মান্তুর পিকনিক
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
মনটা চনমনে আজ মান্তুর। অনেকদিন বাদে আজ সে তার বাবা, মা আর বোনকে নিয়ে পিকনিকে যাবে। আসলে বাবা তো ছুটিই পায় না। অন্যদের যখন ঘুরে বেড়াবার সময়, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখার সময়, মান্তু আর তিতিন তখন মুখ গোমড়া করে বাড়িতে বসে থাকে। থাকবে নাই বা কেন। মান্তু ভিতিনের বাবা-মা দুজনেই যে পুলিশ অফিসার। কখনও চেতলা, কখনও আহিরিটোলা–বাবা-মা দুজনেই ব্যস্ত থাকে ভিড় সামলাতে। ওই সময়টা তারা দুজন পুলিশ কোয়ার্টারের পুজোর প্যান্ডেলেই কাটায়। বসে আঁকো, ঢাক বাজানো, লিফ দড়ি, সব হয়। কিন্তু রতন, আসিফ, চন্দনার মতো নৈনিতাল, কার্শিয়াং বেড়াতে যাওয়া হয় না।
এইসময়ে মান্তুর ঠাকুমাকে মনে পড়ে খুব। তিলতিল করে মৃত্যুর দিকে ধেয়ে চলা ঠাকুমা হঠাৎ মারা যাবার আগের দিন অবধি মান্তু আর তিতিনকে ঠাকুরমার ঝুলির গল্প শোনাত। কী হয়েছিল ঠাকুমার? বাবাকে একথা জিজ্ঞেস করলে বলে না কিছুই। মা বলেছিল, রক্ত শুকিয়ে আসছিল একটু একটু করে। কী যেন নাম রোগটার ! অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া না কী যেন। রক্ত এভাবে শুকিয়ে যায় নাকি! কে জানে!
যাই হোক। অনেকদিন পরে এবার ছুটি। বাবা-মা, দুজনকে একসঙ্গে নিয়ে মান্তু আর তিতিন চলেছে পিকনিকে। গন্তব্য মান্তুর বাবার ছেলেবেলার গ্রামের বাড়ি আতাপুর। পাশেই বাঁওড়।
হাসনাবাদের লোকাল ট্রেনে যেতে যেতে মান্তু প্রশ্ন করে বাবাকে,
–বাঁওড় কী বাবা ?
বাবা হেসে বলে,
–নদী যখন চলতে চলতে পথ বদলায়, তখন তার পুরনো পথে ছেড়ে যাওয়া ঘোড়ার ক্ষুরের মতো হ্রদের নাম বাঁওড়।
তিতিন বলে,
–বাবা, ঘোড়ার ক্ষুর কী?
বাবা হেসে বলে,
–এইবার আমাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানে যখন ময়দানে রেজিমেন্টের ঘোড়াগুলো আসবে, তখন দেখাব তোদের।
স্টেশন থেকে জিপ নিয়ে সকলে চলল আতাপুর। পথে পড়ল সরু লিকলিকে একটি নদী। দিব্বি হেঁটে পার হওয়া যায়। বড় মায়ালু। মান্তু আবার নড়েচড়ে বসে। বাবাকে জিজ্ঞেস করে,
–ও কী নদী? ইছামতী?
–না। ওর নাম ডাঁসা। ছোটোবেলায় কত সাঁতার কেটেছি ওই নদীতে। বড় বড় লঞ্চ যেত তখন।
–এখন বুঝি আর যায় না।
–না। এখন জল কমে গেছে। অমাবস্যার ভাঁটার সময় দিব্বি পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায়।
আতাপুরে বাবাদের পুরনো বাড়িতে এখনও মান্তু আর তিতিনের কাকা-কাকিমা থাকে। কাকার ছেলে রঞ্জু মান্তুর চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। আর ওর বোন নন্দা তিতিনের বয়সী। মা-বাবা ব্যস্ত হয়ে গেল ঘরের কাজে। আর ওরা চারজন বেরিয়ে গড়ল বাঁওড় দেখতে। পিকনিক নদীপারে। সেখানে জমিয়ে মাংস রান্না হল। তিতিন-মান্তুদের জন্য কাকিমা নিয়ে এলো রসমালাই। সন্ধ্যা নামল কখন জানতেই পারা গেল না। সন্ধ্যায় ডাঁসা নদীর ধারে গানবাজনা হলো কত ! কাকা টপ্পা গাইল। বাবা গলা মেলালো একটু। মা আর কাকিমা মিলে গজল। নন্দা লোকগীতি গাইল।
ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। মান্তু শুনল কাকা তার বাবাকে বলছে,
–নদীটা চোখের সামনে মরে যাচ্ছে রে। মায়ের মতোই শুকিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। আগে তাও জোয়ারে খেয়া পারাপার হতো। এখন তাও হচ্ছে না। জল এত নেমে গেছে। অথচ বল–একসময় কত সাঁতার কেটেছি আমরা। এখন নদীর বুকে যখন-তখন চর জেগে ওঠে।
বাবা কিছু বলল না। মান্তু দেখতে পেল, বাবার দুই চোখ ছলছল করছে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে মজে যাওয়া ডাঁসা নদী আরেকবার দেখতে শেল মান্তু। হঠাৎ তার মনে হলো, নদীটা ঠিক তার ঠাকুমার মতো দেখতে। শেষদিন অবধি নদীটা তাকে অনেক গল্প শোনাবে। শোনাবেই।
পাঠকদের মন্তব্য
250