ইছামতি নদীতে দুর্গা বিসর্জন যেন দুই বাংলার মিলনের উৎসব
দেবশ্রুতি মল্লিক
ষষ্ঠীতে বোধন, দশমীতে মা দুর্গার বিসর্জন! পুরাণ মতে এরপর মা ফিরে যাবেন কৈলাশে। এই হলো দুর্গাপুজোর পটভূমি !! এই বিসর্জনকে ঘিরে ইছামতি নদীর বুকে যে মিলনমেলার সৃষ্টি হয় প্রত্যেক বছর, আজ তোমাদের সেই গল্পই বলব। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী নদী ইছামতি যুগ যুগ ধরে মা দুর্গার বিসর্জনের অনন্য সাক্ষী হয়ে আছে। বলাই বাহুল্য, এখানে দুর্গা বিসর্জন শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি দুই বাংলার মানুষের মিলন ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন।
ভৌগলিক ভাবে ইছামতি নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত। এই নদীটি দুই দেশের সংস্কৃতি ও জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। দুর্গাপূজা উপলক্ষে নদীটির গুরুত্ব অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। কারণ, এখানে প্রতিবছর দুর্গা বিসর্জনকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মানুষ একত্রিত হয়। বলা বাহুল্য, এই মিলন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
ইছামতির তীরে দশমীর দিন সকাল থেকেই দুই বাংলার মানুষ নদীর পাড়ে জমায়েত হতে থাকে। নৌকায় করে মা দুর্গাকে নিয়ে যাওয়া হয় নদীর বুকে, যেখানে তাঁকে জলে সমর্পণ করা হয়। বিসর্জনের মুহূর্তটি থাকে অত্যন্ত আবেগঘন। কারণ, এটি একদিকে মা দুর্গাকে বিদায় জানানোর বেদনায় সিক্ত, অন্যদিকে তিনি আগামী বছর আবার ফিরে আসবেন এই আশায় পূর্ণ।
বিসর্জনের আগে নৌকা দিয়ে সাজানো হয় বিশাল শোভাযাত্রা, যেখানে দুই দেশের মানুষ নৌকায় চড়ে উৎসবে মেতে ওঠে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরাও এই মিলন উৎসবের সময় সহযোগিতা করেন। সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া উধাও তখন কিছুক্ষণের জন্য। একদিকে যেমন বিসর্জনের আচার পালন হয়, অন্যদিকে দুই দেশের মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে অদ্ভুত এক আবেগ-সঞ্জাত মিলন মুহূর্ত। দুই বাংলার চিরায়ত সম্প্রীতির মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
ইছামতির বিসর্জনে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বিষয় হলো নদীতে নৌকার শোভাযাত্রা। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ দুর্গা প্রতিমা নিয়ে নৌকায় ওঠে। প্রতিমাগুলিকে সুন্দরভাবে সাজানো হয় এবং নৌকাগুলোকেও রঙিন নানা সম্ভার ও আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়। যখন একের পর এক নৌকা প্রতিমা নিয়ে নদীতে ভাসতে থাকে, তখন পুরো নদীর বুক যেন এক অপূর্ব দৃশ্যকাব্যে পরিণত হয়। ভক্তি ও ভালোবাসার মিশেলে ভাসমান এই নৌকাগুলো ইছামতির বুকে এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে। আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন দুই বাংলার মানুষ। সুরের মূর্ছনা, ঢাকের তালে তালে ভক্তদের উদ্দীপনা–সবমিলিয়ে এক অনন্য পরিবেশ তৈরি হয়, যা শুধুমাত্র ইছামতির বিসর্জনেই দেখা যায়।
প্রতি বছর ইছামতি নদীতে দুর্গা বিসর্জনকে ঘিরে দুই বাংলার মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়ে ওঠে। বিসর্জনের সময় বাংলাদেশের মানুষ যেমন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিমা বিসর্জন দেখতে আসে, তেমনই পশ্চিমবঙ্গের মানুষও বাংলাদেশের প্রতিমা দেখতে আগ্রহী হয়। এই আদান-প্রদান যত না ধর্মীয, তার চেয়ে বেশি আবেগের ! বিসর্জন শেষে ইছামতির জলে মিশে থাকে দুই দেশের মানুষের আবেগাশ্রু। শুরু হয় আগামী বছর মায়ের আসার অপেক্ষার প্রহর গোনা।
***ছবি ঋণ ইন্টারনেট
পাঠকদের মন্তব্য
250