টয় ট্রেন চড়ে টুং স্টেশন হয়ে পৌঁছে গেলাম দিলারাম
মৃণালিনী ঠাকুর
শিলিগুড়ি থেকে টয় ট্রেনে যাওয়া হবে শুনেই জিতু ভাই বললেন, আপনারা তাহলে টুং স্টেশনে নামুন। জিতু ভাই হলেন, আমরা যে হোমস্টে-তে থাকব, তার পরিচালক। টুং–নামটা শুনলেই কেমন মন ভালো হয়ে যায়, তাই না ? আমাদেরও হলো। আমরা এক লহমায় তোমাদের মতো ছোটো হয়ে গেলাম। এক সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে আমাদের খেলনা রেলগাড়ি ছাড়ল–যাবে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে ধরে। ছোট লাইন, রেলগাড়িও ছোট। তাই তো এর নাম টয় ট্রেন ! তবে, তোমরা গেলে, কার্শিয়াং পর্যন্ত গাড়িতেও যেতে পারো। যে শহর থেকেই আসো, ট্রেনে বা প্লেনে, প্রথমে শিলিগুড়ি পৌঁছতে হবে। ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। প্লেনে এলে বাগডোগরা এয়ারপোর্ট। এই সবগুলো জায়গা থেকেই কার্শিয়াং যাওয়ার গাড়ি পাওয়া যায়।
আমরা টয় ট্রেনে টুং স্টেশনে নামার পর, সেখান থেকে কেটল ভ্যালি হোমস্টে-র গাড়ি আমাদের নিয়ে গেল হোমস্টে-তে। শান্ত, নির্জন পাহাড়ী গ্রাম, নাম দিলারাম। হোমস্টে-র আশপাশে যতদূর চোখ যায়, প্রকৃতির অসীম রূপমাধুরী ছড়ানো পাহাড়, চা বাগান, গাছগাছালি আর ছোট ছোট বাড়িঘরের মধ্যে। এখান থেকে ৩৬০ ডিগ্রির চমৎকার ভিউ মেলে। আমাদের পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়েছিল। তাই ফ্রেশ হয়ে কফি আর স্ন্যাকস অর্থাৎ পকোড়া খেলাম। ততক্ষণে অন্ধকার নেমেছে চরাচর জুড়ে। পাখির দল বাসায় ফিরে এসেছে। গাছে গাছে শোনা যাচ্ছে তাদের কিচিরমিচির। ডিনারে রুটি চিকেন খেয়ে কম্বলের আশ্রয়ে যখন ঢুকলাম, তখন ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। জমিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। ক্লান্তও ছিলাম। অতএব দেরি না করে, অচিরেই যাত্রা ঘুমের দেশে।
কেটল ভ্যালি হোমস্টে-তে রয়েছে ২টি ঘর। জিতু ভাইয়ের কথা তো আগেই বলেছি। তাঁরই তত্ত্বাবধানে রমা আর সারিকা নামের দুই পাহাড়ী তরুণী হোমস্টে চালান। দিবারাত্রি পরিশ্রম করে ঘরগুলি ঝকঝকে তকতকে করে রাখেন ওঁরা। এলাকাটি শহর থেকে কিছুটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ায় বাজারহাট দূরে। তাই খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে এঁরা নিজেদের ক্ষেত, পোলট্রি ইত্যাদির ওপর অধিক নির্ভরশীল। রান্না মূলত এলাকার নেপালি স্টাইলে আর দারুণ সুস্বাদু। পরদিন সকালে পুরি, সবজি, অমলেট সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সাইট সিয়িংয়ে। কার্শিয়াং, দার্জিলিং দুইই এখান থেকে কাছে। কমলালেবু চাষের জন্য বিখ্যাত সিটংও যাওয়া যায় সহজেই। আমরা কার্শিয়াং যাব, আগেই ঠিক হয়ে ছিল। মজার ব্যাপার হলো মেন রোডে আসতেই। আমরা চলেছি গাড়িতে, আর পাশ দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর টয় ট্রেন চলেছে বাঁশি বাজিয়ে।
কার্শিয়াংয়ে আমরা ঘুরে দেখলাম হনুমান চক, বেল্টার ওয়াটার কিংডম, ডাউহিল ফরেস্ট, চিমনি ইত্যাদি। সারা পথেই যেদিকে চাও উঁচু উঁচু পর্বতশ্রেণী আর আকাশ ছোঁয়া পাইনের সারি। মাঝে মাঝে কুয়াশা ঘন হয়ে পাইনের ছায়াকে গাঢ় করে তুলছে। আবার একটু পরেই উঁকি মারছে সূর্যের আলো। একদিকে প্রকৃতির বুকে আলোছায়ার খেলা। অন্যদিকে ব্যস্ত কার্শিয়াং শহর। দোকানপাট, মানুষ আর গাড়ির ভিড়। কার্শিয়াংয়ের মার্গারেট ডেকে লাঞ্চ করে হোমস্টে-তে ফিরে এলাম আমরা। সামান্য বিশ্রাম। আকাশ মেঘলা, আসন্ন বৃষ্টির ইঙ্গিত বয়ে আনে ঠান্ডা, ভিজে বাতাস। সন্ধ্যায় চা আর চিকেন পকোড়া খেয়ে ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ব্যালকনিতে বসে অন্ধকার প্রকৃতি দেখি কিছুক্ষণ। আমাদের ফেরা কালই। সন্ধ্যার এই রূপ যেন বিষন্নতা মাখানো। রাত বাড়লে ডিনার করে ঘুমের দেশে গমন। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে ফেরার গাড়িতে উঠলাম, ছোট্ট গ্রাম দিলারামের স্মৃতি মনের মণিকোঠায় সঞ্চয় করে।
পাঠকদের মন্তব্য
250