অদল-বদল
তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
(শ্রদ্ধায় স্মরণে)
দুমড়ি থেকে রওনা হবার সময়েই ধাবার মালিক বলেছিল–পছিম কোণে বিজলী চমকাচ্ছে বাবুজি, জোর তুফান উঠবে বলে মালুম হচ্ছে। একটু বসে যান, এ সময় গাড়ি নিয়ে রওনা হবেন না। কিন্তু রঞ্জন সে-কথায় কর্ণপাত করেনি। সে খুবই ভালো ড্রাইভ করে, গন্তব্যের কাছাকাছি এসে জি.টি.রোডের ধারে একটা ধাবায় অনির্দিষ্টকাল বসে থাকার ব্যাপারটা তার পছন্দ হলো না। কতটুকু আর পথ বাকি, এই তো একটু এগুলেই ডানদিকে পড়বে পরেশনাথের পাহাড়, তারপরেই বাঁদিকে নেমে গেলে কাতরাসগড়-চন্দ্রপুরার রাস্তা। সব মিলিয়ে পঞ্চাশ কিলোমিটারের মতো হবে। পথ খুব ভালো। সামনে ইলেকশন, কর্তৃপক্ষ একেবারে ঝকঝকে করে মেরামত করে রেখেছেন। দেখতে দেখতে চলে যাবে।
ফাঁকা রাস্তা। সন্ধে সাতটা বাজে। রাত নটার আগে লরিগুলো ছাড়বে না। তার আগেই সে চন্দ্রপুরা পৌঁছে যাবে। কিন্তু আট-দশ কিলোমিটার যেতে না যেতেই প্রবল বেগে ঝড় এসে পড়ল। ধুলোর ঘূর্ণিতে চারদিক অন্ধকার করে শুকনো পাতা উড়িয়ে বইতে লাগল প্রবল বাতাস। তারপরেই নামল ঝমঝম বৃষ্টি। মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, কাছে-দূরে শোনা যাচ্ছে বাজ পড়ার আওয়াজ। এই ধরনের বৃষ্টিতে ওয়াইপারে কোনো কাজই হয় না। উইন্ডশিল্ডের ভেতর দিয়ে পাঁচ হাত দূরেও কী আছে তা দেখা যাচ্ছে না। এভাবে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। রঞ্জন পথের পাশে গাড়ি থামালো।
পার্কিং লাইট অন করে রেখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক গজ দূরের একটা বড়ো ঝাঁকড়া গাছের নিচে দাঁড়াল রঞ্জন। মাথার উপরে ঘন পাতার আবরণ থাকায় এখানটায় বৃষ্টি পড়ছে না। বেশ ভালো লাগছে দাঁড়িয়ে থাকতে। চারদিকে অবিরাম বৃষ্টি পড়ার শব্দ, একটু বাদে বাদে বিদ্যুতের চমক। শহর বাজারে তো আজকাল আর এসব উপভোগ করার সুযোগ নেই। আধঘন্টা দেরি হলে কী এমন এসে যাবে।
অকস্মাৎ চারদিক তীব্র একটা নীল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। চোখ-ধাঁধানো, বুক-চমকানো আলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাজারটা বোমা ফাটার মতো বিকট আওয়াজ। সামান্য সময়ের পার্থক্য হলেও আলোটাই আগে দেখতে পেল রঞ্জন। কিছুক্ষণের জন্য তার সমস্ত শরীর আর চেতনা কেমন অবশ হয়ে রইল। তারপর মাথাটা একটু পরিষ্কার হলে বুঝতে পারল–কাছেই কোথাও বাজ পড়েছে। যে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে তার ওপরে নিশ্চয় নয়, তাহলে সে বাঁচত না। কিন্তু কোথাও, হয়তো পাশের তিন-চারটে গাছের মধ্যে কোনোটার ওপরে, উঃ! একটুর জন্য বেঁচে গেছে সে।
বাতাসে ওজোনের আঁশটে গন্ধ পেল রঞ্জন। বজ্রপাতের এক মিলিয়ন ভোল্ট বিদ্যুৎ আধার বাতাস চিরে নামবার সময় পতনের পথে প্লাজমা তৈরি করে। পদার্থের চতুর্থ অবস্থা প্লাজমা এবং তৈরি হয় ওজোন–অক্সিজেনের ভারি আইসোটোপ। বাতাস আগুন গরম হয়ে ওঠে। তার হাল্কা আঁচ টের পেল রঞ্জন। গায়ের লোম পুড়ে যাবার জোগাড়। বাজ পড়ার একটু পরেই আস্তে আস্তে ঝড়ের বেগ কমে এল। বৃষ্টিও। এখানে বেশিক্ষণ সময় নষ্ট হয়নি, মোট আধঘন্টা মতো। দুমড়ির এস. টি. ডি. বুথ থেকে রঞ্জন চন্দ্রপুরায় ভাইকে ফোন করে জানিয়েছিল তার পৌছতে ঘন্টা দুয়েক বড়ো জোর লাগবে। পিছল রাস্তায় সেটা আড়াই ঘন্টা হয়ে যাবে। তা যাক, তবু সাবধানে চালানো ভালো।
গাড়িতে উঠে রঞ্জন স্টার্ট দিল। মাথার মধ্যে–ঠিক মাথার মধ্যে নয়–শরীরের ভেতর কেমন যেন ঝিনঝিন করছে। ব্যথা বা শরীর খারাপ লাগা নয়, একটা অস্বস্তির ভাব। আসলে বাজ পড়ার সময় অত কাছাকাছি থাকার জন্য তার সমস্ত স্নায়ুতে বোধহয় একটু জোরালো ঝাঁকুনি লেগেছে। তার জন্যই এই অস্বস্তি।
তার বুক পকেটে কলম আর একটা ক্লিপওয়ালা পেনলাইট ছিল। সেগুলো এই ঝামেলায় পড়ে যায়নি তো?
একহাতে স্টিয়ারিং ধরে রঞ্জন অন্য হাত দিয়ে পকেটটা দেখতে গেল।
আরে! এ কী রকম হল ! তার জামার পকেট গেল কোথায়? সে কি ভুল করে আজ পকেট ছাড়া শার্ট পরে বেরিয়েছে নাকি? না, তার তো তেমন কোনো শার্ট নেই। তাছাড়া বেরুবার সময় বুক পকেটে পেনলাইট আর কলম রাখার কথা তার স্পষ্ট মনে পড়ছে।
অন্যমনস্কভাবে সে জামার ডানদিকেও একবার হাত দিল। এই তো! পকেটটা আসলে ডানদিকে। সেখানে কলম লাইট সবই রয়েছে।
কিন্তু অনেক ভেবেও রঞ্জন বুঝতে পারল না কী করে এমনটা হল। তার কোনো জামাতেই তো ডানদিকে পকেট নেই। সে রকম জামা সে কখনো দেখেও নি। তবে?
চিন্তায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ঘাম মোছবার জন্য পকেট থেকে রুমাল বের করতে গিয়ে আবার বিস্ময়! প্যান্টের ডান পকেটে রুমাল আর বাঁ পকেটে মানিব্যাগ চলে এসেছে। যা সে কখনো রাখে না।
আজ এসব হচ্ছে কী? তুচ্ছ ঘটনা বটে, কিন্তু খুবই আশ্চর্য ব্যাপার। অনেক ভেবেও রঞ্জন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলো না।
স্টিয়ারিংয়ের ওপর রাখা দুই হাতের দিকে নজর পড়ল তার। চমকের পর চমক–ঘড়িটা জায়গা বদল করে চলে গিয়েছে তার ডানহাতে। ডানহাতে সে কস্মিনকালেও ঘড়ি পরে না। কলেজে পড়বার সময় দু-একজন বন্ধুর দেখাদেখি আধুনিক হওয়ার মোহে ডান কবজিতে ঘড়ি বেঁধেছিল বটে, তারপর তার নিজেরই জিনিসটা ভালো লাগেনি। আজ কি কোনো কারণে ভুল করে সে ডানহাতে ঘড়ি পরেছে? নাঃ, এমন ভুল মানুষের হয় নাকি?
যাই হোক, এখন এ-নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। রাস্তা পিছল, সাবধানে গাড়ি চালাতে হবে। চন্দ্রপুরা পৌঁছে ভেবে দেখা যাবে এখন।
আরো মিনিট পনেরো পরে সামনে একটা শহরের আলো দেখা গেল। তার মানে কাতরাসগড় আসছে। আর দেড় ঘন্টা গেলেই চন্দ্রপুরা।
শহরে ঢোকবার মুখে রঞ্জনের মনে হলো কাতরাসগড় এত ছোট আর অনুজ্জ্বল দেখাচ্ছে কেন? সে তো বেশ বড়ো শহর। প্রচুর আলো, ভিড়, সিনেমা হল, দোকানপাট। আজ সব যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, চেনা জায়গা চেনা যাচ্ছে না।
বাঁদিকে একটা আয়না লাগানো পানের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল রঞ্জন। দোকানিকে জিজ্ঞাসা করল–ভাই, এটা কাতরাসগড় তো?
দোকানি অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল–কাতরাসগড় তো পেছনে ফেলে এসেছেন বাবুজি। এটা চন্দ্রপুরা টাউন। এই তো সামনে পোস্ট অফিস মোড়।
চন্দ্রপুরা! তা কেমন করে হবে? জি.টি রোডের ধাবা থেকে সে বড়োজোর পনেরো-কুড়ি কিলোমিটার এসেছে। আরো অন্তত চল্লিশ কিলোমিটার গেলে চন্দ্রপুরা আসার কথা। রঞ্জন কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সামনের আয়নায় চোখ পড়তে দেখল তার মাথায় চুলের সিঁথি ডানদিকে চলে এসেছে। হতবাক হয়ে গাড়িতে এসে বসল সে। ড্যাশবোর্ডের ওডোমিটারে দেখা যাচ্ছে সে শেষ থামার জায়গা থেকে মাত্র একুশ কিলোমিটার এসেছে। বাকি ঊনত্রিশ কিলোমিটার পথ সে কীভাবে কখন পার হল? সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? অথবা…! অথবা ওই বজ্রপাতই এর কারণ। আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান, বিশেষ করে কোয়ান্টাম ফিজিক্স আজকাল অদ্ভুত কথা বলছে। ত্রিমাত্রিক কোনো কারণে খুব বড়বড়ো রকমের ঝাঁকুনি লাগলে বস্তুজগতে এই রকম উল্টোপাল্টা পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু এর থেকে অব্যাহতির উপায় কী? ডাক্তার দেখাতে হবে, নাকি কোনো বৈজ্ঞানিকের কাছে যেতে হবে?
কিছুই করতে হলো না। কোনোরকমে গাড়ি চালিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রঞ্জন ভাইয়ের বাড়ির সামনে পৌঁছুবার সময়ে অনুভব করল আবার তার শরীরে অস্বস্তিটা হচ্ছে। একটু ঝিনঝিন, গা গুলোন ভাব। ভাইয়ের কোয়ার্টার্সে পৌঁছে প্রাথমিক আপ্যায়নের উচ্ছ্বাস কেটে গেলে একবার বাথরুমে গিয়ে রঞ্জন দেখল তার চুলের সিঁথি আবার বাঁদিকে ফিরে গিয়েছে, বুক পকেটও বাঁদিকেই। ঘড়িও বাঁহাতে। কী একটা অজুহাতে গাড়িতে গিয়ে ওডোমিটার দেখে এল সে। ঠিক পঞ্চাশ কিলোমিটার দেখাচ্ছে। তার মানে পরিবেশে ঝাঁকুনিসঞ্জাত গোলমাল হলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। ভাগ্যিস হয় না।
ভাইকে আর কিছু জানাল না রঞ্জন।
পাঠকদের মন্তব্য
250