ছোটোদের চাঁদের হাসি / হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা / এপ্রিল ২০২৪

টিয়াবনে দুটি দিন

 

কী মায়াময় সবুজ ! কেমন জল ছলছল নদীতল ! মাথার ওপর খোলা বিস্তীর্ণ আকাশে সাদা মেঘের দল যেন উড়ন্ত বকের সারি। ডুয়ার্সের প্রকৃতির সত্যি তুলনা হয় না। আজ আমি তোমাদের নিয়ে যেখানে হারিয়ে যাব, সেই জায়গাটার নামটাও ভারি মিষ্টি–টিয়াবন! একটু আগেই পার হয়েছি মহানন্দা রিজার্ভ ফরেস্ট। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক। তখন থেকেই সবুজের সঙ্গে আলাপন। পাশে পাশে চলেছে তিস্তা। অবশেষে বাঘপুলের ওপর (করোনেশন ব্রিজ) দিয়ে তিস্তা পার হলাম।

 

এরপর আরও কিছুটা এগিয়ে একের পর এক নদীর সঙ্গে দেখা। শরতের নীল আকাশ টুকরো টুকরো ছায়া এঁকেছে নদীগুলির বুকে। এখন নদীর বুকে জল কম, বালির চর বেশি। একে একে পেরিয়ে গেলাম লীশ, ঘিস, চেল, নেওড়া, কুর্তি, মূর্তি। এদের মধ্যে চেল হলো দারুণ খরস্রোতা, তার বুকে বিশাল আকারের এক একটি বোল্ডার। নদী ছাড়াও পথের দু ধারে রয়েছে দীর্ঘ গাছের সারি আর চোখ জুড়ানো সবুজ চা-বাগান ! চালসা মোড় থেকে ডানদিকে ঢুকল আমাদের গাড়ি। আর একটু পরেই পৌঁছে গেলাম টিয়াবন। নির্জন, শান্ত বিশাল বিশাল গাছে ঢাকা এই রিসর্ট যেন বন্য প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা এক অপরূপ ছবি।

 

 

ছোটো ছোটো কাঠের কটেজে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা। তেমনই একটি ঘরে ব্যাগপত্র রেখে, ফ্রেশ হয়ে ঘরের সামনের ছোটো বারান্দায় এসে বসলাম। চা দিয়ে গেল রিসর্টে কর্মরত ছেলেটি। ঘরের পিছনের জঙ্গলে তখন অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। সামনে অস্তগামী সূর্য আবিরে রাঙিয়েছে আকাশ। ভোল্টেজ ডাউন, তাই, মিটমিটে আলো। যতক্ষণ সম্ভব বারান্দায় বসে চারপাশের নির্জনতা উপভোগ করলাম। ডিনার এলো রাত আটটায়–ভাত, ডাল, ডিমের ওমলেট আর আলু ভাজা। সঙ্গে আচার ও স্যালাড। জঙ্গলে হাতি ও অন্যান্য জানোয়ার আছে শুনলাম। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয় লেপার্ডদের নিয়ে। এরা নিঃশব্দে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। ডিনারের পর তাই ঘরেই থাকতে হলো। বাইরে তখন ঝিঁঝিঁদের কনসার্ট শুরু হয়েছে। দূরে কোথাও শেয়ালের পাল ডেকে ওঠে। সেসব শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়ি।

 

ঘুম ভাঙে অজস্র পাখির কিচিরমিচির শুনে । ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসতেই চোখে পড়ল সামনের বাগানে। সেখানে তখন প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি চলছে। ফুলের রঙে মিশে গিয়েছে প্রজাপতির পাখার রঙ। সে যে কী মনোরম এক ছবি ! অনেকটা দূরে রিসর্টের সীমানার মধ্যেই নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা ময়ূর। এদিক ওদিক ছোটোবড় গাছের ডালে পাখিদের কলতান। মা পাখি মুখে করে খাবার নিয়ে এসে বাচ্চার মুখে তুলে দিচ্ছে। রিসর্ট-কর্মী এসে জানালো, ব্রেকফাস্ট তৈরি। ব্রেকফাস্ট সেরে হাঁটতে হাঁটতে রিসর্টের বাইরে এলাম। তারপর রাস্তা পার হয়ে উল্টোদিকের জঙ্গলে। প্রসঙ্গত, পুরো ডুয়ার্সের অনেকটা অংশ জুড়েই একাধিক অভয়ারণ্য। টিয়াবনের সবচেয়ে কাছে হলো গরুমারা। কাল ভোরে যাব গরুমারা অভয়ারণ্যে, সঙ্গে মূর্তি নদী।

 

 

লাঞ্চের পর চললাম চেল নদীর কাছে। রোদ্দুরের রঙ কিছুটা ফিকে এখন। আমাদের গাড়ি চালসা পার হয়ে জাতীয় সড়ক ধরে কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকের এক সরু পথ ধরল। সেই পথ ধরে কিছুদূর যাওয়ার পরেই চেলের গর্জন কানে এলো। ছোট্টো এক লোহার ব্রিজের ওপর দিয়ে গাড়ি গিয়ে পৌঁছল এক বিস্তৃত উপত্যকায়। চারপাশে বিস্তীর্ণ পর্বতশ্রেণী। গাড়ি থেকে নেমে একেবারে চেলের পাশে চলে গেলাম। অস্তগামী সূর্যের নরম আলো তখন ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। প্রচুর ট্যুরিস্ট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এদিক-ওদিকে। ছটফটে কিছু মানুষ বোল্ডারের ওপরে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত ! সামনে দুর্বার বেগে বয়ে চলেছে চেল। কিছুক্ষণ মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকে দেখে, কাছের চায়ের দোকানে চা পান করে গাড়িতে উঠলাম। টিয়াবন পৌঁছতে সন্ধ্যা নামল। অক্টোবরের শেষ। বাতাসে ঠান্ডার মৃদু আমেজ। সন্ধের পর আর তেমন কিছু করার নেই। আলো এত কম যে বই পড়া যায় না। স্মার্ট ফোনে সিগন্যাল নেই। অতএব ডিনার সেরে এফএম রেডিও শুনতে শুনতে ঘুমের দেশে পাড়ি।

 

 

পরদিন সকালে উঠে দ্রুত প্রস্তুত হয়ে চললাম গরুমারা, উদ্দেশ্য জঙ্গল সাফারি। নানা নিয়মকানুনের বেড়া পার হয়ে যখন জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করলাম, তখন ভোরের সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়েছে আকাশের কোণে কোণে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে সেই আলো আমাদেরও ছুঁয়ে যায়। জঙ্গলের সীমানা অনেকটা বিস্তৃত। তারই মধ্যে যেখানে যেখানে জন্তু জানোয়ারের দর্শন মেলার সম্ভাবনা, সেখানেই ঘোরাঘুরি করল সাফারির উপযুক্ত বিশেষ গাড়ি। একটি হরিণ, দুটি ময়ূর ছাড়া অবশ্য আর কারও দেখা পেলাম না। তবে, নানা জাতের গাছপালা দেখে মন ভরে গেল। সেখান থেকে এলাম মূর্তির পাড়ে। বর্ষায় তার অন্য রূপ । এখন অবশ্য সামান্য জল, বাকিটা বালি। নদী আর জঙ্গলের কানাকানি শুনে রিসর্টে ফিরলাম।

 

নিউ জলপাইগুড়ি থেকে আজ রাতেই আমাদের ফেরার ট্রেন। বিদায় আসন্ন। প্রকৃতির অমল সান্নিধ্য ছেড়ে যেতে হবে কাজের শহরে। রিসর্টে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম। পাশের কটেজে চারজনের একটি পরিবার আজই এসেছে। তাদের ছোটো দুটি বাচ্চা ছুটোছুটি করছে সামনের প্রাঙ্গনে। ময়ূরটি আজ অনেকটা কাছে চলে এসেছে। বাচ্চা দুটির সঙ্গে আমিও তাকে দেখি মুগ্ধ হয়ে। লাঞ্চে আঞ্চলিক বোরোলি মাছের ঝোল-ভাত খেয়ে একটু বিশ্রাম। তারপর বেরিয়ে পড়ি স্টেশনের উদ্দেশ্যে। বিদায় টিয়াবন।

 

 


পাঠকদের মন্তব্য

তনুজা চক্রবর্তী লিখেছেন... ১৭ই এপ্রিল, ২০২৪
খুব সুন্দর বর্ণনা করেছেন।
উত্তরে Admin লিখেছেন... ০১লা মে, ২০২৪
ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
রতন কুমার নাথ লিখেছেন... ০৯ই মে, ২০২৪
স্বচ্ছন্দু ভ্রমণ চিত্র। আন্তরিক ভাষা। ধন্যবাদ।

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up