কমলা বাগানে দুটি দিন
অজন্তা সিনহা
দুপাশে চা বাগান, জঙ্গল–সেখানে শাল, পাইন, সেগুন, ইউক্যালিপটাস থেকে চেনা বাঁশঝাড়, কিছুই বাদ নেই। সে এক অপূর্ব সবুজের উৎসব ! সেইসব দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম রিয়াং নদীর পারে। খরস্রোতা রিয়াং সেই সময় প্রায় জলহীন। শুনলাম বর্ষায় একেবারে টইটুম্বুর থাকে এই নদী। তখনও ব্রিজ তৈরি হয়নি রিয়াংয়ের ওপরে। এখন অবশ্য বিশাল ব্রিজ তার ওপরে। ফিরে আসি সেদিনের কথায়। ব্রিজ নেই, তাহলে, কীভাবে নদী পার হবো ? আমাদের এই ভাবনার মধ্যেই ড্রাইভার ভাই গাড়ি নিয়ে সটান নদীর বুকে। বড় বড় বোল্ডারের পাশ কাটিয়ে আমাদের গাড়ি রিয়াং পার হলো।
গন্তব্য কমলা গ্রাম সিটং-এ। কমলালেবু চাষ থেকে এহেন কমলা গ্রাম খেতাব। তোমাদের প্রিয় দার্জিলিংয়ের কমলালেবুর অনেকটাই এই উত্তরবঙ্গের সিটং থেকে মেলে। যেতে যেতে দেখলাম খোলা আকাশের নিচে ছড়ানো প্রান্তরে কমলা শুকোনো হচ্ছে রোদে। গ্রামের লোকজন ব্যস্ত কাজে। ড্রাইভার ভাইয়ের পরিচিত অঞ্চল। সে গাড়ি থামাতেই একজন গ্রামবাসী মিষ্টি হেসে আমার হাতে কয়েকটি লেবু তুলে দিলেন। কী মিষ্টি যে তার স্বাদ ! শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়ং হয়ে যেতে হয় সিটং। গ্রামে ঢোকার মুখেই রিয়াং অবস্থিত। নদী পার হয়ে পাহাড়ী পথ ধরলাম আমরা। আবারও কিছু চড়াই-উৎরাই আর প্রচুর হেয়ারপিন বেন্ড। অবশেষে একটা সময় গাড়ি এসে থামল হোমস্টে-র দরজায়। বাতাসে ততক্ষণে হিমেল আমেজে কাঁপন ধরিয়েছে। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে।
দুপুর গড়ালেও লাঞ্চ করতে হবে। খুব খিদে পেয়েছে। পথের ধুলো কাটাতে গরম জলে হাত-মুখ ধুলাম। কিচেনে রেডি ছিল ভাত, ডাল, অমলেট, আলু ভাজা, পাঁপড় আর আচার। লাঞ্চ সেরে বেতের আসবাবে খুব সুন্দর করে সাজানো বসবার ঘরে বসলাম আমরা। কথায় কথায় কিছুটা সময় পার হলো। হোমস্টে-র মালিক এরপর ছাদে নিয়ে গেলেন আমাদের। সেখান থেকে দেখলাম অপরূপ সূর্যাস্ত। সিটং আদতে একটি উপত্যকা। আর বেশ কয়েকটি ছোট ছোট গ্রামের সমষ্টি–যা আপার ও লোয়ার সিটং, দু’ভাগে বিভক্ত। আমাদের হোমস্টে লোয়ার সিটং-এ। শেষ সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়ছিল, সুউচ্চ পর্বতশ্রেণিতে ঘেরা সামনের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। হোমস্টে-র ছাদ থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখলাম সেই অতুলনীয় দৃশ্য !
সন্ধ্যায় কফি ও জমজমাট আড্ডা। ঠাণ্ডা পড়েছে জাঁকিয়ে। সিটং-এর উচ্চতা ৪০০০ ফুট। যদিও, সেই অনুপাতে ঠাণ্ডা বেশি। কারণ, অনেকটাই খোলা প্রান্তর চারপাশে। অগত্যা ডিনার সেরে তাড়াতাড়ি কম্বলের নিচে আশ্রয় নিলাম। সন্ধ্যা নামতেই আকাশে দর্শন দিয়েছিল রুপোলি চাঁদ। রাতে জোৎস্না মেখে নিয়েছিল আকাশ। পাহাড়ে প্রকৃতি তার নিজের রূপ-রস-গন্ধে এমনিতেই অপরূপ। কিন্তু পূর্ণিমার এই রাত এককথায় ছিল অনির্বচনীয়। রূপকথার সেই রাতে ঘুম নামতে দেরি হলো না চোখে।
পরদিন গরমাগরম রুটি-সবজি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম দেখতে। এখানে প্রায় সবার বাড়িতেই রয়েছে কমলালেবুর বাগান। নানা সাইজের কমলালেবু ঝুলছে গাছে। ছোট্টো বন্ধুরা বুঝতেই পারছ, গাছের ডালে কমলালেবু ঝুলতে দেখে কতখানি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম আমরা ! হোমস্টে-র পাশেই রয়েছে এক অতি প্রাচীন গির্জা। এছাড়াও আপার সিটং-এ আছে একটি গুম্ফা। এরও বয়স অনেক। অঞ্চলটিতে রয়েছে ছোটো-বড়ো কয়েকটি ঝর্না। সিটং-কে ঘিরে শুধু কমলালেবু নয়, আছে ট্রেকিং, বার্ড ওয়াচিং ইত্যাদি আকর্ষণ। সবার ওপরে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন। এখানে তিনি অনেকটা বিস্তারে দৃশ্যমান। প্রকৃতি এখানে অতি মনোরম। প্রায় সকলেরই বাড়ির লাগোয়া কিছু জমি আছে। সামনে ফুলের বাগান। পিছনে ফসলের ক্ষেত। বাড়িগুলিও সমতলে নয়, পাহাড়ের ধাপে। সব মিলিয়ে বড়ই দৃষ্টিনন্দন।
দু'দিনের সিটং বাস ভুলবো না। বিশেষত সেই জোৎস্নাময়ী রাত। ফেরার পথে আবার দেখা রিয়াং-এর সঙ্গে। বিদায়কালে সে যেন সামান্য ভারাক্রান্ত। উদাসীন রিয়াং-কে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল আমাদের গাড়ি। বেলা গড়াচ্ছে। রোদ্দুর ছড়িয়েছে পাহাড়ের পথে-প্রান্তরে। বাঁক ঘুরে ঘুরে চলেছি আমরা । তোমাদের জন্য সুখবর, এখন বেশ কয়েকটি হোমস্টে হয়েছে সিটং-এ। রিয়াং-এর ওপরে ব্রিজ হয়ে যাওয়ায় গাড়ি চলাচলের সুবিধা বেড়েছে। ইন্টারনেটেও স্থান করে নিয়েছে সিটং সংক্রান্ত যাবতীয় খবরাখবর। সুযোগ পেলেই ট্রেনের টিকিট কেটে বেরিয়ে পড়ো ব্যাগপত্তর নিয়ে। সিটং-এর কমলালেবুর বাগান রয়েছে তোমাদেরই অপেক্ষায়।
পাঠকদের মন্তব্য
250