ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্প শুধু গল্প নয় / মার্চ ২০২৫

অন্তুর অঙ্ক স্যার

ঘরের দরজা খুলে একটু দূরের পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে অন্তু ঘরে ঢুকে দেখল, কে যেন আগের অঙ্কের স্যারেরা যে চেয়ারে বসতেন, সেখানে বসে আছেন। ও মনে মনে ভাবল, নতুন স্যার হবে হয়তো! গতকাল রাতেই তো বাবা ওকে বলেছিল, তোর মাথায় অঙ্ক ঢোকে না, তোকে এবার কড়া অঙ্কের স্যার দিতে হবে। হয়তো ইনিই সেই।

 

ও আর দেরি না করে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, সরি স্যার আপনি বসে আছেন। দুটো পেয়ারা পেড়ে পড়তে বসব বলে ঘরে ঢুকেই দেখলাম আপনি। তারপর একটু থেমে বলল, আপনি কি অঙ্কের স্যার? আগেই বলে রাখছি আমার মাথায় কিন্তু অঙ্ক ঢোকে না। আপনাকে নিয়ে পাঁচজন অঙ্ক স্যার বাবা ঠিক করল, কিন্তু আগের চারজন অঙ্কের স্যার দুতিন মাসের বেশি আমাকে অঙ্ক শেখাতে পারেননি। তাই তাঁরা চলে গেছেন।

লোকটি হেসে বলল, তাই বুঝি? তুমি তাহলে অঙ্কে খুব কাঁচা? তা কোন ক্লাসে পড়ো?

অন্তু ভয়ে ভয়ে বলল, এবার ক্লাস ফোরে উঠেছি। অন্তুর কথা শুনে লোকটি এবার বলল, ঠিক আছে আমি তোমাকে এমন অঙ্ক শিখিয়ে দেব, কোনোদিন ভুলবে না। তারপর একটু থেমে–আজ কিন্তু অঙ্ক করব না,শুধু গল্প করব, প্রথম দিন তো !

 

অন্তুও মনে মনে ভাবল বেশ মজা তো ! ও আর কথা না বলে চুপ করে থাকল। লোকটি মনে মনে ভাবতে লাগল, ওই তো শোকেসে কষ্টি পাথরের গণেশের মূর্তি, যার ভেতরে খাঁটি সোনা ভরা, মূল্য দশ লাখ তো হবেই। এই তো সুযোগ! ভালো করে সব জেনেশুনে ঢুকেছি। অন্তুর বাবার অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা হয়ে যায়। ওর মা ভাইয়ের বাড়ি বীরপাড়ায় বেড়াতে গেছে। আর অন্তুর ঠাকুরদা সন্ধে হলেই টিভিতে নিউজ দেখেন,  নিউজ শেষ হলে ডিসকভারি চ্যানেলে যা হয়, সোফায় বসে দেখেন। এই ঘরে আর আসেনই না। ঠাম্মা তো সন্ধে হলেই রামায়ণ পড়েন। কাজের মাসি সরলা তখন সব কাজ সেরে মেঝেতে বসে রামায়ণ পাঠ শোনে। 

 

অঙ্ক স্যারকে চুপ করে থাকতে দেখে অন্তু বলল, স্যার কি দেখছেন শোকেসের দিকে তাকিয়ে? ওই গণেশের মূর্তি? ওই মূর্তিটা আমার জন্মের আগে ঠাম্মা আর দাদু হরিদ্বার থেকে এনেছিল, পেতলের মূর্তি। অন্তুর মুখে পেতল শুনে লোকটি চমকে উঠে বলল, সে কী ? তুমি ঠিক জানো ?

অন্তু এরপর আর কোনো কথা বলল না–শুধু স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগল, স্যার কি এত দেখছেন অমন করে ওই মূর্তিটার দিকে? ও এবার স্যারকে বলল, আপনি কি হাতে নিয়ে মূর্তিটা দেখবেন? তাহলে বসুন আমি ঠাম্মার কাছ থেকে শোকেসের চাবিটা নিয়ে আসি। বলেই অন্তু ভিতরের ঘরে চলে গেল।

 

অন্তু চলে গেলে লোকটি মনে মনে ভাবতে লাগল, ইস ছেলেটি কত সহজ-সরল, ইচ্ছে করলে কাচের শোকেসটা ভেঙে সোনার গণেশের মূর্তিটা নিয়ে চলে যেতে পারি। কিন্তু ছেলেটির কথা ভেবে মনে হচ্ছে, কাজটা ঠিক হবে না। বরং ওর আসার আগেই চলে যাই। এমন সময় অন্তু ঘরে ঢুকে বলল, স্যার এই নিন শোকেসের চাবি। লোকটি অন্তুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, না থাক। কাল তো আমি আসব, আজ আসি–বলে চলে গেলেন । অন্তু বলল, স্যার আপনি গণেশের মূর্তিটা দেখবেন না? লোকটি বলল, না আজ থাক, এখন আর দেখব না। কাল তো রোববার। আমি আসছি। তখন না হয় দেখব–বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।

 

অন্তু অবাক হয়ে ভাবতে লাগল স্যার আর একটু অপেক্ষা করতে পারল না! একটু অপেক্ষা করলেই তো বাবার সঙ্গে দেখা হতো। আবার ভাবল, স্যার তো বলেই গেল, কাল রোববার, বাবা বাড়িতে থাকবে, তখন আসবে। কিন্তু এভাবে চলে যাবে, সেটা ও ভাবতে পারেনি। অন্তু মনে মনে ভাবল, এই স্যার খুব ভালো, আগের স্যারদের মতো নয়। এদিকে বাবার আসার সময় হয়ে গেছে। পড়ার শব্দ না শুনলে রেগে যাবে। কিন্তু অন্তুর আজ পড়ায় মন বসছে না। শুধু মনে মনে ভাবতে লাগল, স্যার হয়তো কাল রোববার সকালে এসে বাবার সঙ্গে কথা বলবে। বাবা তো বলেছিল কড়া স্যার রাখবে। কিন্তু এই স্যার তো রাগী স্যার নয়, এঁকে রাখলে খুব ভালো হবে। আগের স্যারদের মতো নয়।

 

ঠিক এমন সময় অন্তর বাবা ঘরে ঢুকে বলল, কী রে, কেমন পড়াশোনা হচ্ছে? অন্তু বলল, বাবা আজ তোমার ঠিক করা অঙ্কের স্যার এসেছিলেন, অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প করে, এই তো একটু আগে চলে গেলেন। কাল তোমার সঙ্গে দেখা করবেন। অন্তুর কথা শুনে বাবা বলল, নাম জিজ্ঞেস করেছিস? অন্তু বলল নাহ্। তারপর একটু থেমে বলল, কাল তো আসবেনই, তখন জেনে নেব। অন্তুর বাবাও আর কথা না বলে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।

 

সকালে ঘুম থেকে উঠে অন্তুর বাবা দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে সরলাকে বলল, চা হয়েছে কি, তাহলে দাও–বলে সোফায় বসে খবরের কাগজটা পড়তে যাবে–এমন সময় ডোর বেল বেজে উঠল। এত সকালে কে আবার এলো? উঠে গিয়ে দরজা খুলে বলল, ও আপনি, আসুন ভেতরে, বলেই অন্তুকে ডেকে–কাল কি ইনি এসেছিলেন? অন্তু নতুন স্যারকে দেখে বলল, না তো! অন্তুর বাবা বলল, আপনি কাল আসেননি? নতুন স্যার বললেন, নাহ্। আমি তো কাল আসিনি।

অন্তুর বাবা বলল, সে কী ? তাহলে কে এসেছিল? আমার ছেলের সঙ্গে গল্প করে গেছে–এও বলে গেছে, আজ আসবে।

অন্তু আর কোন কথা না বলে ভেতরের ঘরে চলে গেল। এমন সময় সরলা দু'কাপ চা আর বিস্কুট নিয়ে এসে টেবিলে রেখে গেল। অন্তুর বাবা স্যারকে বলল, নিন, চা খান। তারপর একটু থেমে বলল, আমার ছেলেকে তো দেখলেন। ওকে অঙ্ক শেখাতে হবে। ও সব বিষয়েই ভালো, শুধু অঙ্কে ভীষণ কাঁচা। নতুন স্যার বললেন, সে বিষয়ে ভাবতে হবে না।

 

এরপর আবার ডোর বেল বেজে উঠল। অন্তুর বাবা মনে মনে ভাবল, আবার কে এলো? দরজা খুলে দেখল পাড়ার দেবুদা। মুখে বলল, কী খবর দেবুদা?

দেবুদা বললেন, তোমার একটা চিঠি আছে। আমি  স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় এক ভদ্রলোক আমার হাতে চিঠিটা দিয়ে বললেন, আপনি তো ওদিকেই যাচ্ছেন–এই চিঠিটা অনীশ সামন্তকে দিয়ে দেবেন। তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ট্রেনে উঠে গেলেন। আর ট্রেনও সেই মুহূর্তে ছেড়ে দিলো, আমি আর কথা বলতে পারিনি। দেবুদার কথা শুনে অন্তুর বাবা বলল, বসুন, একটু চা খেয়ে যান। জবাবে দেবুদা–না ভাই, আজ নয়, অন্যদিন। দেবুদা চলে যাবার পর অন্তুর বাবা নতুন স্যারকে বলল, তাহলে ওই কথাই থাকল। কাল থেকে সন্ধের পর আসবেন। নুতন স্যার বললেন, ঠিক আছে।

 

নতুন স্যার চলে যাবার পর অন্তুর বাবা চিঠির খাম খুলে পড়তে পড়তে চমকে উঠল ! চিঠিতে লেখা–অনীশবাবু গতকাল রাতে আমি এসেছিলাম আপনাদের মহা মূল্যবান গনেশ মূর্তিটা চুরি করতে। কিন্তু আপনার নিষ্পাপ সহজ-সরল ছেলেকে দেখে আর ওর কথায় আমি হেরে গেছি। আমার চুরি করার সুযোগ থাকলেও চুরি করতে পারিনি। আমি আর এসব কাজ করব না। তাই এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আপনার ছেলে একদিন বড় মনের মানুষ হবে। আপনি চিন্তা করবেন না, ভালো একজন মাস্টার ঠিক করলেই হবে। ওকে ভালোবাসা দিয়ে পড়ালেই ও সব শিখে যাবে। আর বিশেষ কিছু লেখার নেই, আমার প্রণাম নেবেন।

 

অন্তুর বাবা চিঠিটা পড়ে মনে মনে ভাবল, তাহলে গতকাল রাতে স্যারের ছদ্মবেশে চোর এসেছিল! ভাগ্যিস অন্তুর কোন ক্ষতি করেনি। অন্তুকে চিঠির কথা না বলে বাবা বলল, তোর গতকালের স্যার বাইরে চলে গেছে। তাই তোকে পড়াতে পারবে না। চিঠি লিখে দেবুদার হাতে দিয়ে গেছে। অন্তু শুধু বলল, গতকালের স্যার সত্যিই আসবে না? ওর বাবা বলল, না। অন্তু আর কথা না বলে ঠাম্মার ঘরে চলে গেল। অন্তুর বাবাও আর কথা না বলে মনে মনে ভাবতে লাগল, তাহলে গতকাল রাতে স্যার নয়, চোর এসেছিল! কী সাংঘাতিক ব্যাপার, ভাগ্যিস কোনো ক্ষতি করেনি!


পাঠকদের মন্তব্য

কণিকা দাস লিখেছেন... ০৯ই মার্চ, ২০২৫
খুব সুন্দর গল্প টা। শিক্ষামূলক ও বটে।

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up