ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্প শুধু গল্প নয় / নভেম্বর ২০২৪

আরণ্যক

তুই ?! তুই আবার এসেছিস? বারণ করেছিলাম না, মন্দিরে উঠতে?–রাধাগোবিন্দ মন্দিরের পুরোহিত জগবন্ধু আচার্য বললেন।

ঠাকুরমশাই, আমি তো কোনো দোষ করিনি। দুটো পাকা তাল পেয়েছিলাম। আজ বাদে কাল জন্মাষ্টমী। তাই ভাবলাম মন্দিরে দিয়ে আসি–আরণ্যক বলল।

তোরা জাতিতে ব্যাধ। বনে-বাদারে ঘুরে বেড়াস। তোর দেওয়া কোন কিছু ঠাকুরের কাজে লাগবে না। তাছাড়া মহাভারতের কথা জানিস তুই ? এক ব্যাধের ছোঁড়া তীরের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন রাধাবল্লব শ্রীকৃষ্ণ।  তাই তোর তাল তুইই খা।–এই বলে লাথি মেরে মন্দিরের বারান্দা থেকে তালদুটো মাটিতে ফেলে দিলেন আচার্য।

 

প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো রাধাগোবিন্দ মন্দির। কথিত আছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। চারচালা বিশিষ্ট মন্দির–সামনে নাটমন্দির, পেছনে বিভিন্ন জিনিস রাখার জন্য একটি ঘর। দুইফুট আকৃতি বিশিষ্ট কৃষ্ণের মূর্তিটি কষ্ঠিপাথরে তৈরি আর অষ্টধাতুর তৈরি রাধার মূর্তিটির উচ্চতা দেড়ফুট হবে। মূর্তিদুটি খুব প্রাচীন–কৃষ্ণচন্দ্রের আমলের। মন্দিরের একটা ট্রাস্টি বোর্ড আছে। আর বংশ-পরম্পরায় এই রাধাগোবিন্দের পূজার দায়িত্ব জগবন্ধু আচার্যের উপরেই ন্যস্ত।

 

আরণ্যকদের বাড়ি মন্দিরের অনতিদূরে পলদা নদীর তীরে। তারা জাতিতে ব্যাধ হলেও, তাদের আচার ব্যবহার যথেষ্ট ভালো। সমস্ত মানুষকে তারা সম্মান করে, সকলের উপকার করে। তার বাবা রাজকুমার ব্যাধ পলদা নদীতে মাছ ধরে আড়তদারের কাছে বিক্রি করে। আরণ্যক ক্লাস এইটে পড়ে। কিন্তু পড়াশোনায় তার মন নেই। সে জঙ্গলে ঘোরে, গাছে গাছে চড়ে পাখির বাসা দেখে। কিন্তু বন্যপ্রাণীদের মারে না বা বধ করে না। আরেকটা জিনিস সে ভাল পারে–গুলতি ছুঁড়তে। গুলতি  দিয়ে গাছের আম, জাম, কামরাঙা ইত্যাদি ফল পাড়ে।

 

আরণ্যক যখন মন্দির থেকে নেমে এলো, তখন চারজন দর্শনার্থীকে মন্দিরে উঠতে দেখল সে। আরণ্যক দেখল, লোকগুলো এই এলাকার নয়। তারা মন্দিরে উঠে সমস্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তারপর নিজেদের ভেতরে কী সব আলোচনা করতে লাগল। আচার্যমশাই দর্শনার্থীদের পেয়ে একেবারে বিগলিত। তাদের সঙ্গে হাসিমুখে মাথা নেড়ে নেড়ে কথা বলতে লাগলেন। তারপর মন্দির চত্বর ঘুরিয়ে দেখালেন। আচার্য জানেন এই ভক্তরাই তাঁর আয়ের উৎস।

 

আরণ্যকের মনটা খারাপ হয়ে গেল। জাতপাত কি মানুষের গায়ে লেখা থাকে? তাছাড়া ভগবানের কাছে সবাই সমান। মানুষই জাতিভেদ প্রথা তৈরি করেছে। সে তো দেবতার পুজোর জন্যই উপাচার দিতে গিয়েছিল মন্দিরে। কিন্তু তাকে ঢুকতে দেওয়া হলো না। একদিন আচার্যকে শিক্ষা দিতে হবে। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিষন্ন মনে সে বাড়ির দিকে রওনা দিল।

পরের দিন সকালে ঘুমভাঙার পর দাঁত মেজে যখন পড়তে বসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল আরণ্যক, ঠিক তখন তার বন্ধু গুঞ্জন ছুটতে ছুটতে এলো।

আরণ্যক, শুনেছিস মন্দিরের মূর্তি চুরি হয়ে গিয়েছে।

কি বলছিস গুঞ্জন ! রাধাগোবিন্দের মূর্তি?  কী করে হলো?  চল তো গিয়ে দেখি।

 

গুঞ্জনের সঙ্গে আরণ্যক দৌড়ে চলল মন্দিরের দিকে। ওরা গিয়ে দেখল, মন্দির চত্বর লোকে লোকারণ্য। পঞ্চায়েত প্রধানসহ অনেক গণ্যমান্য লোক জড়ো হয়েছে। পুলিশ এসেছে। পুলিশের একজন পদস্থ আধিকারিক আচার্যমশায়ের সঙ্গে কথা বলছে আর খাতায় কি সব লিখে নিচ্ছে। আরণ্যক দেখল মন্দিরের প্রধান ফটক এবং দেবগৃহের তালা ভাঙা। মন্দিরের পেছনেই আচার্যের বাড়ি। তার কাছেই মন্দিরের চাবি থাকে। তাই অনেকেই ঠারেঠোরে আচার্যকে দোষারোপ করছে। আসলে এই মূর্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। তাই সকলের মুখেই বিষন্নতার ছায়া।

 

দুদিন পরের ঘটনা। আরণ্যক পলদা নদীর পারে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে দেখল একটা শেয়াল সামনের ঝোপের কাছে কী যেন করছে। পায়ের শব্দ পেয়ে শেয়ালটা তার দিকে তাকাল। আরণ্যক নিজের গুলতি তাক করার আগেই শেয়ালটা পালিয়ে গেল। সে এগিয়ে দেখল একটা শালিক পাখির ছানা মাটিতে পড়ে মুখটা হা করে ডাকছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল আরণ্যক। পাশেই একটা বড় আমগাছ চোখে পড়ল তার। আমগাছের ডালে বসে তারস্বরে চিৎকার  করছে দুটো শালিখ পাখি। তাহলে ওই দুটোই হবে এর বাবা-মা। সে দেখতে পেল, ওই ডালেই একটা বাসা রয়েছে। ছানাটাকে আলতো করে তুলে নিয়ে আমগাছে উঠল সে। তারপর বাসার কাছে গিয়ে দেখল, আরও দুটো ছানা রয়েছে।

আরণ্যক ছানাটাকে তার বাসায় রেখে নিচে নামতে যাচ্ছে, হঠাৎ তার নজর গেল নিচে  অদূরে নদীর ধারে চারজন লোক কী যেন করছে। লোকগুলোকে কোথায় যেন দেখেছি, খুব চেনা চেনা লাগছে। আরে এরাই তো সেদিন মন্দিরে গিয়েছিল। তারপর আচার্যের সঙ্গে কথা বলল, সবকিছু ঘুরে দেখল। কিন্তু এই সকালবেলা এরা কী করছে এখানে?

 

গাছ থেকে নেমে একটু এগিয়ে গেল সে। তারপর দেখল তিনজন মাটি খুঁড়ে রাধাগোবিন্দের মূর্তিদুটি তুলে আনছে। আর অপরজন পাশেই নদীতে একটা নৌকার ওপরে বসে আছে। ও! তাহলে এরাই চুরি করেছে মূর্তি! চট করে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তার হাতে একটা গুলতি আর পকেট ভর্তি থাকে ইটের টুকরো। গুলতিতে ইট ভরে তাক করল একজনের মাথা লক্ষ্য করে। তারপর গুলতির ছটকা ছেড়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘায়েল হলো লোকটা। বাকিরা কিছু বোঝার আগেই দ্বিতীয়বার আরেকটা ইট ছুড়ল গুলতিতে ভরে। এবারও লক্ষ্য ব্যর্থ হল না। তৃতীয়জন পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে ছুটে আসতে লাগল তার দিকে। কিন্তু জঙ্গলের অলিগলি তার থেকে আর ভালো কে চেনে?

 

আরণ্যক দৌড়ে হাঁপাতে হাঁফাতে চলে এল পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়িতে। তারপর খুলে বলল সমস্ত ঘটনা। পুলিশ ডাকা হল। তারপর দলবল নিয়ে চলল জঙ্গলের দিকে। অপরাধীরা তখনো পলদা নদীতে নৌকার ওপরে। অপরদিক থেকে পুলিশের একটা স্পিড বোট আসতে লাগল তাদের নৌকা লক্ষ্য করে। রিভলবার হাতে লোকটা শূন্যে দু-রাউন্ড গুলি চালালো বটে! কিন্তু তার প্রতিরোধ বেশিক্ষণ টিকল না। বামাল সমেত ধরা পরল মূর্তি চোরের দল।

 

রাধা অষ্টমীর দিন। পুলিশ ইন্সপেক্টর মন্দিরের সামনে পুরস্কার তুলে দিল আরণ্যকের হাতে। প্রধান সাহেব একটা লম্বাচওড়া বক্তব্য রাখল আরণ্যকের প্রশংসা করে। আর সবশেষে পুরোহিত জড়িয়ে ধরলেন তাকে। তারপর বললেন, কোন শিলায় কোন দেবতা থাকে, তা আমরা সত্যিই বুঝতে পারি না। আমাকে ক্ষমা করিস বাবা। তুই গ্রামের মুখ রক্ষা করেছিস। আজ থেকে মন্দিরে তোর অবাধ যাতায়াত…!

 

 


পাঠকদের মন্তব্য

Tanuja Chakraborty লিখেছেন... ১৫ই নভেম্বর, ২০২৪
শিক্ষামূলক গল্প। মানুষ শুধুই মানুষ ,তার কোনো জাত হয়না।খুব ভালোলাগল।

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up