রা। গন্তব্য সমুদ্র-শহর পুরী। আপাতত দমদম বিমানবন্দর। ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা সবাই নিশ্চয়ই পুরীর কথা শুনেছ। কেউ কেউ ঘুরেও এসেছ। এবার সেই পুরী বেড়ানোর গল্প। আমরা দলে ছ’জন, যার অন্যতম তোমাদেরই মতো একজন, সেই ঝিলামের কথা তো শুরুতেই বললাম। বাকিরা পরিবার-বন্ধু-স্বজন–দুটি ভিন্ন প্রজন্মের! সে হোক, সকলেই প্রকৃতিপ্রেমী। সমুদ্রের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য উন্মুখ !!
দমদম থেকে ভুবনেশ্বর ! সেখান থেকে গাড়ি করে পুরী! প্রথম দিনটায় সকলেই শ্রান্ত, ক্লান্ত–অতএব লাঞ্চ সেরে বিশ্রাম। ততক্ষণে সমুদ্রতীরে সূর্য প্রায় অস্তগামী। আমাদের হোটেলের ঘরগুলি থেকে দিব্যি সমুদ্র দেখা যায়। দেখলাম সূর্যাস্তের লালিমা ছড়িয়ে পড়ছে আকাশে। আর তার ছায়া পড়েছে সমুদ্রের জলে। ঢেউয়ের রাশি ভেঙে পড়ছে সাগরবেলায়। সব মিলিয়ে সে এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য !! আমাদের খুদে সদস্যটি ইতিমধ্যে সমুদ্র দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। এদিকে বড়রা সকলেই ক্লান্ত। সেও কিছু কম ক্লান্ত নয়। তবে, শিশুর মন, সেখানে খুশি আর আনন্দের উৎস থাকে অফুরান। সেই উৎসাহেই সে ছুটোছুটি করছে হোটেল সংলগ্ন ছোট্ট পার্কে। সাগরের চঞ্চল ঢেউয়ের মতোই সতেজ তার দুষ্টুমি ভরা মুহূর্তগুলি আমাদেরও ভাসিয়ে নিয়ে যায় আবেগের স্রোতে। এরই মধ্যে সূর্য ডুবেছে। অন্ধকার নামছে সমুদ্রের বুকে। আপাতত চা পানের বিরতি। এই অবকাশে কিছু জরুরি তথ্য জানিয়ে দিই তোমাদের।
বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত ওড়িশার পুরী শহরের খ্যাতি সারা বিশ্বে। ওড়িশার রাজধানী ভুবনেশ্বর থেকে ৬০ কিমি দূরের এই শহরের মুখ্য আকর্ষণ একদিকে সমুদ্র, অন্যদিকে জগন্নাথ মন্দির। প্রতি বছর জগন্নাথ মন্দিরে ধুমধাম করে আয়োজিত হয় রথযাত্রা। বর্ণাঢ্য এই ধর্মীয় উৎসব দেখতে হাজির হন সারা বিশ্বের অগণিত মানুষ। পুরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কোনারকের সূর্যমন্দির। তোমরা পুরী গেলে, অবশ্যই একবার সূর্যমন্দির ঘুরে এসো। অপরূপ এর স্থাপত্য কীর্তি, ১৩০০ সালে তৈরি মন্দিরের ঐতিহাসিক মূল্যও অসীম। পুরী থেকে কোনারক যাওয়ার পথটিও ভারি সুন্দর। ঝকঝকে পিচের রাস্তা, দুপাশে জঙ্গল, একটি নদীও দেখতে পাবে। আর আছে চন্দ্রভাগা বিচ, কোনারক থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে, পুরী থেকে কোনারক যাওয়ার পথেই পড়ে। নির্জন এই বিচে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের নীল জলরাশি দেখার অভিজ্ঞতা অতি মনোরম।
ফিরে আসি পুরীর কথায়। প্রথম দিনটা আলস্যে কাটানোর পরদিন বিকেলের দিকে আমরা চললাম সমুদ্রের পাড়ে। সেখানে তখন মানুষের মেলা, দোকানপাট, নাগরদোলা, চালকের হাতে বাঁধা দড়িতে ধীরগতি উটের ইতস্তত বিচরণ–সে বেশ আনন্দময় এক পরিবেশ !! আমাদের ডানদিকে সমুদ্র আর বাঁদিকে সারি সারি হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিং মল। সর্বত্র ভিড় আর যানজট। সেইসব এড়িয়ে আমরা অপেক্ষাকৃত নির্জন একটি অঞ্চলে গিয়ে পকোড়া সহযোগে চা খেলাম। তারপর কিছুটা শপিং সেরে হোটেলে ফেরা। এরপর কিছুক্ষণ আলস্যে কাটিয়ে ডিনারে গেলাম আমরা। ডিনার শেষে যে যার ঘরে।
পরদিন বিকেলে গেলাম সামান্য দূরের অপেক্ষাকৃত নির্জন গোল্ডেন বিচে। টিকিট কেটে ঢোকার ব্যবস্থা। জোয়ারের সময়, বিশাল বিশাল ঢেউ ভাঙছে !! গোল্ডেন বিচে দোকানপাট নেই। পরিচ্ছন্ন বালুকাবেলায় ঘুরে বেড়াতে বেশ লাগছিল। আর ঠিক তখনই অস্তগামী সূর্য তার সবটুকু রঙ ঢেলে দিলো চরাচর জুড়ে। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। সঙ্গে চলল ফটো সেশন! খুদে সদস্যটির আনন্দ দেখে কে ! সকালেই রোদ্দুর মেখে হোটেলের সামনের বিচে বালির দুর্গ গড়েছে সে। কিন্তু ক্লান্তি নেই। বিকেলে সমান উত্তেজনায় বিচে লাফালাফি করতে করতে ঢেউয়ের নাচন দেখছে। যাবতীয় উচ্ছ্বাস-আনন্দ ক্যামেরাবন্দি করে হোটেলে ফিরলাম আমরা।
পরদিন সকালে গেলাম মোহনা। এটি হলো ধোউদিয়া নদী আর বঙ্গোপসাগরের সঙ্গমস্থল। জায়গাটায় অসীম নির্জনতা। নদীর পাড়ে বাঁধা নৌকাটি যেন পালে হাওয়া লাগার অপেক্ষায়। নদীর ওপরে ব্রিজ তৈরি হচ্ছে। কাজ চলছে জোর কদমে। শান্ত নদীর বুকে তারই অনুরণন !! কিছুক্ষণ নিবিড় নির্জনতা উপভোগ করে হোটেলে ফিরে এলাম। পরদিন আমাদের ফেরার পালা। বিকেলে হোটেলের ঘর থেকেই সমুদ্রকে বিদায় জানাই। শেষবারের মতো শুনি ঢেউভাঙার গান। পুরীতে ট্রেনে, ফ্লাইটে এবং গাড়িতে যাওয়া যায়। ফ্লাইটে ভুবনেশ্বর হয়ে যাওয়া। ট্রেনে গেলে সরাসরি পুরী স্টেশন। হাওড়া থেকে প্রচুর ট্রেন যায় পুরীতে। গাড়ির রাস্তা এমনিতে বেশ ভালো। তবে, অনেকটা সময় লাগে বলে কষ্টসাধ্য। সবদিক থেকে ট্রেনে যাওয়াই সবচেয়ে আরামের। সারা বছরই পুরী যেতে পারো। আর থাকার জন্য রয়েছে অজস্র হোটেল। সমুদ্রের সান্নিধ্যে কয়েকদিন কাটাতে চাইলে সুযোগ পেলে ঘুরে আসতে পারো শ্রীক্ষেত্র পুরীতে।
পাঠকদের মন্তব্য
250