ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্পগাথা / নভেম্বর ২০২৪

নতুন ডাঙা

নর্থ-বেঙ্গলের ডুয়ার্স এলাকার একটি জমজমাট মফঃস্বল টাউন। সেখানকার একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের জনপ্রিয় শিক্ষক জীবন সরকার। ছাত্রছাত্রীদের অত্যন্ত প্রিয় জীবনস্যার। তাঁর ক্লাস করার জন্য ছেলেমেয়েরা উন্মুখ হয়ে থাকে। টিফিন ব্রেকের পরে ক্লাস এইটের ক্লাসরুমে ঢুকে ছেলেমেয়েদের দিকে একনজর তাকিয়ে জীবনস্যার বললেন, তোদের সিলেবাসের পড়া তো আগের দিন শেষ করে দিয়েছি। পরীক্ষা এখনো প্রায় মাসখানেক দেরি আছে। যা যা পড়ানো হয়েছে মন দিয়ে পড়বি কিন্তু। কোথাও কিছু আটকালে বা বুঝতে না পারলে বলবি আমাকে। আজ তোদের সিলেবাসের বাইরে একটা সত্যি গল্প শোনাবো। কি সবাই রাজি তো ?

স্টুডেন্টদের মুখচোখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

সমবেত স্বরে বলে উঠলো, রাজী স্যার।

 

জীবনস্যার খুব হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষ। টিচার্স রুমে অনেক সময় কোনো স্টুডেন্টের নামে কমপ্লেন এলে, তাকে কি শাস্তি দেওয়া যায় তাই নিয়ে আলোচনা হয়। বেশিরভাগ সময় জীবনস্যার সেই স্টুডেন্ট-এর খারাপ দিক ছেড়ে তার ভালো গুণ কি কি আছে, তা নিয়ে বক্তব্য রাখেন। বহু স্টুডেন্ট শুধু জীবনস্যারের জন্য কঠিন পানিশমেন্ট থেকে বেঁচে গেছে। শুধু তাই নয়, সেই স্টুডেন্টের নেগেটিভ দিকগুলো শোধরানোর দায়িত্বও তাঁকে নিতে হয়েছে। তিনি সানন্দে সেই দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছেন। সবসময় সফল হয়েছেন তা নয়। তবে, হাল ছেড়ে দেননি।

 

অন্যমনস্কতা কাটিয়ে বাস্তবে ফিরে জীবনস্যার বললেন, তোরা অনেকে নিশ্চয়ই জঙ্গলে ঘুরতে গেছিস। কেউ কি দেখেছিস, জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ অল্প কিছু চাষের জমি আর তার সঙ্গে লাগোয়া ছোটো ছোটো গ্রাম। সেরকম একটা গ্রামের কথা আজ তোদের বলব। গ্রামের নাম ‘নতুন ডাঙ্গা‘ হলেও গ্রামটা অনেক পুরনো। ব্রিটিশ আমলের। জঙ্গলের ওইসব ছোটো ছোটো গ্রামের ইতিহাস নিয়ে নানারকম গল্পগাথা চালু আছে। ‘নতুন ডাঙ্গা‘ কিভাবে তৈরি হলো সে নিয়েও অনেক গল্প শোনা যায়। তারমধ্যে যেটা বিশ্বাসযোগ্য সেই গল্পটা বলছি।

 

ব্রিটিশ আমলে কোনো এক ব্রিটিশ সেনা-অফিসার গভীর জঙ্গলে পথ হারিয়ে ওই জঙ্গলের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছিল। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে সাহেব একটা বড়ো গাছের তলায় বসে জিরোচ্ছিল। ক্লান্তিতে কখন চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে বুঝতে পারেনি। বাঘের হাড় হিম করা ডাক শুনে তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে একটা হরিণকে তাড়া করে একটা বাঘ ওদিকেই আসছে। দ্রুত রাইফেলটা তাক করে সেদিকে তাকিয়ে থাকল সাহেব। হরিণটা দিক পাল্টে হঠাৎ অন্যদিকের ঘন জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। বাঘটার নজর পড়ল সাহেবের দিকে। তখনি গাছের ওপর থেকে একজন বলল, চটপট ওপরে উঠে আসুন স্যার, বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিল। সাহেব উঠে পড়ল গাছে। দেখল দুজন ময়লা ধুতি আর গেঞ্জি পরা লিকলিকে চেহারার লোক গাছের মগডালে চেপে বসে আছে। সাহেব একটা উপযুক্ত ডাল বেছে নিয়ে রাইফেল তাক করে বসে রইল।

 

নিস্তব্ধ জঙ্গলে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে না। তার মানে বাঘটা শিকার ধরে ফেলেছে। লোকদুটো তাকে গাছের ওপরে আসতে বলে ঠিকই করেছিল। কারণ কোনোভাবে গুলি বাঘের গায়ে না লাগলে সাহেবকেই অ্যাটাক করতো। যাই হোক কিছুক্ষণ পরে আবার জঙ্গল স্বাভাবিক হয়ে গেল। পাখিদের কিচির মিচির, বাঁদরের চিক চিক, ময়ূরের কর্কশ শব্দে বন যেন বলে দিল, আর ভয় নেই এবার তোমরা গাছ থেকে নেমে আসতে পারো। লোক দুজন সাহেবের কথা বোঝে না। সাহেবও ওদের ভাষা বোঝে না। তবু ইশারায়, অঙ্গভঙ্গিতে বুঝল সাহেবের খুব জল তেষ্টা পেয়েছে, খিদেও পেয়েছে। ওরা বন থেকে কিছু ফলমূল জোগাড় করেছিল, সাহেবকে দিল। সাহেব কোনো আপত্তি করা দূরে থাক, খেয়ে বাঁচলো মনে হলো।

 

এরপরে সাহেবকে নিয়ে জঙ্গল থেকে বের করার পথ ধরল। কিছুদূর এগোতে দেখা গেল একটা ছোটো নদী তিরতিরিয়ে বয়ে চলেছে। হাঁটুজল হলেও জল খুব পরিষ্কার এবং মিষ্টি। তিনজনেই তেষ্টা মিটিয়ে জল খেয়ে আবার রওনা দিল। সঠিক জায়গায় পৌঁছনোর পরে বিদায় নেবার আগে সাহেব বলল, তোমাদের উপকার আমি কোনোদিন ভুলব না। তোমাদের জন্য কিছু করতে চাই। তোমরা কোথায় থাকো, নাম কি ?

একজন বলল, একটা বড়ো নদীর ধারে আমাদের ঘরবাড়ি, জমিজমা ছিল। বন্যায় সব ভেসে গেছে বলে পরিবার নিয়ে এই জঙ্গলের কাছেই কোনরকমে বাস করছি। রুজি রোজগার কিছুই নেই। চাষের জমিও জলের তলায়। আমাদের থাকার যদি কোনো ব্যবস্থা করা যায় খুব ভালো হয় স্যার। আমার নাম ভোলা আর ওর নাম মন্টু স্যার।

সাহেব দুজনের নাম বিড়বিড় করে দু-তিনবার ঠোঁট নেড়ে বিদায় নিল।

 

তিনমাস পরে একজন ফরেস্ট রেঞ্জারসাহেব ওদের খুঁজে বের করে জানাল সাহেব তার বন্ধু। তার অনুরোধে সে জঙ্গলের ভেতরে তাদের জন্য কিছুটা জমির ব্যবস্থা করেছে। পাহাড়ের ঢালে জমিটা একটু উঁচু জায়গায়। ওখানে বড়ো গাছ কম, ছোটগাছের ঝোপঝাড় বেশি। ঘর বানানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে একটাও বড়ো গাছ যেন কাটা না পড়ে। আর জ্বালানির জন্য শুকনো ডালপালা জোগাড় করতে হবে। কোনো গাছের ডাল ভাঙা যাবে না। ঘরবাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কাছেই ঝর্না আছে। জলের সমস্যা হবে না। সন্ধের আগে ঘরে ফিরে যেতে হবে। একজন পাহারাদার দেওয়া হবে যতদিন না ঘর তৈরি হচ্ছে। আর যে কোনো দরকারে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে তারা। ওরা সবেতেই রাজি হয়ে গেল।

 

প্রথমে পাঁচটা পরিবার এসেছিল। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে ছোটখাটো মাথা গোঁজার ঠাঁই বানালো ওরা। ওই গ্রামে যদি কোনোদিন যাবার সুযোগ হয়, দেখতে পাবি বড়ো গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে কি সুন্দর মাটির ঘর। একদম ছবির মতো। এরপরে বহুবছর পেরিয়ে গেছে। এখন গ্রামে কুড়িঘর লোকের বাস। গ্রামে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার ব্যবস্থা আছে। এরপরে দুই কিলোমিটার জঙ্গলের পথ পেরিয়ে বড়ো স্কুলে বাচ্চাদের পড়তে যেতে হয়। ওই গ্রামের অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে বড়ো স্কুলে ভালো পড়াশুনো করে বাইরে চাকরি বাকরি করছে। কিন্তু সেই প্রথম যারা ঘর বেঁধেছিল ওখানে, তাদের তৈরি করা নিয়মকানুনগুলো আজও চালু আছে।

 

সেইসময় কারোর হাতে টাকাকড়ি বা পুঁজি ছিল না। ছিল অসাধারণ মনের জোর। তাই যার যা ছিল সবকিছু দিয়ে একটা ‘কমন ফান্ড’ তৈরি করেছিল। সেই ফান্ড থেকে একেকদিন একেকজনের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া হতো। ছোটোছোটো খেত বানিয়ে চাষ শুরু করেছিল। শাক-সবজি, ফলমূল এসব বিক্রি করতে যেত কয়েকজন। শুকনো কাঠকুটো কুড়োতে যেত কয়েকজন। যে যা রোজগার করতো, সব টাকা কমন ফান্ডে জমা হতো। তার মানে সবাই সমানভাবে বাস করত। কোনো বড়লোক গরীবলোক নেই। কোনরকম হিংসা বিদ্বেষ নেই। সবাই এক। কোনো ঝামেলা লাগলে আলোচনা করে মিটিয়ে ফেলা হতো। ভাবতে অবাক লাগলেও একথা সত্যি, ‘নতুন ডাঙ্গা‘ এখনো সেইভাবে চলছে। যারা মানিয়ে নিতে পারেনি তারা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।

 

বংশ পরম্পরায় গ্রামের মানুষের বিশ্বাস, সেই ব্রিটিশ সাহেব তাদের সঙ্গে এই গ্রামেই বসবাস করে। কারণ যখনই কোনো বড়োসড়ো বিপদ হয়েছে, আশ্চর্যজনকভাবে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছে গ্রামের বাসিন্দারা। একবার গ্রামে কলেরা শুরু হয়েছিল। কোথায় কতদূরে কিভাবে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যাওয়া হবে, এই দুশ্চিন্তায় যখন সবাই নিরূপায়, কোথা থেকে হাজির হলো এক ডাক্তার। সেও সেই সাহেবের মতো জঙ্গলে পথ হারিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূর থেকে ঘরবাড়ি দেখে ওখানে এসেছিল।

অতিথিকে আদর করে আশ্রয় দিল তারা। কলেরার কথা শুনে সেই ডাক্তার প্রাণপণে চিকিৎসা শুরু করে দিল।

গ্রামটা মড়কের হাত থেকে বেঁচে গেল। সেই প্রথম গ্রামের মানুষ জানতে পারলো, জল ফুটিয়ে খেতে হয়। গ্রামের লোকেরা তাকে দেবদূত ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারল না।

 

গল্প শুনে, মনে মনে সেই ব্রিটিশ সাহেবকে প্রণাম জানাল স্টুডেন্টরা। তাদেরই একজন তুফান, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আরেকটা আশ্চর্য ঘটনার কথা বলুন না স্যার।

জীবনস্যার বললেন, ঠিক আছে বলছি। এটা খুব বেশিদিন আগেকার ঘটনা নয়। বিভিন্ন বয়সের পাঁচ-ছজন ছেলেমেয়ে বড়ো স্কুলে পড়তে যায়। দিনে দিনে যাওয়া-আসা, তাছাড়া দল বেঁধে থাকলে বন্য জীবজন্তুরা সামনে আসে না। তবে ময়ূর, হরিণ, বাঁদর এরা তত ভয় টয় পায় না। এই কারণে ছেলেমেয়েরা গার্জেন ছাড়াই যাতায়াত করে। যাবার পথে একটা ছোট্ট নদী আছে। তাতে বর্ষাকাল ছাড়া সারাবছর পা-ডোবানো জল থাকে। দিব্যি পার হওয়া যায়।

 

সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা পা চালিয়ে হাঁটা শুরু করল। নদীর কাছাকাছি এসে দেখে একটা লেপার্ড জল খাচ্ছে। ভয়ে সবার বুক হিম হয়ে গেল। ফিরে পালাবে কিনা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ডালপালা সরিয়ে একটা বিশাল বুনো হাতি বেরিয়ে এলো। সে ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকালেই না। সেও আসলে জল খেতে এসেছিল। হাতিটা কাছাকাছি আসতেই লেপার্ডটা লেজ গুটিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। হাতি একটা বিকট হাঁক ছেড়ে জল খাওয়ায় মন দিল। ছেলেমেয়েগুলো চুপচাপ নদী পেরিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

 

গ্রামে এসে ঘটনাটা বলতেই একজন বয়স্ক মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলল, সেই ব্রিটিশ সাহেবই হাতিটাকে পাঠিয়েছে বাচ্চাদের রক্ষা করার জন্য। এটা বিশ্বাসের ব্যাপার, যুক্তির ব্যাপার নয়।

জীবনস্যার থামতেই একজন জিজ্ঞেস করলো, স্যার আপনি ওই গ্রামের সম্পর্কে এত কথা কিভাবে জানলেন?

স্যার মৃদুহেসে বললেন, আমি যে ওই গ্রামেরই ছেলে। তাছাড়া ওই ছেলেমেয়ের দলে আমিও ছিলাম সেদিন। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। ঠিক তোদের মতো। সবাই হাততালি দিয়ে জীবনস্যারকে অভিনন্দন জানালো। ক্লাস শেষের ঘণ্টা বাজল ঢং ঢং ঢং…!!

 

 


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up