বাঘের নাম মধু
শর্বরী ব্যানার্জী আচার্য
জঙ্গলের প্রতি আকর্ষণটা আমাদের পারিবারিক। তাই ছুটিছাটায় বেড়াতে গেলে আমাদের লক্ষ্যে বেশিরভাগ সময়ই থাকে দেশের কোনও না কোনও অরণ্য। গত এপ্রিলে এই উপলক্ষেই আমরা রওনা দিলাম মহারাষ্ট্রের নাগপুরের উদ্দেশ্যে, লক্ষ্য সেখানকার টাডোবার জঙ্গল। উত্তরবঙ্গের নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে শিয়ালদহ–তারপর কলকাতার শালিমার স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে নাগপুর পৌঁছতে যে দীর্ঘ ট্রেন যাত্রা, তার পুরোটাই ছিল অধৈর্য অপেক্ষা। তখনও জানি না, অপেক্ষার শেষে কী অসাধারণ প্রাপ্তি রয়েছে আমাদের জন্য। তোমাদের জানাই, এর আগে আমরা আসামের কাজিরাঙা, মানস এই দুটি অভয়ারণ্যে গন্ডার, হাতি, প্রচুর দেখলেও–বাঘের দর্শন পাইনি। বুঝতেই পারছ, বাঘমামার মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারটাই আলাদা।
রাতটুকু নাগপুরের এক হোটেলে থেকে পরদিন রওনা দিলাম টাডোবার জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। দুপুর আড়াইটায় আমাদের জিপ সাফারি, নাগপুর থেকে সকাল ১০টায় মধ্যে আমাদের রওনা দিতে হবে–পৌঁছাতে লাগবে প্রায় তিনঘন্টা। গাড়ির চালক জানাল, এটাই নাকি বাঘ দেখার মরশুম। এপ্রিলের গরমে বাঘেরা জল খেতে জঙ্গল থেকে বাইরে আসবেই–অর্থাৎ আমাদের বাঘমামার দর্শন পাক্কা। জঙ্গলের সীমানার মধ্যেই আমাদের একটি লজ বুক করা ছিল। লজটি দেখাশোনা করে লজের গা ঘেঁষে থাকা মালিকের পরিবারের সদস্যরাই। এরা সকলেই গোন্ড আদিবাসী। এদের আতিথেয়তা চমৎকার।
লজে পৌঁছে স্নান ও লাঞ্চ সেরে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। এরপর জিপসি এলো আমাদের মূল জঙ্গলের প্রবেশ দ্বারে পৌঁছে দেবার জন্য। প্রসঙ্গত জানাই, দুমাস আগেই আমরা অনলাইনে সাফারির টিকিট করে রেখেছিলাম। সাফারি জোনের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে টিকিট দেখিয়ে অন্য একটি জিপসিতে উঠতে হলো জঙ্গল সাফারি করবার জন্য। জঙ্গলে প্রবেশের শুরুতেই দেখলাম, একদল বাইসন রাস্তা পার হচ্ছে। জিপ এগিয়ে চলছে–মাঝে মাঝে ময়ূর, হরিণ দর্শনও হয়ে গেল।
গাইডের কাছে জানতে পারলাম এলাকার বিখ্যাত বাঘদের নাম হলো মধু, শম্ভু, দাড়িওয়াল, কলারওয়ালি, ডাবলু মার্ক, ওয়াই মার্ক, ছোটা মটকা ইত্যাদি। জঙ্গলে নাকি ১৪১টার ওপরে বাঘ আছে l আরও জানলাম–শম্ভু এলাকার রাজা। মধুর তিনটে বাচ্চা আছে, বয়স ১১ মাস। ডাবলুরও তিনটে বাচ্চা আছে আটমাস বয়সী। ওয়াই মার্ক লাজুক, তাই, সচরাচর বাইরে দেখা যায় না তাকে। এভাবে গল্প শুনতে শুনতে অনেকটা পথ পেরিয়েও বাঘের দেখা না পেয়ে যখন ভাবছি কপাল খারাপ আমাদের, তখনই আমাদের জিপ এবং অন্যান্য সব জিপ থেমে গেল। চোখের সামনে প্রথমে দেখলাম কতগুলো হরিণ দৌড়ে পালাচ্ছে আর পেছনে ছুটে আসছে আমাদের বহু প্রতীক্ষিত রয়াল বেঙ্গল টাইগার।
জানা গেল, ইনি হলেন মধু–বাচ্চাদের জন্য খাবার সংগ্রহের উদ্দেশ্যে শিকার করার জন্যই এই ছোটাছুটি। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না নিজের চোখকে–এত কাছ থেকে বাঘ দেখে এককথায় স্তম্ভিত আমরা সকলেই। ঘোর কাটতে না কাটতে, জিপসি একটু দূরে যেতেই দেখি সামনে একহাত দূরে একটি চিতাবাঘ দাঁড়িয়ে আছে, আর তার পিছনেই ‘হালুম’ গর্জন–গাইড বলল, ওটা ওয়াই মার্কের ডাক। গর্জন শুনেই চিতাবাঘটি উঠে পড়ল সামনের গাছে। আমরা প্রায় ১৫ মিনিট অপেক্ষা করলাম, কিন্তু চিতাবাঘ নামল না। বুঝলাম রয়াল বেঙ্গল টাইগারকে চিতাবাঘও ভয় পায়।
সেদিনের মতো সাফারি শেষ হলো সন্ধ্যা ৬.৩০-এ। পরদিন ছিল দু’বেলা সাফারি–সকাল ৫.৩০ থেকে ১০. ৩০ পর্যন্ত দেবড়া জোনে এবং বিকেলের সাফারি ছিল গতদিনের সময়েই জুননা জোনে। সকালের সাফারিতে আমরা মুগ্ধ হলাম ডাবলুর বাচ্চাদের খেলা দেখে। তারপর বিকেলে সাফারির শেষ পর্যায়ে এসে গাইডের কাছে খবর পেলাম যে মধু ঘুরছে কাছাকাছি। গাইড জিপসি চালককে জঙ্গল ছেড়ে হাইওয়েতে উঠতে বলল এবং সেইমত একটা নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে মধুকে দেখার অপেক্ষায় রইলাম আমরা।
বেশ কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ আমাদের দলের একজন দেখতে পেল মধুকে। আমরা রাস্তার ওপরে আর মধু অনেকটা নিচে। তাই ভালো দেখা যাচ্ছে না। তখন গাইড বলল, এমন একটা রাস্তায় জিপসি নিয়ে দাঁড় করাবে, যেখান দিয়ে মধু বাচ্চাদের কাছে ফিরবে এবং আমরা সামনে থেকে মধুকে দেখতে পাবো। যেমন বলা তেমন কাজ, আমরা এগোচ্ছি, পেছন পেছন আরও জিপসি আসতে লাগল। তারপর সব গাড়ি সারি সারি দাঁড়িয়ে পড়ল। আমরা অধীর আগ্রহে, দুরু দুরু বক্ষে সেই পরম ক্ষণের অপেক্ষায় রইলাম। হঠাৎ গুঞ্জন মধু আসছে। সত্যিই তিনি এলেন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে গর্জন করতে করতে রাজকীয় চালে। গাড়ি এগিয়ে চলে, মধু পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যায় সকলকে অবজ্ঞা করে। আমাদের সকলের গলা শুকিয়ে কাঠ, একি দেখছি! ভাগ্যিস ভয়ে চিৎকার করিনি। মনে মনে তখন একটাই কথা বলছি, রক্ষা করো বাঘমামা !!
ছবি : লেখক
পাঠকদের মন্তব্য
250