ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্পগাথা / ডিসেম্বর ২০২৪

বিশাল সেই বনে

(শ্রদ্ধায় স্মরণে)

 

বিশাল সেই বনটি। চারিদিকে ছড়ানো-ছেটানো শাল, সেগুন আর গরান গাছ। সেইসব গাছে যখন ফুল ফোটে, তখন তার সুবাস ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বনের পশুপাখিদের মনে তখন খুশির আমেজ। গাছের ডালে বসে শিস দেয় পাখিরা। আর তার তালে তালে নাচতে থাকে পশুরা।

 

   এমনিতে পশু-পাখিদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। মিলেমিশে দিন কাটায়। একজনের অসুবিধা হলে, আরেকজন এগিয়ে আসে। তবে, সারা বছর কি সকলের সমান কাটে? যখন গরম পড়ে, তখন চারিদিক খাঁ-খাঁ করতে থাকে। হাঁসফাঁস করতে থাকে বনের পশু-পাখিরা। কাছাকাছি কোনো নদী-নালা নেই যে, সেখানে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। জলে শরীর ডুবিয়ে শীতল করবে শরীর।

 

    বনে বাস করত এক বিশাল হাতি। বয়সে সে ছিল সকলের বড়ো। বিরাট কান, সাদা ধবধবে দাঁত আর লতানো শুঁড়। বনের সবাই তাকে মেনে চলত। কোনো বিপদ হলেই সবাই ছুটে আসত তার কাছে–সে কি বলে তা জানতে। একটি চালাক শেয়ালও বসে থাকত। গরম পড়লেই শুরু হতো তার নানা অসুখ। হাঁচি, কাশি, গলা খুশখুশ–আরো কত কি ! পাথুরে মাটি। মাটির নিচে ঘর বানিয়ে যে থাকবে তারও উপায় নেই। ঘর বানাতে হবে মাটির ওপরেই। তা তো শেয়াল পারবে না। তাই মনে মনে অপর কোনো উপায়ের কথা ভাবত। ভেবে ভেবে তার মনে হয়, এই পাথুরে জমিতে হাতিই শুধু পারে একটা ঘর বানাতে। একবার ঘরটা বানানো হলে দেখে কে? হাতি মা সোজা-সরল, ওকে হাত করতে অসুবিধা হবে না। আগে মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে হবে। তারপরে হাতিকেই সরিয়ে দেওয়া যাবে ঘর থেকে। এখন দরকার হাতিকে দিয়ে ঘর বানানো।

 

   একদিন বিকেলে হাতি দাঁড়িয়ে ছিল একটা গরান গাছের তলায়। শেয়াল সে-পথ দিয়ে হাঁটছিল। হাতিকে দেখেই দু’হাত তুলে বলতে থাকল–

          হাতি ভাই, হাতি ভাই

          করছো তুমি কি?

          এই দেখ না তোমার তরে কলা এনেছি। 

শুনে তো হাতির খুশি আর ধরে না। কতদিন সে কলা খায়নি। পাকা কলা, আঃ! জিভে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে হাতির। হাসিখুশি মনেই বলল–

         কলা নিয়ে আমার কাছে      

         বিনিময়ে তার

         বল না তোকে দেব কি যে

         মুখ না করে ভার। 

এবার বলার সুযোগ পেল শেয়াল। ইনিয়ে-বিনিয়ে হাতিকে বলল–এ বনের সবার চেয়ে বড়ো তুমি। তোমার কিনা গরমে থাকার জায়গা নেই?

–কি করব? জায়গা পাব কোথায়?     

–গরমে মাথা গুঁজতে একটা ঘর বানাও।

–ঘর? সে আবার কি?

–তাই তো! ভুলে গেছি তুমি কখনো শহরে যাওনি। ঘর দেখনি।

–ঠিক ধরেছিস।

–তাহলে চলো আমার সাথে শহরে তোমাকে ঘর দেখাব।

 

    সেদিন রাতেই হাতি আর শেয়াল গেল ঘর দেখতে শহরে। কত মাঠ, পথ, নদী পেরিয়ে তারা একটা শহরে গিয়ে উঠল। আবছা আঁধারে শেয়াল হাতিকে অনেক ঘর দেখাল। হাতি বলল–এ-রকম ঘর আমি কেমন করে বানাবো?

–চালা-ঘর দেখাবো তোমাকে। সেটা বানাতে তোমার অসুবিধা হবে না।

–সেটাই দেখাও। দেখি, ফিরে গিয়ে বানাতে পারি কিনা!

 

   এবার শেয়াল হাতিকে নিয়ে গেল শহরের পাশে একটা ছোটো বাজারে। সেখানে অনেক চালা-ঘর ছিল। তার থেকে পাতার ছাউনি দেওয়া একটা ঘর দেখিয়ে শেয়াল বলল–এরকম ঘর, মনে হয় বানাতে পারবে।

 –তা পারব। হাতি কান দুলিয়ে, শুঁড় উঁচিয়ে বলল।

তারপর তারা ফিরে চলল তাদের বনে। অনেক পথঘাট পেরিয়ে বিকেল নাগাদ তারা বনে ফিরে এল।

পরদিন থেকে হাতি উঠে-পড়ে লাগল। বাঁশবন থেকে বাঁশ এনে তৈরি করল খুঁটি। একপাল ইঁদুর এসে খুঁট খুঁট করে পাথুরে মাটি কেটে বাঁশ পোঁতার মতো জায়গা করে দিয়ে গেল। হাতি শুঁড় দিয়ে ডাল নামিয়ে জড়ো করল বড়ো বড়ো শালপাতা। দেখতে দেখতে একটা ছিমছাম ঘর হয়ে গেল। হাতি দারুণ খুশি। সেবার গরমকালে হাতির কোনো অসুবিধা হলো না। রোদ উঠলে সে সোজা চলে যেত ঘরে। হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকতো ঘরে। বিকেলে যখন রোদ পড়ে যেত, তখন বের হতো ঘর থেকে। চারদিক থেকে ঘাসপাতা খেত।

 

এদিকে রোদ উঠলে আর পশু-পাখিদের কী করুণ দশা। রোদের গরমে শরীর ঝলসে যায়। সেবার হলো কী, এমনি এক রোদের দিনে যখন হাতি ঘরের মাঝে ঘুমিয়ে ছিল, তখন এক বাঘ এসে সেখানে হাজির। দরজায় ঠুক-ঠুক করে হাতিকে ডাকল। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় হাতির সে কী রাগ! শুঁড় উঁচিয়ে গলা ফুলিয়ে সে জানতে চাইল–

      কাঁচা ঘুম কে ভাঙালি

      এখন দুপুর বেলা?

      মিছা কথা বললে পরে

      মারব শুঁড়ে ঠেলা।

ভয়ে বাঘ জড়োসড়ো। হাত জোড় করে কান নাড়িয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলতে থাকল–

      হাতি ভাই হাতি ভাই

      কেন এমন কর?

      এই বনেতে তুমিই হলে

      সবার চেয়ে বড়ো।

      তোমার মতো ভালো পশু

      এই বনে আর নেই,

      একটু ঠাঁই দেবে ঘরে

      জীবন বাঁচাতেই।

বাঘের কথায় হাতির মন গলে গেল। বাঘও যে তার গুণ গাইছে, শুনে খুব ভালো লাগল তার। শুঁড় উঁচিয়ে একটু আওয়াজ করল। তারপর বলল বাঘকে–

     এই বনেতে বাস আমাদের

     এই বনেতে খাই,

     আয় না তবে দুইজনে

     এই ঘরে ঘুমাই।

কথা শুনে বাঘ প্রায় লাফিয়ে উঠলো। এত সহজেই যে তার মতলব হাসিল হবে, তা সে ভাবতে পারেনি। লেজ গুটিয়ে তাড়াতাড়ি সে ঘরে ঢুকে পড়ল। তারপর সটান ঘুম।

 

     কিছু সময় পরে সেখানে এলো এক হরিণ। গরমে সে আর পারছে না, জীবন যায় যায়। সেও ইনিয়ে-বিনিয়ে কান নেড়ে বলল—

    একটু থাকতে দেবে ভাই হাতি? আর যে পারছি না।

     –তবে আর কি করবে। চলে এসো ভেতরে।

হরিণ দেরি না করে ঘরে ঢুকে পড়ল। বাঘের পাশেই শুয়ে পড়ল সে। তারপর নাক ডেকে ঘুম। ঘরের এক কোণে কোনো মতে জায়গা হলো হাতির। পা গুটিয়ে, শুঁড় গুটিয়ে সে পড়ে থাকল।

    এবার এল ভালুক। এমনিতেই সে মিনিটে মিনিটে  শুয়ে পড়ে। আর তখন? গরমে হাঁসফাঁস। কি করবে সে? কোথায় যাবে? হাতিকেই বলা যাক না? সে লেজ তুলে হাতিকে বলল–

   বাঁচাও, বাঁচাও, ভাই

   আমি তো ভালুক,

   চাই না তোমার কাছে।

   তেমন তালুক।

   কেবল থাকতে দাও

   কোনো মতে ভাই।

   তুমি ছাড়া আজ আর

   কোনো গতি নাই।

হাতি আর কি করে? বনের পশু। এক সাথে আছে বহুদিন। তাই ওর বিপদে এগিয়ে তো আসতে হবেই। তাই ভালুকেরও জায়গা হলো ঘরে। সকলের জায়গা দিয়ে হাতির আর জায়গা হয় না। মাথা ঘরের মাঝে আর শরীর বাইরে। শরীর ঝলসে যাবার মতো হলো। তবু কিছু বলল না হাতি। চুপচাপ পড়ে রইল।

 

   এবার এল সেই চতুর শেয়াল। সাথে এক ডজন ছানাপোনা। দেখে তো হাতির চোখ চড়কগাছ। এবার সে কি করবে? তবে সে ভাববার সময় পেল না। তার আগেই শেয়াল বলে উঠল–চলে এলাম। ছেলেপুলে নিয়ে চলে এলাম তোমার কাছে। তুমি ছাড়া কে আছে আমাদের!

–কেমন করে থাকবে?

–সে ভাবতে হবে না তোমার। আমি সব ঠিক করে দেব। এক ডজন ছেলেপুলে। ভাগাভাগি করে সকলের সাথে ঘুমোবে। তিনটে ছানা থাকবে তোমার সাথে। আর আমি? আমি আর কোথায় যাব? যেখানে তুমি শুয়ে আছ, সেখানেই শুয়ে পড়ব।

   কথা শেষ হতে-না-হতেই শেয়াল ছেলেপুলেদের ভাগাভাগি করে সকলের সাথে শুয়ে পড়ল। আর নিজে? যেখানে হাতি শুয়েছিল, সেখানে শুয়ে পড়ল। হাতি বেচারা কি করে? ঘরে সকলের ঘুমোবার জায়গা করে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বাইরে।

 

  দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার চারটি পা অবশ হয়ে পড়ল। রোদে পুড়ে শরীর ধুকপুক করতে লাগল। এমন সময় একটি কাক এসে বসল হাতির ঘরের সামনের গরান গাছটায়। হাতিকে দেখে তার খুব করুণা হল। বেচারা! সহজ-সরল পশু পেয়ে সবাই তাকে ঠকাল। না, এরকম হতে দেওয়া যায় না। হাতিকে ডেকে বলল–

   কা কা কা

   আমি বনের কাক,

   সরল হবার সব বাসনা

   এবার পড়ে থাক।

   বের করে দাও সব কটাকে

   ঘাড়টি সোজা ধরে,

   যাও ফিরে যাও আবার তুমি

   তোমার ছোটো ঘরে।

–সে কেমন করে হয়? ওরা বিপদের সময় আমার কাছে এসেছে। কি করে ওদের বের করে দেব?–বলল হাতি।

 কাক বলল–তা ঠিক। তবে ওরা নিজেদের সুখের কথাই ভেবেছে। তোমার বানানো ঘর। তোমার কথা একটুও ভাবল না!

তা ঠিক। তবে–

তবে-টবে কিছু নয়। যারা নিজের সুখ ছাড়া আর কিছু বোঝে না, উপকারীর উপকার ভুলে যায়–তাদের কোনো মায়া-দয়া করা ঠিক নয়। এই বন তাহলে সে-সব পশুপাখি, যারা নিজের সুখ দেখে–পরের কথা ভাবে না, পড়শির কথা ভাবে না, তাতেই ভরে যাবে। আর দায়ী হবে তুমি তুমি।

–আমি?

–তুমি। তুমিই।

–তাহলে?

–এখুনি শুঁড় দিয়ে টেনে টেনে একটা একটা করে সব পশুকে বের করে দাও।

 

    কাকের কথায় হাতির চেতনা হলো। ঠিকই তো। এভাবে চললে এই বনে একদিন ভালো পশু-পাখি আর থাকবে না। এবার হাতি করল কী, ঘরে মুখ ঢুকিয়ে একটা একটা করে সব পশুকে বের করে দিলো। সবার আগে বের করল শেয়ালকে। তারপর বাঘ, হরিণ, ভালুক–সবাইকে। কাক বসেছিল গাছেই। সে সবাইকে শুনিয়ে বলতে লাগল—

  যদি সুখ চাও

  নিজেই বানাও

 ছোটো ঘর নিজেদের।

 ভালো নয় ছল,

 ঘর বে-দখল

 অকারণে বিভেদের।

এরপর থেকে পশু-পাখিরা নিজেরাই নিজেদের ঘর বানিয়ে দিন যাপন করতে লাগল।

 


পাঠকদের মন্তব্য

Tanuja Chakraborty লিখেছেন... ০৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪
ভারি সুন্দর আর চমৎকার গল্প! চমৎকার একটা বক্তব্য আছে। খুব ভালোলাগল।

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up