ইতিহাসের সাক্ষী পেডং
অজন্তা সিনহা
প্রাচীন গির্জা ও গুম্ফা, দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আর পাহাড়-নদী-জঙ্গলে আকীর্ণ উত্তরবঙ্গের পাহাড়ী জনপদ পেডং। একবার শীতের ছুটিতে সেখানেই কাটানোর মনোরম অভিজ্ঞতার গল্প এবার তোমাদের জন্য। বছরের শেষ। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামতেই হিমেল হাওয়া কাঁপিয়ে দিলো। গাড়ি ঠিক করাই ছিল। এবার যাত্রা শুরু। প্রথমে কালিম্পং, সেখান থেকে আর একটু দূরে আমার গন্তব্য পেডং। শিলিগুড়ি শহর ছাড়িয়ে সেবক রোড ধরে কিছুটা এগোবার পর মহানন্দা রেঞ্জ। দুপাশে জঙ্গলকে ফেলে এগিয়ে যাই। সামনে তিস্তা নদী। দূরে পাহাড়ের সারি। ক্রমশ পরিষ্কার ওদের উঁচুনিচু চূড়া। আকাশে রবিন ব্লু সামিয়ানা, পেঁজা তুলোর ডিজাইনে ছুটির কাব্যগাথা। পথ আপাতত চড়াইগামী। তিস্তাকে পাশে রেখে পথ এগিয়ে গিয়েছে। কিছুদূর যাওয়ার পর করোনেশন ব্রিজ, যার স্থানীয় নাম বাঘপুল। এখানে একটা ছোট্ট মোড়। সেই মোড় পিছনে রেখে আমাদের গাড়ি আরও উর্দ্ধে, সোজা রাস্তায়।
আরও কিছুটা চড়াই-উৎরাই পার করে গাড়ি এসে দাঁড়ালো এক মোমোর দোকানের সামনে। ব্রেকফাস্ট সারা হলো এখানেই। সঙ্গে কফি । ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত শরীর আবার চনমনে। এখান থেকে কালিম্পং আরও প্রায় ঘন্টা দেড়েক। দেরি না করে রওনা দিই। একটু এগিয়ে তিস্তা বাজার। এখানে আর একটি ব্রিজ। তিস্তার ওপরের এই ব্রিজ পার হয়ে চলে এলাম আর এক পাহাড়ে। তিস্তা এখন বাঁদিকে। এভাবেই নদী, জঙ্গল, পাহাড়ের শোভা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম কালিম্পং। বেশ জমজমাট কালিম্পং থেকে অপেক্ষাকৃত নির্জন আলগড়া হয়ে পৌঁছে গেলাম পেডং। আর পৌঁছেই মন্ত্রমুগ্ধ। চারপাশে যতদূর চোখ যায়, শুধুই পাহাড়।
প্রথম দর্শনেই বড় আপন মনে হলো ছোট্ট এই পার্বত্য অঞ্চল। হোম স্টে-র লাল রঙা বাড়িটি একেবারে সিকিম সীমানায়। বাড়িটার পর থেকেই ধাপে ধাপে পাহাড়শ্রেণী। আর এগুলি সবই সিকিমের অন্তর্গত। দুপুর গড়িয়েছিল। অতএব লাঞ্চ সেরে নেওয়ার পালা। হোম স্টে-র মালিক পূর্ণ তামাংয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। ওঁর সুন্দর ব্যবহার, সুস্বাদু রান্না আর পরিচ্ছন্ন পরিবেশনার গুণে খুব দ্রুত আত্মীয়তা গড়ে উঠল পেডং-এর সঙ্গে। খাওয়ার পর ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই প্রকৃতি যেন দু’বাহু বাড়িয়ে দিলো।
পৌঁছনোর দিনটা আশপাশে হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম। রাস্তার বেশিরভাগটাই চড়াই-উৎরাই। দু'পাশে বাড়িঘর, হালকা গাছপালা রেখে পথ গিয়েছে এঁকেবেঁকে। মানুষজনের মুখোমুখি হলেই একগাল হাসি। যেন কতদিনের চেনা ! সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরি। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই তাপমাত্রা কমছে। ওনিয়ন পকোড়া আর চা খেতে খেতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। দূরের পাহাড়ে ঝিকিমিকি জ্বলছে আতসবাজির রোশনাই। পূর্ণজি জানালেন, ওগুলো সিকিম মনিপালের আলো।
ডিনারের আগে হাতে কিছুটা সময়। এই অবকাশে পেডং সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ঐতিহাসিক ভাবে এর আকর্ষণ তুলনাহীন। অতি প্রাচীন সিল্ক রুটের সব থেকে পুরোনো গেটওয়ে পেডং। ঐতিহাসিক সিল্ক রুট ভারতকে লাসার সঙ্গে যুক্ত করেছে পেডং নিকটস্থ জিলাপি লা পাসের মাধ্যমে। কালিম্পং থেকে ২০ কিমি দূরত্বে অবস্থিত পেডং পড়ে লাভা যাওয়ার পথে। উচ্চতা ৪০৭১ ফুট। পুরো শহরটি দুভাগে বিভক্ত, আপার ও লোয়ার পেডং। আগেই বলেছি গির্জা, গুমফা, দুর্গের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদি নিয়ে পেডং দাঁড়িয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এবার পরপর সেইসব দর্শন।
পরদিন বেশ ভোরে উঠে বেরিয়ে পড়লাম। তখন সবে ঘুম ভাঙছে ছোট্ট এই জনপদের। রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের প্রতি কোনায়। হোম স্টে থেকে বেরিয়ে ডানদিকে ক্রশহিল পয়েন্টে গেছে এই পথ। রাস্তার বাঁদিকের পাহাড়গুলি তত উঁচু নয়। খাঁজে খাঁজে ছোট ছোট বাড়ি, সামনে ফুলের বাগান। ডানদিকটায় শুধুই পাহাড়। নানা রঙের শেড তাদের, কোথাও ধূসর, কোথাও শ্যাওলা পড়ে সবুজের আভা। পথ চলার মুডে অনেকক্ষণ সামনে দেখিনি। আচমকাই চোখ চলে যায় সেদিকে। আর তারপরই চমক। অনেকটা দূরে ওটা কি !
কাঞ্চনজঙ্ঘা এখানে দৃশ্যমান জানতাম। তবু, দেখার পর বিস্ময়ে অভিভূত হই। দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে যাই, পৌঁছতে হবে ক্রশহিল পয়েন্টে। জানি, রোদ চড়া হলেই হারিয়ে যাবে ওই শুভ্র শৃঙ্গ। ক্রশহিল পয়েন্ট শুনসান। বাঁদিকে পাহাড়ের ওপরে গির্জা। সামনে যীশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি, যা দেখলে আপনা থেকেই মাথা নত হয়। ক্রশহিল পয়েন্ট চার্চ নামের এই গির্জার প্রতিষ্ঠা করেন ফাদার অগাস্তে দেগোদাঁ, ১৮৮২ সালে। গির্জার সূত্রেই জায়গার নামকরণ। ততক্ষণে সূর্য আরো একটু প্রকাশিত। সোনালি রোদ্দুরের ছিটে গাছের পাতায়, পাথরের খাঁজে। ঝকঝকে আকাশ। আবহে পাখির কূজন। আর সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা। এমন অনির্বচনীয় প্রভাত রোজ রোজ আসে না।
এখান থেকে পথ বাঁদিকে ঠিক নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছে, ঘুরেছে এবং নেমেছে, সোজা পৌঁছেছে কাশ্যম জঙ্গল ও গ্রামে। জঙ্গলের নামেই গ্রাম। এখানে বসবাস করে লেপচা উপজাতির শেষ পরিবারটি। ওঁদের বাড়িটিও ওই ঘরানার শেষ নিদর্শন। রাস্তা থেকে অনেকটা নিচে নেমে বাড়ি। মাটির বাড়ি, উপরে খড়ের চাল। হেরিটেজ তকমা প্রাপ্ত এই বাড়ির শরীর জুড়ে প্রাচীন ইতিহাস, যা দুর্মূল্য ও দৃষ্টিনন্দন। কাশ্যম জঙ্গলে প্রচুর ওষধি গাছ রয়েছে, যার খোঁজে পড়ুয়া ও গবেষকরা প্রায়ই আসেন। কালিম্পং জেলার অন্তর্গত পেডং ফুল ও অর্কিডের স্বর্গ। পথে চলতে চলতে সেসব ঘুরেফিরেই নজর কেড়ে নেয় পর্যটকের।
লাঞ্চের পর গেলাম এখানকার বহু প্রাচীন বৌদ্ধ গুমফা দর্শনে। এটিও ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। প্রতিষ্ঠাকাল ১৭০০ সাল। নাম সানচেন দোরজি মনাস্ট্রি। তখনও পুরোনো ভবনেই ছিল এই প্রাচীন গুমফা। রাস্তা থেকে অনেকটা ওপরে উঠে গেছে পাথরের সিঁড়ি। দু'টি তলের ওপরের অংশে অধিষ্ঠিত বুদ্ধের মূর্তি। সামনে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। দেওয়ালে প্রচুর ফ্রেসকো পেন্টিং, সংগ্রহ দেখবার মতো, সংখ্যায় ৩০০-র কাছাকাছি। এদিক-ওদিক কাজে ব্যস্ত নানা বয়সের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীগণ। এঁরা এখানে প্রার্থনা ও পঠনপাঠন করেন। সঙ্গে জীবনযাপনের বাকি কাজগুলিও। এখন অবশ্য নতুন ভবন তৈরি হয়েছে। পরের বার গিয়ে সেটিও দেখলাম। ছড়ানো বিস্তৃত বাড়িটির সর্বত্র শান্ত ও সমাহিত পরিবেশ। সেখানেও দেখি নানা কাজে ব্যস্ত বিভিন্ন বয়সের বৌদ্ধ সন্ন্যাসী–বালক থেকে প্রবীণ।
গুমফার পর দুর্গ। ঐতিহাসিক ড্যামসাং ফোর্ট। একদা ড্যামসাং উপত্যকা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলকে ঘিরেই গড়ে ওঠে দেশের প্রথম চা শিল্প। পেডং তথা কালিম্পং-এর মাটি ও আবহাওয়া ছিল চা উৎপাদনের সম্পূর্ণ উপযোগী। এদেশে ব্রিটিশ শাসনের অনেক আগেই চৈনিক চা ব্যবসায়ীরা চিন দেশ থেকে সিল্করুটের মাধ্যমে চা পাতা আমদানি করত এখানকার ধনী ও সৌখিন চা-প্রেমীদের জন্য। এই আমদানীর ব্যাপারটা অত্যন্ত খরচ ও সময়সাপেক্ষ হওয়ায়, একসময় এরা চা উৎপাদনের কথা ভাবে। সেখান থেকেই এই অঞ্চলে চা বাগান, উৎপাদন ও শিল্প-বাণিজ্যের দরজা খুলে যায়। একদা সমৃদ্ধ ও বর্ণময় সেই দিন, কালের অঙ্গুলিহেলনে অবলুপ্ত। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে সাহেবদের বাংলোটি, যা ড্যামসাং ফোর্ট থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত।
তবে, দুর্গের ইতিহাস আরও প্রাচীন। ১৬৯০ সালে তৈরি এই দুর্গে বাস করতেন লেপচা রাজা গ্যাবো আচুক। দুর্গ তখন ভুটানের রাজার অধীন। রাজার হয়েই আচুকের কাজ করার কথা। কিন্তু তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করে দুর্গের দখল নিলেন। ঘোর যুদ্ধ হলো ভুটানের রাজার সঙ্গে গ্যাবো আচুকের, এবং শেষে পরাজয়। ১৮৬৪-তে ভুটানের রাজার সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ ও তারপর দুর্গের অধিকার চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। দুর্গের উপর থেকে সুন্দর দেখা যায় পুরো পেডং ও আশপাশের অঞ্চল।
পেডং থেকে যাওয়া যায় লাভা, লোলেগাঁও, রিশপ। অন্যদিকে বারমেক, রামধুরা। রামধুরা থেকে কিছুটা এগোলে মুনসুং, এখানে রয়েছে ব্রিটিশ আমলে তৈরি জলসা বাংলো। এলাকাটি সিনকোনা চাষের জন্য বিখ্যাত। এই বাংলো থেকে অনেকটা এগিয়ে রংপো নদী। রংপোর ওপারেও সিকিম। ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক দুদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ পেডং পর্যটককে সমৃদ্ধ করে সব দিক থেকেই। বর্ষা বাদ দিয়ে যে কোনও সময় যেতে পারো। শীতে অবশ্যই পর্যাপ্ত শীতপোশাক নিয়ে যেতে হবে।
এনজেপি স্টেশন/শিলিগুড়ি তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড/বাগডোগড়া এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি গাড়িতে যাওয়া যায় পেডং। লাঞ্চ ও ডিনারে ভাত-রুটি, ডাল, মরশুমি সবজি, আলুর চোখা, বেগুন ভর্তা, অন্যান্য ভাজাভুজি, চিকেন কষা, ডিম কারি। আগে পাহাড়ে মাছ পাওয়া যেত না। এখন চালানি মাছ পাওয়া যায়, স্বাদ অবশ্য সমতলের মতো নয়। ব্রেকফাস্টে থাকে পুরি-সবজি, আলু পরোটা, টোস্ট অমলেট। স্ন্যাক্সের ক্ষেত্রে মোমো, ভেজ বা ওনিয়ন পকোড়া। আর যে কোনও সময়ই মেলে থুপ্পা, যা পূর্ণজির হাতের গুণে হয়ে ওঠে দুরন্ত।
পাঠকদের মন্তব্য
250