নদী ও বৃষ্টি
সঞ্জিতকুমার সাহা
কাকদ্বীপ থেকে কলকাতা হয়ে সইদূনদের বাস যখন গঙ্গার সেতুতে উঠল তখন হঠাৎ করে সবাই হইহই করে উঠল। নদীর বুকে ভেসে থাকা নৌকা থেকে লঞ্চ সবই ওদের কাছে কেমন যেন নতুন মনে হতে লাগল। ওদের ওখানেও ওরা নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ প্রায় সবসময়েই দেখে থাকে। কিন্তু ডায়মন্ডহারবারের পর থেকে ওরা আর তেমন নদী দেখেইনি। রাখি দিদিমণি বললেন, এটা গঙ্গা নদী। বইতে পড়েছিস। দেখে নে। সবাই মুখ বাড়িয়ে নদী দেখল, নদীর ধারের বড়ো বড়ো বাড়িগুলোও দেখল। ওদের ওখানকার নদীনালার ধারে এমন বাড়ি তো নেইই। ওখানে কেবল বাঁধ আর কিছু নোনা গাছ। দিনে দুবার করে জোয়ার আর ভাটা। তারপর বড়ো কোটাল এলে তো কথাই নেই, তখন পাড় ভেঙে নদী উপছে জল। সেই জল ঢুকে পড়ে বাড়িতে, জমিতে। তখন তো একেবারে ভয় আর ভয়। কিন্তু এখানে যেন একেবারে অন্যরকম।
গঙ্গার সেতু পেরিয়ে গাড়ি যতই এগোচ্ছে ততই মনে হচ্ছে এ কোন দূরদেশে চলেছে ওরা। ওদের গাঁ-ভূমি, নদী-নালার সঙ্গে কোনও মিল খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকের গাছটাছও অন্যরকম। চোখে পড়ছে আমগাছ, কাঁঠালগাছ, জামগাছ, কলাগাছ। এছাড়াও অন্য অনেক গাছ। সেসবের নামটামও জানে না। সইদূন বসেছিল জানালার ধারে।
রাখি দিদিমণি মাঝেমধ্যে সামনের দিকে দাঁড়িয়ে, সকলের দিকে মুখ করে জায়গার নামটামও বলছিলেন। একবার বললেন, আমরা হুগলি পেরিয়ে এখন বাঁকুড়ায় ঢুকছি। এই যে একটু একটু করে জঙ্গল দেখতে পাচ্ছিস, এটা জয়পুরের জঙ্গল। এই জঙ্গলে মাঝেমধ্যেই হাতিরা এসে বেশ কিছুদিনের জন্য থেকে যায়।
হাতি! বুকের ভিতরে হাতির ছবি লাফালাফি করতে থাকে সকলের।
রেশমিকা ফস করে জিজ্ঞেস করল, দিমণি আমরা হাতি দেখতে পাব?
রাখি দিদিমণি মিষ্টি করে হাসলেন, ওরে বাবা হাতি! না বাবা ওদের সামনাসামনি যত না দেখা যায়, ততই মঙ্গল।
দিদিমণি হাসলেন, তোদের ওখানে বাঘ বের হলে কেমন লাগে?
খুব ভয় করে তখন– বলে নমিতা, সে রুকসানার পাশেই বসেছিল।
এরপর রাখি দিদিমণি ক্লাশঘরের মতো বোঝাতে লাগলেন, বন্যপ্রাণীরা বনেই সুন্দর। সেটাই ওদের স্থান। ওদের তাই দূর থেকে দেখাই ভালো।
এরপর যে যার মতো জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে, জানালার দুপাশে যতদূর চোখ মেলে যা দেখা যায়, তাই দেখতে থাকল ওরা। সইদূন ওদের দেশগাঁয়ের সঙ্গে এদিকের গাঁ-গঞ্জর মিল খুঁজতে থাকে মনে মনে। এমন সময়ে রাখি দিদিমণির গলা ভেসে এল। তিনি রাস্তার ধারের দুপাশের গাছটাছের দিকে তাকিয়ে বলে চলেছেন, গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখ। তোদের ওদিকে এই গাছগুলো নেই। এখানে আছে অর্জুন-সেগুন, মহুয়া-আসন, আমলকী-বহেরা-হরিতকী।
দেখতে দেখতে ওদের বাসগাড়ি জয়পুর, বিষ্ণুপুর পার হয়ে এসে থামল অ্যান্থনি বাগানে। গাড়ি এসে থামল একটা অনেক পুরোনো বটগাছের ছায়ার নিচে। পাশেই একটা পেল্লায় লালরঙের দোতলা বাড়ি। আজ এখানেই ওরা থাকবে।
সইদূনরা গাড়ি থেকে নেমে দেখল, এ একেবার অন্যরকম জায়গা। ওদের চেনা ছবির সঙ্গে কিছুতেই মিলছে না। আশেপাশে কোনো বাড়িঘর চোখে পড়ল না। অনেকখানি জায়গা জুড়ে এই অ্যান্থনি বাগান। বাগান তো নামেই।
রাখি দিদিমণি ওদের নিয়েই এসেছেন অন্যরকম জায়গা দেখাবেন বলে। এখানকার মানুষজন থেকে গাছগাছালির সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দেবেন। এখানকার প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গেও ওদের পরিচয় ঘটবে। ওদের চেনা গন্ডীর বাইরে, অন্যরকমও যে আছে, সেটা ওদেরওর বোঝা দরকার। নিজের রাজ্য, নিজের দেশটাকেও একটু একটু করে জানা দরকার। রাখি দিদিমণির কথায়, ওরা বেরিয়েছে প্রকৃতি পাঠে। আসার আগেও দিদিমণি ওদের বলেছিলেন, যত ঘুরবে তত জানবে। যত জানবে তত শিখবে। শুধু বই পড়লেই সব জানা যায় না। একজন বুঝদার মানুষ হয়ে উঠতে গেলে তোদের নানা জায়গায় যেতে হবে। ঘুরতে হবে। ঘুরতে ঘুরতেই কত কী জানা যাবে। তাতেই জ্ঞান বাড়বে, তবেই শিক্ষা সঠিক হবে।
ঘোরাঘুরির পর এসে স্নান-আহার। এখানে একজন গোস্বামী আংকল আছেন। তিনি স্থানীয়। তিনিই সবার দেখাশোনা করছেন। তিনিই সব দেখাবেন, সব বোঝাবেন। খাওয়া হয়ে গেলে গোস্বামী আংকল ও রাখি দিদিমণি সবাইকে নিয়ে চললেন বড়ো বাঁধটার দিকে। বাঁধ মানে এখানে পুকুর বা জলাশয়। গোস্বামী আংকল সবাইকে সুবিশাল সেই পুকুরের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন, তাকিয়ে দেখো কত বড়ো!
সত্যি পুকুরটি যেমন লম্বা চওড়া তেমনি গভীরও। কিন্তু এক ফোঁটা জল নেই। শুধুমাত্র নিচের মেঝেটায় সামান্য ভেজা ভেজা। আর বাকি সবটুকুই শুকনো খটখটে।
গোস্বামী আংকল বাগান সম্পর্কে বলে চললেন, আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে হল্যাণ্ড থেকে অ্যান্থনি রে নামের একজন সাহেব এসে এই পুকুরটা খুঁড়েছিলেন। এই বাড়িটাও তাঁরই তৈরি। তিনি ভেবেছিলেন, নদী থেকে পাইপ দিয়ে জল তুলে এনে এই পুকুরে জমা রেখে, আশেপাশের জমিতে চাষ করা যাবে। কিন্তু…!
কিন্তু কী?
তিনি বলে চললেন, পুকুর খনন হল, ভারী ভারী মেশিন আনা হল। মোটা মোটা পাইপ এনে জমিতে যোগ করা হল। কিন্তু নদী যে শুকিয়েই চলেছে। দিনে দিনে আরও শুকিয়ে গেল। আগেও বর্ষার পরে জল বিশেষ থাকত না। এখন তো আরওই থাকছে না। এখন তো শুধু বালি। বালি আর বালি।
সইদূনরা শুনে যারপরনাই অবাক হয়ে গেল। নদী আছে অথচ জল নেই। এরকম হয় নাকি! ওর আব্বু শুনলেও হেসে গড়াগড়ি খাবেন। তিনি তো গাঙে গাঙেই ভেসে বেড়ান। তাঁর জীবন তো জলেই। ওদের ওখানে এত নদী যে গুণে শেষ করা যাবে না। ছোটনদীগুলো বড়ো নদীতে মেশে। বড়ো নদীগুলো গিয়ে মেশে সাগরে। সেখানে শুধু জল আর জল। আর এখানে! নদী আছে জল নেই!
সবাই মিলে গেল সেই নদী দেখতে। এই জায়গাটাও ভারী অদ্ভুত। পুকুর, জমি থেকে নদীটা আবার বেশ নিচুতে। এখানে নদীর গভীরতা বলে কিছু নেই। এমন নদী সইদূনরা আগে কখনও দেখেইনি। নদীটা কেমন অলস শুয়ে আছে। সেখানে এক ফোঁটা জল নেই৷
নদীটা কোথা থেকে এসে কোথায় গিয়েছে কে জানে!
এখানকার মাঠজমিনগুলো কেমন যেন। উঁচুনিচু। ঢেউ খেলানো।
গোস্বামী আংকল এখানকার বিবরণ দিয়ে চললেন,এখানে প্রধান সমস্যা জলের। অনেকদিন হলো বৃষ্টি নেই। মাঠ-পুকুর-জমি শুকিয়ে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে ফেটেফুটে চৌচির হয়ে গিয়েছে সেই কবে! আগে ফাল্গুনেই কালবৈশাখী শুরু হয়ে যেত। বৈশাখে বেশ কয়েকটা। এখন তো জষ্টিরও দশ হয়ে গেল। কোনোও কালবৈশাখির দেখা নেই। গরমে হাঁসফাঁস করছে সবাই।
ঘরের গোরু-ছাগল-হাঁস-মুরগিদের অবস্থা আরও খারাপ। মরেও যাচ্ছে অনেক। পাখিদের গলাতেও সুর নেই। ওদের কলকাকলিও এখন শোনা যায় না।
গোস্বামী আংকল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকলেন, এখানকার আকাশেও জল নাই। কখনও সখনও যে মেঘটেঘ করে না তা নয়। আমাদের এখানেও আছে শুশুনিয়া পাহাড়, দলমার পাহাড়–সেখানে কখনও সখনও মেঘ তৈরি হয় বটে! কিন্তু কোথা থেকে বাতাস এসে যে ওদের কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যায় কে জানে! মেঘমুলুকের দেখাও নেই, খবরও নেই।
আর সইদূনদের ওখানে! আকাশে মেঘ হলেই ভয়ে সিঁটিয়ে যেতে হয়। সেখানে মেঘ মানেই বৃষ্টি। বৃষ্টি হবেই হবে। জলবাদলের ঠ্যালায় সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। বৃষ্টি মানে নদীতে তখন বিরাট বিরাট ঢেউ। নৌকাডুবি হয়, লঞ্চডুবি হয়। আর কত মাঝিমাল্লা যে ডুবে মরে! এই তো গত সনে রহিম চাচা আর ফিরল না। নৌকাডুবি হয়েছিল।
সইদূন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, একই আকাশ। অথচ দুই জায়গায় দুই রকম। সইদূনের মনে কেন যেন কষ্ট হতে থাকে। কষ্ট হয় নদীটার জন্য, গোস্বামী আংকলদের জন্য।
এমন সময়ে হঠাৎ করেই আকাশে এক টুকরো কালো মেঘ দেখা দিল। তারপর এই মেঘের পিছনে আরও মেঘ। দলবেঁধে মেঘগুলো যেন উড়ে উড়ে এদিকেই আসছে।
ধীরে ধীরে ওদের মাথার উপরে গোটা আকাশটাকেই কালো মেঘে ঢেকে দিল।
রাখি দিদিমণি বললেন, এই সকলে পা চালা। ঘরে চল। এই মেঘে বৃষ্টি হবে। সইদূনদের সঙ্গে রাখি দিদিমণিও ছুটলেন। তারপর ছুটতে ছুটতে সবাই লাল দোতলা বাড়িটার ভিতরে গিয়ে ঢুকে পড়ল।
সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে উঠতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। এর চেয়েও মুষল ধারায় বৃষ্টি সইদূনরা মাঝেমধ্যেই দেখে। জোর বৃষ্টি নামলে সইদূনদের ভয় লাগে তখন। কিন্তু এখানে ভয় লাগল না। কারণ বাড়িটা যেমন বড়ো তেমনি শক্তপোক্ত। ওদের গ্রামে তো ইটের বাড়ি একটাও নেই। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওরা সবাই মিলে বৃষ্টি দেখতে থাকল। দেখল সেই বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে এখানকার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো, মাঠজমি এবং শুয়ে থাকা সেই নদীটাও।
সইদূনরা ঘরে ঢুকে জানালা দিয়ে দেখল, মাঠের মধ্যে গোস্বামী আংকল এবং এখানকার আরও কেউ কেউ বৃষ্টির মধ্যে খুশিতে নাচছে, গাইছে। কানে এল, ওরা গাইছে রিমঝিম রিমঝিম বিষ্টি, আহ্ বিষ্টির জল কী মিষ্টি! কী মিষ্টি!
ওরা বৃষ্টিতে ভিজতেই থাকল। ভিজতে থাকল সেই নদীটাও।
পাঠকদের মন্তব্য
250