বিড়াল কেন বাঘের মাসি
শংকর দেবনাথ
বাবুদের বাড়ি থেকে তাড়া খেয়ে মেনি আর ঘেনি পাশের বাগানে গিয়ে মনের দুঃখে চুপচাপ গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে।
ঘেনি নিচুস্বরে বলে, দিদি এভাবে তো আর তাড়া খেয়ে খেয়ে পারা যায় না।
মেনি বলে, হ্যাঁ, সেই ছোটবেলা থেকেই তো আমরা মায়ের সাথে তাড়া খেতে খেতে বড় হলাম। কতবার যে ঘরবাড়ি পাল্টাতে হলো। এই উদ্বাস্ত জীবন আর ভালো লাগে না। একটা কিছু করতে হবে আমাদের।
ভগবান আমাদের এমন জীবন দিয়েই যখন পাঠিয়েছেন, তখন তা মেনে নিয়েই বাঁচতে হবে। মা তো এই কথাই বলতেন আমাদের–ঘেনি হতাশার সুরে বলে।
মেনি সহসা যেন জেদি হয়ে ওঠে। বলে, না, এমন জীবন আর মেনে নেওয়া যায় না। কী দোষ করেছি আমরা ? আর দশটা প্রাণীর মতন আমরা কেন সুস্থ-স্বাভাবিক একটা জীবন পাবো না?
কী করতে চাস তাহলে? ঘেনির চোখে মুখে কৌতুহলের ছাপ।
আমরা ভগবানের কাছে নালিশ জানাবো–আমাদের কেন এমন পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর নিয়তি দিয়ে তিনি পৃথিবীতে পাঠালেন? আমাদের দেখতে প্রায় বাঘের মতো হলেও কেন আমাদের বাঘের মত শক্তি আর সাহস দিয়ে পাঠালেন না?
কিন্তু ভগবানের দেখা পাবি কীভাবে?
বনে গিয়ে তপস্যা করবো।
ঘেনির মনে সংশয়–যদি তিনি দেখা না দেন।
দেখা তাকে দিতেই হবে। যতদিন দেখা না পাই, আহার নিদ্রা ত্যাগ করে চোখ বুজে ভগবানকে ডেকেই যাব।
মেনি আর ঘেনি দুই বিড়াল বোন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অজানা বনের পথে।
অনেক কষ্ট করে নদী-খাল পেরিয়ে বনে পৌঁছে তপস্বীর বেশে একটা ঝোপের আড়ালে ধ্যানে বসে পড়লো মেনি আর ঘেনি।
মেনি ঘেনিকে সতর্ক করে দিয়ে বলে, ভগবানের দেখা পেতে হলে কিন্তু সমস্ত লোভ-লালসা ত্যাগ করে একমনে তার নাম স্মরণ করতে হবে দু’চোখ বুজে।
ঘেনি বলে, খিদে লাগলে কি হবে?
কিছুই খাওয়া যাবে না। এমন কি চোখ পর্যন্ত মেলেও দেখা যাবে না সামনে কোনো বিপদ এলো কী না। মরে যাই যাব।
আচ্ছা–বলে ঘেনি চোখ বুজল।
ভগবানের দেখা পাবার আশায় দুটি বিড়াল ‘তপস্বী‘ সেজে ধ্যানে মগ্ন। দিন যায়–রাত আসে। রাত যায়–দিন আসে।
গত হয়ে যায় তিন-চারদিন। ছোটবোন ঘেনি খিদে আর তৃষ্ণায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এভাবে না খেয়ে পারা যায় নাকি? ভাবে, দিদি তো গভীর ধ্যানে ডুবে আছে। আমি চুপি চুপি রাতে উঠে গিয়ে কোনো শিকার ধরে খেয়ে এলে দিদি কিছুতেই টের পাবে না।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। ঘেনি প্রতি রাতে নীরবে মেনির পাশ থেকে উঠে গিয়ে, খাল থেকে মাছ বা ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইঁদুর ধরে খেয়ে, আবার এসে ধ্যানে বসে পড়ে। মেনি কিছুই জানতে পারে না।
এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন। না খেতে খেতে, না ঘুমোতে ঘুমোতে মেনি ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়েছে। তবু সে তার প্রতিজ্ঞায় অটল। ভগবানের দেখা তাকে পেতেই হবে।
একদিন গভীর রাতে ঘেনি বেরিয়েছে শিকারে। হঠাৎ মেনি শুনতে পায়, তার নাম ধরে কে যেন ডাকছে। তবুও মেনি চোখ খোলে না, পাছে তার ধ্যান ভঙ্গ হয়।
আবার সেই কণ্ঠস্বর–মেনি, চোখ খোলো। তুমি যার দেখা পাবার জন্য এই কঠোর তপস্যা করছো, আমি সেই ভগবান, চেয়ে দেখ।
মেনির যেন বিশ্বাস হয় না। ভাবে, তার ধ্যান ভাঙানোর জন্য কেউ চালাকি করছে না তো?
চোখ খোলো মেনি! আর বলো কী চাও তুমি আমার কাছে?–বলে ভগবান তার মাথায় হাত রাখেন। আর সাথে সাথে মেনির মৃতপ্রায় শরীর যেন চনমন করে ওঠে প্রাণের শক্তিতে। মেনি এবার বুঝতে পারে, সত্যি তার আরাধ্য দেবতা তার ধ্যানে তুষ্ট হয়ে দেখা দিতে এসেছেন। আস্তে আস্তে চোখ খোলে মেনি। দেখে, তার সামনে দাঁড়িয়ে এক সুন্দর দিব্যমূর্তি। প্রণাম করে মেনি আবেগে গদগদ স্বরে বলে, আমি আজ ধন্য প্রভু। আমার মতো এক তুচ্ছ প্রাণীর ডাকে সাড়া দিয়ে আপনি যে চলে এসেছেন দেখা দিতে, তার জন্য আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই ঠাকুর।
ভগবান মৃদু হেসে বলেন, আমার চোখে আমার সকল সৃষ্টিই সমান। তুচ্ছ-উচ্চ বলে কিছু নেই। তোমার ভালোবাসার দৃঢ়তায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। বলো, কেন তুমি আমাকে ডেকেছো?
আপনি তো অন্তর্যামী প্রভু। সবই জানেন।
জানি, তবু তুমি কি চাও বলো?
আমি এমন একটা জীবন চাই, যেখানে কেউ আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না। বরং আমাকেই সবাই ভয় পাবে। ভয়ে ভয়ে তাড়া খেয়ে খেয়ে আর পারছি না ঠাকুর–বলে কেঁদে ফেলে মেনি।
ভগবান একমুহূর্ত ভাবেন। তারপর বলেন, তাই হবে। তোমার মনের ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
কিন্তু কীভাবে প্রভু ?
ভগবান মৃদু হেসে বলেন, তোমার বিড়াল রূপ তো আর পাল্টানো যাবে না। তবে তুমি বাঘের ঘরণী হবে এবং তোমার বাচ্চাকাচ্চা সবাই বাঘ হবে।
তোমাকে সবাই তখন সমীহ করে চলবে ‘বাঘের বউ’ আর ‘বাঘের মা’ বলে।
এরপর মেনি বলে, আর আমার ছোটবোন ঘেনির কী হবে? বলেই সে পাশে তাকায়। ভগবানকে পাওয়ার আনন্দে সে এতই মগ্ন ছিল যে এতক্ষন মেনি খেয়ালই করেনি তার পাশে ঘেনি নেই।
ঘেনি, ও ঘেনি কোথায় গেলি? দেখ, আমাদের তপস্যা সফল হয়েছে। ঘেনি-ই-ই–মেনি উচ্চস্বরে ডাকতে থাকে।
ভগবান মৃদু হেসে বলেন, ঘেনি এখন ঐ দূরের নালার পাশে চুপচাপ শিকার ধরার আশায় বসে আছে।
সে কি? অবাক হয়ে মেনি বলে, ঘেনি তাহলে আমাকে ফাঁকি দিয়ে…!
হ্যাঁ মেনি। ওর তপস্বী বেশের আড়ালে লুকিয়ে ছিল লোভ আর লালসা। ওর ওই ভন্ডামির জন্য মানুষ চিরকাল ভাল সেজে থাকা মানুষকে ওর উপমা দিয়ে বিড়ালতপস্বী বলবে।
একটু এদিক ওদিক চেয়ে দেখে ভগবান আবার বলেন, ওকে আমি দেখা দেব না। তাই ও আসবার আগেই আমি চলে যাচ্ছি। আর হ্যাঁ, কালই একটি বাঘ এসে তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে চলে যাবে তার ডেরায়–বলে ভগবান অন্তর্হিত হলেন।
আর সাথে সাথেই এসে পড়ল ঘেনি।
মেনি ঘেনিকে দেখে তার ভন্ডামির জন্য কিছুক্ষণ তিরস্কার করে। তারপর সব কথা খুলে বলে।
ঘেনি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে মিঁউ মিঁউ করে বলে–আমার তাহলে কি হবে দিদি? তোর তো একটা উপায় হলো।
মেনি তার বোনকে খুব ভালোবাসত। দুঃখিত হয় বোনের জন্য কিছু করতে না পেরে। বলে, তোর নিজের দোষেই তো তুই পেলি না ভগবানের কৃপা। আমি আর কি করতে পারি?
ম্যাঁও ম্যাঁও করে কেঁদে ফেলে ঘেনি। আর নিজের ভুলের জন্য আফসোস করতে থাকে।
মেনি সান্ত্বনা দিয়ে বলে, তোর কোনো ভয় নেই বোন। আমি যখন বাঘের মা হবো, তুই আমার বাচ্চাদের মাসিই তো হবি।
মানে?
তোর পরিচয় হবে বাঘের মাসি।
পাঠকদের মন্তব্য
250