ঋজুর বাড়ি ফেরা
অজন্তা সিনহা
হাইওয়ে ধরে নিজের কান্ট্রি সাইডের ফার্মহাউস থেকে
বাড়ি ফিরছিলেন ডাঃ জোসেফ মিলার, থাকেন ফিনিক্সে। গাড়ি চালাতে চালাতে ক্ষণিক আগের প্রাকৃতিক পরিবেশের ফেলে আসা মুহূর্তগুলির কথা ভাবছিলেন তিনি। হঠাৎই ছন্দপতন !! সামনে কী ওটা, একটা গাড়ি না ? আরে, এ তো তাঁদের প্রতিবেশী মিঃ মিত্রর গাড়ি। দ্রুত নিজের গাড়ি রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে এগিয়ে যান ডাঃ মিলার। একটা বড় গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে একদিকে কাত হয়ে রয়েছে গাড়িটা। যতটা বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে মিঃ মিত্র ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই রক্তাক্ত। দ্রুত পুলিশে খবর দেন তিনি। একটি অ্যাম্বুলেন্সও ডাকেন।
অনেক কষ্টে ঋজুকে ঘুম পাড়িয়েছে স্টেলা। রোজ রাতে সে ড্যাড আর মমের সঙ্গে ডিনার করে, তারপর ঘুমোতে যায়। আজ কেন নয় ? এত রাত হয়ে গেল, ওরা এখনও আসছে না কেন ? মম তো বলেছিল, ওরা বিকেলেই ফিরবে ! স্টেলা বলতে পারে না, ওরা আর কোনও দিনই ফিরবে না। সে ভেবে আকুল হয়, আজ নাহয় কোনও মতে ঘুম পাড়িয়ে ঋজুর এই সব প্রশ্ন সে এড়িয়ে গেল। কিন্তু তারপর ? কাল সকালে কী হবে ? রাত আটটা নাগাদ ফোনটা এসেছিল তাদের প্রতিবেশী ডাঃ মিলারের কাছ থেকে। মিঃ মিত্র স্পটেই মারা যান। মিসেস মিত্র হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ জীবিত ছিলেন। ‘ঋজু ঋজু‘ বলতে বলতেই শেষ নিঃশ্বাস পড়ে তাঁর।
স্কুল ছুটির দিনগুলোতে সচরাচর এত সকালে ওঠে না উৎসব। ফোনটা বাজতে তাই একটু বিরক্তই হয় সে ! তা সত্ত্বেও, একটা সময় ভদ্রলোকের বক্তব্য উৎসবের বোধগম্য হয় আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ছুটে যায় তার। ফোনটা করেছিলেন ফিনিক্স থেকে পিকুদাদের প্রতিবেশী ডাঃ মিলার। উৎসব দ্রুত মায়ের ঘরে যায়।
তাকে দেখে অবাক সবিতা প্রশ্ন করেন, কী রে ? আজ এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছিস ? স্কুল ছুটির দিনে ?
শোন মা। একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটেছে ! পিকুদাদের গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। ওঁরা…! বাকিটা শুনতে শুনতে সবিতা বসে পড়েন বিছানায়।
ঘুরে ঘুরে বাগানের গাছপালা দেখছিলেন বাণীব্রত। ওঁর সঙ্গে জলের বালতি, ঝারি, খুরপি ইত্যাদি নিয়ে চলমান ভোলা। বাগানপর্ব সেরে, তাকে বাজার ছুটতে হবে। ভোলা ভাবে, বাবু একটু তাড়াতাড়ি সারলে হয় ! গাছপালায় জল দিয়ে, শুকনো পাতা ইত্যাদি সাফ করে ঘরে ফেরে ওরা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবিতা। বাণীব্রত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার, তুই এখন এখানে। আজ বুঝি চায়ের পাট কুমুদিনীর হাতে ?
সবিতা ম্লান হেসে বলে, না দাদা আমিই বানাব। আগে তুমি ঘরে চলো। জরুরি কথা আছে।
উত্তর চব্বিশ পরগণার বাড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া করে বের হতে হতে একটু দেরি হয়ে যায় উৎসবের। মামু খবরটা জানার পর প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাড়িতে ডাক্তারের আসা-যাওয়া চলছে। এমন এক ঘটনার জন্য কেউই তো প্রস্তুত ছিল না। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও আসছে বারবার। সে নিজে বাবাকে হারিয়েছে ছোটবেলায়। তখন থেকে সে আর মা মামাবাড়িতে। তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় মামীও চলে গেলেন ক্যান্সারে। পিকুদা চাকরি পেয়ে আমেরিকা চলে যাওয়ার পর থেকে এই বাড়িতে তারা তিনটে প্রাণী। এবার ঋজু এলে, চারজন হবে। কোথায় আমেরিকার ফিনিক্স, কোথায় তাদের হৃদয়পুর! ঋজু পারবে মানাতে? ভেবেই বিষন্ন হয়ে যায় উৎসব। মানাতে তো হবেই ঋজুকে। আর তাদেরও।
গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখতে দেখতে নানাকথা ভেবে টেনশন হতে থাকে উৎসবের। ঋজুর ফ্লাইট দমদম আসার আগেই পৌঁছতে হবে তাকে। যথাসময়ে পৌঁছল তারা। ঋজুর সঙ্গে দেখা হওয়ার সেই দিনটি কোনওদিন ভুলবে না উৎসব। এয়ারপোর্টের গেট দিয়ে যে বালকটি বেরিয়ে আসছে, তার পুরো অবয়ব জুড়ে অদ্ভুত এক বিষন্নতা। ডাঃ মিলারের এক ছাত্র কলকাতায় আসছিলেন। ঋজুর ওদিকের যাবতীয় পাট চুকিয়ে তাঁর সঙ্গেই ঋজুকে পাঠিয়েছেন ডাঃ মিলার। ভদ্রলোকের সঙ্গে সৌজন্যপর্ব শেষ করে গাড়ির কাছে যায় ওরা।
—এসো ঋজু। আমি তোমার একজন আঙ্কল। আমরা এখন হৃদয়পুর যাব। ওখানে তোমার দাদু আছে। আর একজন ঠাকুমা।
—আমি তোমাকে চিনি কাকু। মায়ের অ্যালবামে তোমার ছবি দেখেছি–উৎসবকে অবাক করে বাংলায় বলে ওঠে ঋজু। দাদু আর পিস-ঠাকুমার কথাও জানি। বলতে বলতে গাড়িতে উঠে বসে সে। ড্রাইভারের তাড়ায় সম্বিত ফেরে, ঋজুর পাশে উঠে বসে উৎসব। রাস্তায় আর তেমন কোনও কথা হয় না। পরিস্থিতির কারণেই বোধহয় হঠাৎ এতখানি বুঝদার হয়ে গেছে ঋজু, ভাবে উৎসব।
একসময় হৃদয়পুরের বাড়িতে পৌঁছে যায় তারা। ঋজু বাড়িতে ঢুকতেই এক ঝলক খুশির বাতাস বয়ে যায়। বাণীব্রত, সবিতা–দুজনেই অনুভব করেন গভীর বেদনার অন্ধকারে ডুব দেবার সময় এটা নয়। এখন ঋজুকে কাছে টেনে নিতে হবে।
দিন কাটে ঘড়ির নিয়মে। ঋজু এখন অনেকটাই মিশে গেছে সবার সঙ্গে।
সবিতা বাণীব্রতকে ছলছল চোখে বলেন, দেখেছ দাদা, আমাদের বৌমা মেমসাহেব হলে কী হবে, ছেলেকে দিব্যি বাংলা শিখিয়েছে।
চিঠিতে লিখেছিল পিকু, ওরা ঋজুর জন্য একজন বাংলা শেখার টিচার রেখেছে–বিষন্ন গলায় বলেন বাণীব্রত।
কয়েকমাস পরের এক সকাল। ঋজুর ধাক্কায় ঘুম ভাঙে উৎসবের। ওঠো ওঠো কাকু, বাগানে যেতে হবে। আজ সেই গোলাপটা ফোটার কথা। দাদু কাল বলেছিল না ? চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসে উৎসব ! ঘুম জড়ানো গলায় বলে, আজ রবিবার ঋজু। আজ একটু আমায় ঘুমোতে দে প্লিজ।
নো প্লিজ কাকু। বাগানে যেতেই হবে। পিস-ঠাকুমা পর্যন্ত যাচ্ছে। ভোলা কাকু, কুমু পিসি সবাই যাবে গোলাপ ফুলটাকে দেখতে। আর তুমি যাবে না?
পাঠকদের মন্তব্য
250