ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্পগাথা / অক্টোবর ২০২৪

মজার বিচারসভা

গ্রামের নাম আন্দুলিয়া। কান্দি থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার। এই গ্রামের স্কুলে সভা বসেছে। রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা। সভাপতির আদেশে  নিয়ে আসা হল অভিযোগের বাক্স। বাক্স খোলা হলে সভাপতি তুললেন একটি চিরকুট। সারা সপ্তাহ ধরে অভিযোগের চিরকুট জমা পড়ে বাক্সে। শনিবারে স্কুল শেষে বসে বিচারসভা।

            সভাপতি চিরকুটটা পড়ে শোনালেন–তৃতীয় শ্রেণীর সুরজ গত সোমবার বাংলা পিরিয়ডের শেষে জমিরের গায়ে জল ছিটিয়ে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী সাজা ঘোষণা করলেন– অপরাধী সুরজকে শোনাতে হবে একটা কবিতা। সাজা ঘোষণার পর সুরজ শুরু করল–

          মাগো, আমায় ছুটি দিতে বল

          সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা

          এখন আমি তোমার ঘরে বসে

          করব শুধু পড়া পড়া খেলা।

          

হ্যাঁ, এই রকমই ব্যবস্থা করেছেন প্রধান শিক্ষক মনীন্দ্র বসু ও সহশিক্ষক বসির আলি। এমনই বিচার-ব্যবস্থা যে সাজা পেয়ে অপরাধী খুশী হয়। বলে, খুব মজা হয় শনিবারে। সবাই কত কিছু করে দেখায়। কবিতা বলে, গান করে, নাচ করে, গল্প বলে শোনায়।

 

      কিছুদিনের মধ্যেই এই মজার বিচারব্যবস্থার কথা ছড়িয়ে পড়ল ব্লক ছাড়িয়ে জেলায়। একদিন জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক এলেন এই অদ্ভুত বিচারসভা দেখতে। সেদিন সভাপতি চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র তপোব্রত বা তাপু। মুখ্যমন্ত্রী তনিমা সাঁতরা। সেও চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী।

গুরুগম্ভীর সভা। সভাপতি তপু বাক্স খুলে চিরকুট টানছে। অভিযোগ পড়ে তনিমা শাস্তি ঘোষণা করছে। অপরাধীরা হাসিমুখে তা পালন করছে।

       হঠাৎ-ই ছন্দপতন। তাপু একটা চিরকুট তুলেই চুপ করে গেল। পড়ছে না বা কোনও কথা বলছে না। মনীন্দ্রবাবু বললেন–কী রে চুপ করে আছিস কেন? পড়, শুনি কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ!

কিছুক্ষণ পর তাপু চিরকুটটা তুলে দিলেন মনীন্দ্রবাবুর হাতে। মনীন্দ্রবাবু পড়ে বললেন–আরে অভিযোগ তো খোদ  সভাপতি তাপুর বিরুদ্ধে।

    ডি. আই সাহেব বললেন–তাই নাকি! পড়ুন তো দেখি কি অভিযোগ।

গতকাল তাপু মিড-ডে-মিলের রান্না করা খাবার না খেয়ে বাড়ি নিয়ে গেছে।

কার অভিযোগ, ডাকুন তো তাকে–ডি.আই সাহেব বললেন।

অভিযোগকারী মন্টু বিশ্বাসকে ডাকা হল। সে এসে দাঁড়াল।

    সহশিক্ষক বসিরবাবু বললেন–এ্যাই মন্টু, কখন নিয়ে গেল রে? কাল তো খাওয়ানোর সময় আমি ছিলাম পুরোটা। কই দেখিনি তো!

কী করে দেখবেন স্যার, ও তো ভাত আর মাংস নিয়ে গেছে পলিপ্যাকে ভরে জামার তলায় লুকিয়ে।

শুনে মনীন্দ্রবাবু চেপে ধরলেন তাপুকে। তাপু কোনো উত্তর দিল না। শুধু চেয়ে রইল ফ্যাল ফ্যাল করে। তাপুর বাবা নেই। তাই ডাক পড়ল ওর মায়ের। ওর মা জানাল–না তো স্যার, তাপু তো কোনওদিনও স্কুলের খাবার বাড়িতে নিয়ে যায় না।

শুনে ডি. আই সাহেব উঠে পড়লেন। তিনি ব্যাপারটার ইতি টানতে চাইলেন। বললেন, মনীন্দ্রবাবু, এটা একটা ছোট্ট ঘটনা। এর জন্যে বিচারসভা বন্ধ করবেন না। চালিয়ে যান–বলে তিনি চলে গেলেন।

 

    কিন্তু মনীন্দ্রবাবুর মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করতে থাকল। মিড-ডে-মিল খুব স্পর্শকাতর বিষয়। এই নিয়ে আবার কোন গোলমাল ঘটে কিনা কে জানে। তাঁর সমস্ত রাগ দিয়ে পড়ল তাপুর উপর। তিনি তার উপর নজর রাখতে লাগলেন।

    তবে মনীন্দ্রবাবুর দুশ্চিন্তা কেটে গেল কয়েকদিনের মধ্যেই। খাবার নিয়ে আর কোনো সমস্যা না। স্কুল চলতে লাগল তার স্বাভাবিক ছন্দে। দেখতে দেখতে কেটে গেল মাসখানেক। এসে গেল ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে মাসের প্রিয় দিন। প্রিয় দিন মানে মিড-ডে-মিলের দিন–মাংসের দিন। এ দিনটা এলেই ছাত্রছাত্রীরা কেমন যেন শান্ত হয়ে যায়। পড়াশোনা ঠিকঠাক করে। একে অপরের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে না। মুরগির মাংসের রান্নার গন্ধ যত ছড়ায়, তত ওরা ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা বোধ করে। খাওয়ার আগে গন্ধটাকে নাক দিয়ে টেনে জিভের মধ্যে চালান করে দিতে চায়। কখন টিফিনের ঘন্টা পড়ে, তার অপেক্ষায় যেন উদগ্রীব হয়ে থাকে। আসলে মনটা মাংস খাওয়ার আনন্দে এত মশগুল থাকে যে ঝগড়া মারামারি করার কথা ওদের মনেই আসে না।

 

    টিফিনের ঘন্টা পড়ল। ছাত্রছাত্রীরা খাওয়ার ঘরে গিয়ে থালা পেতে বসে পড়ল। শিক্ষক বসির সাহেব খাওয়ার ঘরে গেলেন। কিন্তু মনীন্দ্রবাবু খাওয়ার ঘরে গেলেন না। অফিসের জানালা আধ-ভেজানো  করে বসে রইলেন তাঁর নিজের চেয়ারে।

  একটু পরেই কী যেন দেখে উঠে পড়লেন হঠাৎ। স্কুলের বাউন্ডারি ছেড়ে রাস্তায় নামলেন। চলতে শুরু করলেন। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর এসে দাঁড়ালেন সাঁতরাপাড়ার একটা ছিটেবেড়ার ঘরের সামনে। ঘরে ঢুকলেন না। বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। তারপর আবার ফিরে এলেন স্কুলে। ততক্ষণে সকলের খাওয়া শেষ হয়েছে। টিফিন শেষের ঘন্টাও পড়ে গেছে।

 

   মনীন্দ্রবাবু অফিসে ঢুকে বসলেন তাঁর চেয়ারে। বসির সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গিয়েছিলেন স্যার?

তার উত্তরে মনীন্দ্রবাবু কিছু বলার আগেই ঘরে ঢুকলো মন্টু। বলল, স্যার, তাপু আজও খাবার ঘর থেকে আগে বেরিয়ে গেছে।

খেয়ে গেছে, না,  না খেয়ে গেছে?–বসির সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন।

প্রথম যখন দেখি, তখন তো ভাত খাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর দেখি,ও নেই !–ওই তো স্যার, তাপু স্কুলে ঢুকছে! জিজ্ঞেস করুন না কোথায় গিয়েছিল?

এ্যাই তাপু, এদিকে আয়, অফিসে–বসির সাহেব ডাকলেন।

তাপু কাঁচুমাচু মুখ করে এসে দাঁড়াল। দেখলেই মনে হয় অপরাধীর মুখ।

–কোথায় গিয়েছিলি? বসির স্যারের গম্ভীর কণ্ঠ।

–না মানে স্যার, আমি একটু …কথা শেষ না করে থেমে গেল তাপু।

–আজ আবার খাবার নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলি?

তাপু স্পিকটি নট।

–কী রে বল, চুপ করে থাকলে, ফল ভালো হবে না !

তবুও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো তাপু। মনীন্দ্রবাবু এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। একটাও কথা বলেন নি। এইবার বলে উঠলেন–ও কোথা গিয়েছিল, আমি জানি, আমার মুখে শুনুন। ও গিয়েছিল ফিরুদের বাড়ি।

ফিরু, মানে–ক্লাস ফোরের ফিরোজ, যে গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙেছে, স্কুলে আসছে না দীর্ঘদিন?

হ্যাঁ।

–তা ওদের বাড়ি গিয়েছিল কী করতে?

–ফিরোজকে মাংসের ঝোল দিতে।

–মাংসের ঝোল দিতে?

–হ্যাঁ, আগেরবার ভাত ও মাংসের ঝোল নিয়ে গিয়ে দুজনে মিলে খেয়েছিল।

–তা-ই নাকি ?

এবার কথা বলল তাপু, জানেন স্যার,ফিরোজ মাংসের ঝোল খেতে খুব ভালোবাসে। পা ভেঙে যাওয়ায় স্কুলে আসতে পারছে না তো ! তাই…!

তাই চুপিচুপি এইভাবে…এইটুকু বলেই থেমে গেলেন বসির সাহেব। তারপর ধমকে উঠলেন, না না, এসব বরদাস্ত করা যাবে না স্যার। আগামী শনিবার বিচারসভায় ওকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।

মনীন্দ্রবাবু বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে। বলে, চেয়ার ছেড়ে  উঠে ক্লাসে চলে গেলেন। বসির সাহেবও গেলেন।

হ্যাঁ, বিচারসভা বসেছিল শনিবার। তাপুর শাস্তিও হয়েছিল। তাপুকে বলা হয়েছিল একটা গল্প লিখে আনতে, যে গল্পের শিরোনাম হবে ‘মিড-ডে-মিলের মাংস’।

 


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up