ছোটোদের চাঁদের হাসি / হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা / জুন ২০২৪

অপরূপ অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির

 

সে এক প্রখর রোদ্দুরমাখা দিন। একটি দিনের জন্য অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির ঘুরে দেখার সুযোগ এসেছে কর্মসূত্রে। সাংবাদিকদের এক বিরাট টিম আমরা, কলকাতা ও দেশের অন্যান্য শহর থেকে এসেছি এখানে। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে পৌঁছতে ঘেমে নেয়ে অস্থির সবাই !! যাই হোক, পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরে কিছুটা শান্তি। এরপর কিছুক্ষণ যে যার ঘরে। ক্ষণিক বিশ্রামের পর সবাই মিলে রেডি হয়ে চললাম শিখ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান গুরুদ্বার স্বর্ণমন্দিরের পথে। মনে মনে আমরা সকলেই তখন দারুণ এক্সাইটেড !! অস্তগামী সূর্য যাওয়ার আগে শেষবারের মতো উত্তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বুকে। তাতে কী, আমাদের উৎসাহে ঘাটতি নেই।

 

অমৃতসরের পথ দিয়ে সার বেঁধে চলেছে আমাদের কয়েকটি গাড়ি। প্রাচীন শহরের শরীরে এখন আধুনিকতার ছোঁয়া। সেই ছোঁয়া অবশ্য মুছে ফেলতে পারেনি তার ইতিহাস। বহুতল বাড়ি, শপিং মলের পাশাপাশি এদিক ওদিক ছড়ানো পুরোনো বাড়িঘর, মহল্লা, দোকানপাট ইত্যাদি। পাঞ্জাবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই শহরে মূলত শিখ ধর্মাবলম্বীদের বসবাস। বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবেও যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য এই শহর। তবে, অমৃতসরের প্রধান আকর্ষণ নিঃসন্দেহে স্বর্ণমন্দির। আমাদের গাড়িগুলি ইতিমধ্যে রাজপথ ছেড়ে একটি অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ রাস্তা ধরেছে। দুপাশে দোকানপাটে ব্যস্ত জীবন। ড্রাইভার ভাই জানালেন, পৌঁছতে আরও মিনিট পনের লাগবে। এই অবকাশে সংক্ষেপে জানিয়ে দিই স্বর্ণমন্দিরের ইতিহাস।

 

 

 

ষোড়শ শতাব্দীতে চতুর্থ শিখ-গুরু গুরু রামদাস সাহিব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির। প্রসঙ্গত, স্বর্ণমন্দির হরমন্দির সাহিব (ঈশ্বরের ঘর বা উন্নত আদালত) নামেও পরিচিত। মন্দিরের অভ্যন্তরে রয়েছে উপাসনা গৃহ। এছাড়াও রক্ষিত শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থসাহিব, যা শিখ গুরুদের রচনার সংকলন। নির্মাণের দুই শতাব্দী পর ১৮৩০ সালে রাজা রঞ্জিত সিংহ এই মন্দিরের উপরিস্থিত অংশ ১৬২ কেজি সোনা দিয়ে মুড়ে দেন, তখনই ওই সোনার মূল্য ৬৫ লক্ষ টাকা। এরপর ১৯৯০ সালে ৫০০ কেজি সোনা দিয়ে সেই অংশটিকে পুনরায় আবরিত করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দক্ষ শিল্পীদের দ্বারা তৈরি স্বর্ণমন্দিরের শিল্প সৌকর্য এককথায় অতুলনীয়! এটি ইন্দো-ইসলামিক, মুঘল এবং রাজপুত স্থাপত্য দ্বারা প্রভাবিত। ভবনটি দ্বিতল কাঠামো বিশিষ্ট, যার নিচের স্তরটি মার্বেল দিয়ে তৈরি এবং উপরের স্তর সোনার চাদর দিয়ে আবৃত।

 

প্রতিদিন যে পরিমাণ দর্শক স্বর্ণমন্দির দর্শনে আসেন, তার সংখ্যা অকল্পনীয় এবং তাঁরা আসেন সারা বিশ্ব থেকে। বলতে দ্বিধা করব না, এই অগণিত মানুষের আকর্ষণের কারণ বুঝতে একটুও দেরি হলো না। ততক্ষণে আমরা পৌঁছে গেছি মন্দিরের প্রবেশদ্বারে। আর প্রবেশ মাত্র চমৎকৃত হই মন্দিরের অপরিসীম সৌন্দর্য, পরিচ্ছন্নতা, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি দেখে। ঢোকার মুখেই জুতো রাখার জায়গা। স্বেচ্ছাসেবীগণ ব্যস্ত সেখানে, তাঁরাই আমাদের জুতো রেখে টোকেন দেন। যেহেতু অগণিত দর্শনার্থী, তাই এহেন ব্যবস্থা। যেতে যেতে প্রত্যেকে নিজেদের মাথা ঢেকে নিলাম। মেয়েরা শাড়ির আঁচল বা দোপাট্টা দিয়ে, ছেলেরা রুমালে। বলা বাহুল্য, এ হলো গুরু গ্রন্থসাহিবকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের একটি অঙ্গ।

 

 

 

আমাদের সামনে পিছনে অনেক মানুষ। কিন্তু কোনও বিশৃঙ্খলা নেই। কিছুটা দূর থেকে ভেসে আসছে অপূর্ব ভজনসঙ্গীত, যা পুরো পরিবেশটাকেই মনোরম করে তুলেছে। প্রসঙ্গত, গুরুদ্বারে প্রবেশপথ হলো মোট চারটি। এই চারটি প্রবেশপথের প্রতীকী অর্থ হলো শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষের সর্ব ধর্ম সমন্বয়ে বিশ্বাসের বার্তা। ভিতরের অংশ বর্গাকার, যার প্রায় মাঝখানে একটি পুল বা সরোবর, নাম অমৃত সরোবর। সুন্দরভাবে বাঁধানো এই সরোবরের স্ফটিক-স্বচ্ছ জলে খেলা করছে বিশাল আকৃতির এক একটি রঙিন মাছ। সরোবরের কিনারায় দাঁড়ালেই মাছের দল ছুটে আসে আর তাদের টুকটাক খাবার দিলে চঞ্চল জলকেলি করে বুঝিয়ে দেয় নিজেদের খুশি। এই সরোবরকে ঘিরেই রয়েছে পরিক্রমা পথ, যেখানে যথা নিয়মে পরিক্রমা করছেন শিখ ভক্তবৃন্দ।

 

বিভিন্ন ভবনে বিভিন্ন কাজের ব্যস্ততা চলছে। দর্শনার্থীরা সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে একে একে প্রবেশ করছে বিভিন্ন ভবনে। মূল উপাসনাগৃহটি (অকাল তখত) অপূর্ব সাজে সজ্জিত। এটি প্রতিষ্ঠা করেন গুরু হরগোবিন্দ। তখতটি মূল গর্ভগৃহের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। ভক্ত শিল্পীবৃন্দ এখানে বসেই গাইছেন ভজনসঙ্গীত, যা তখন আরও জোরালো। জোরালো কিন্তু মধুর এবং গুরুগম্ভীর। উপাসনাগৃহ প্রদক্ষিণ করে আমরা গেলাম প্রসাদ যেখানে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে। সম্পূর্ণ ঘিয়ে তৈরি ওই সুস্বাদু সুজির হালুয়ার স্বাদ যেন আজও মুখে লেখে আছে। আমাদের টিমের অনেকেই দ্বিতীয়বার লাইনে দাঁড়িয়ে প্রসাদ নিলেন শিশুর আনন্দে।

 

 

 

প্রসাদ পাওয়ার পর পুরো মন্দির চত্বর ঘুরে ঘুরে দেখলাম আমরা। বিস্ময়ে মুগ্ধ হলাম এখানকার ক্লক টাওয়ারটি দেখে। এটি অবশ্য ঘন্টা ঘর নামেও পরিচিত। অমৃত সরোবরের পূর্ব দিকে রয়েছে একটি বেরি ট্রি (জামের মতো রসাল ফল) গাছ, যা অলৌকিক ও পবিত্র বলে মনে করা হয়। লোকমুখে এটি ‘দুখ ভঞ্জনি বেরি ট্রি‘ বলে খ্যাত। শোনা যায় এর বয়স ৪০০ বছর। বেশ আকর্ষণীয় ‘শিখ ইতিহাস জাদুঘর’। শিখ ধর্মের উন্নতিতে অবদান রাখা বিশিষ্ট শিখ নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলি প্রদর্শনের জন্য কেন্দ্রীয় জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। সংগ্রহে রয়েছে মুদ্রা, পুরাতন অস্ত্র এবং পাণ্ডুলিপি। এছাড়াও রয়েছে তারের তৈরি কাঠের চিরুনি এবং লোহার জ্যাকেট ইত্যাদি।

 

ভিতরে একটি লঙ্গরখানাও রয়েছে দেখলাম। শুনলাম, সেখানে প্রতিদিন খাদ্য গ্রহণ করেন অগণিত মানুষ। এর অসাধারণ দিকটি হলো, লঙ্গরখানার খাবার তৈরি করেন এখানকারই নারী-পুরুষ মিলে, এমনকী বাচ্চারাও এই কর্মযজ্ঞে সামিল হয়। এই লঙ্গরখানার বিভিন্ন কাজে বাইরে থেকে কোনও সাহায্য নেওয়া হয় না। মন্দিরের আশপাশের মানুষ, এমনকী দর্শনার্থীরাও এখানে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে মানুষের সেবা করেন। কথিত আছে, মুঘল সম্রাট আকবরও এই লঙ্গরখানায় এসে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বসে খাদ্য গ্রহণ করেছিলেন।

 

আমাদের ফেরার সময় হয়ে যায়। সূর্য তখন সম্পূর্ণ অস্তাচলে। তবে, আকাশ এখনও আলোকময়। গোধূলির রঙ মেখে নিয়েছে স্বর্ণমন্দিরের চূড়া। সে এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। মন্দিরে প্রবেশ অবাধ, কোনও টিকিট নেই। শুধু শিখ সম্প্রদায় নন, যে কোনও ধর্ম-জাতির মানুষ এখানে প্রবেশের অধিকার পান। ভোর ৫ টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মন্দিরের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত। অমৃতসর এয়ারপোর্ট থেকে মন্দিরের দুরত্ব ১৩ কিমি। অমৃতসর স্টেশনের দূরত্ব অবশ্য একেবারেই কম, ২ কিমি মাত্র। দেশের সমস্ত প্রান্ত থেকে অমৃতসর যাওয়ার ফ্লাইট ও ট্রেন পরিষেবা রয়েছে। অমৃতসর যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো অক্টোবর থেকে মার্চ।

 

 

 


পাঠকদের মন্তব্য

Susmita sur লিখেছেন... ০৯ই জুন, ২০২৪
Khub i bhalo laglo lekhata
উত্তরে Admin লিখেছেন... ১২ই জুন, ২০২৪
ধন্যবাদ

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up