ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্প শুধু গল্প নয় / জুন ২০২৪

ছিল খাদ হলো পথ

পর্ব : ৩ (শেষ পর্ব)

 

মেদিনীপুর-হুগলি-বর্ধমানের সম্পন্ন লোকেরা দল বেঁধে তো চলল কলকাতায়। এবার দেখা যাক কলকাতার সুরক্ষা কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে! বর্গিদের হাঙ্গামার কথা জানিয়ে শহরের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য কোম্পানির সদর দপ্তরে চিঠি লেখা হলো। তাঁরা যদিও এই জাতীয় আশঙ্কার কথায় কান দিলেন না। পরে বললেন, খরচ তেমন না বাড়িয়ে সামান্য কিছু করে ফেলতে পারো। বিলেতের কর্তারা হাত ধুয়ে ফেললে স্থানীয় কর্তারা আপন প্রাণ বাঁচাতে যা কিছু ব্যবস্থা ছিল তা দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা মজবুত করতে চাইলেন। উত্তরে বাগবাজারে পেরিন সাহেবের বাগানে বসল চারটে কামান। এ বাগান হলো সাহেব-মেম সাহেবদের হাওয়া খাওয়ার জায়গা। সাহেবদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাকি ছয় কামানও বসানো হলো তাদের পাড়ার ছটি ঘাঁটিতে I

 

কর্তাদের মুখ চেয়ে এ দেশের মানুষেরা এতকাল বসেছিলেন | সাহেবদের এমন কাণ্ডে বিব্রত ও বিরক্ত হয়ে তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তা পরিকল্পনা নিজেরাই করলেন। ঠিক করা হলো শহরের পশ্চিম দিয়ে বহমান গঙ্গা। উত্তরে বাগবাজারে গঙ্গার পাড় ছুঁয়ে শহরকে বেড় দিয়ে দক্ষিণে খিদিরপুরে গঙ্গা পর্যন্ত প্রায় সাত মাইল লম্বা একশো ত্রিশ ফুট চওড়া একটা খাদ কাটা হবে। এ খাদ টপকে ঘোড়া শহরে ঢুকতে পারবে না। পরিকল্পনা করে তাঁরা বসে রইলেন না, কোম্পানির কাছে পঁচিশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে খাদ কাটার কাজও শুরু করে দিলেন। তরতর করে কাজ এগিয়ে চললো। খাদ কাটা যখন দক্ষিণে বেকবাগান পর্যন্ত পৌঁছেছে, তখন খবর এল বর্গিদের সঙ্গে নবাব এক রফায় এসেছেন। বর্গির হাঙ্গামার আশঙ্কা স্তিমিত হয়ে এল। তাই খাদ কাটা বন্ধ হল। কাটা খাদ যেমন ছিল তেমন পড়ে রইল, বছরের পর বছর।

 

তারপরে কত কাণ্ড হয়ে গেল। আলীবর্দির মৃত্যুর পর তাঁর দৌহিত্র তরুণ সিরাজউদ্দৌলা নবাবের আসনে বসলেন। সাহেবদের শায়েস্তা করতে কলকাতা আক্রমণ করে দখল করলেন। তিনি মুর্শিদাবাদে ফিরে গেলে ইংরেজরা নতুন সেনাধ্যক্ষ রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে কলকাতা পুনরুদ্ধার করল। শুধু তাই নয়, সিরাজের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে পলাশির যুদ্ধে নবাবকে পরাজিত করে ক্রমে এদেশের রাজা হয়ে উঠল। মুর্শিদাবাদ থেকে রাজধানীও উঠে এল কলকাতায়। শহর বাড়ছে, শহরের রাজ্যসীমা বাংলা ছাড়িয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। নানা কর্মকান্ডে কর্তারা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

 

রাজধানী শহর গড়া, অনেক বড় করে কেল্লা গড়া হলো, শহরে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশি ব্যবস্থা, আয় বাড়াবার জন্য করের ব্যবস্থা। আধখানা কাটা খাদ সেই অবস্থায় পড়ে রইল। না, ঠিক তেমন অবস্থায় নয়, এটি হল শহরবাসীর আবর্জনা জমা করার জায়গা। আবর্জনার স্তূপ শহরে সংক্রামক রোগের উৎস হিসাবে চিহ্নিত হলো। ততদিনে কাটা খাদের বয়স ছয় দশক হতে চলেছে। তখন নগর উন্নয়নের দিকে নজর পড়ল। ১৭৯৪-তে নগর পরিকল্পনার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হল একদল বিশিষ্টজনের হাতে, তাঁদের নাম হল জাস্টিসেস অফ পিস। তাঁরা ঘুরে ঘুরে কলকাতা দেখলেন। কাটা খাদের ভেতর জঞ্জালের স্তূপ দেখে তাঁদের চোখ কপালে উঠল! আরে এই জঞ্জালই তো কলকাতার অনেক রোগের সংক্রমণের কারণ। একে হঠাতেই হবে। তবে কীভাবে? এটা বুজিয়ে চমৎকার রাস্তা তৈরির হুকুম হলো।

 

১৭৪৩-এ কাটা খাদ, বুজে গেল ১৭৯৯-এ। সাবেক খাদের রেখা ধরে শ্যামবাজার থেকে খিদিরপুর পর্যন্ত প্রশস্ত সড়ক পথ আপার ও লোয়ার সার্কুলার রোড হল মারাঠাদের আক্রমণ ঠেকাতে পরিকল্পিত ও বর্ধিত খাদের রেখা ধরে। আপার ও লোয়ার সার্কুলার রোডের নব নামকরণ হয়েছে দুই বিখ্যাত বাঙালি মনীষী বিজ্ঞানী যথাক্রমে আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বসুর নামে। আর মারাঠা আক্রমণ ঠেকাতে এই খাদ কাটা হয়েছিল বলে তার স্মৃতিতে বাগবাজার অঞ্চলে একটি গলি রয়ে গেছে যার নাম মারহাট্টা ডিচ লেন।

 

কলকাতার আরও দুটি জলপথের সড়ক পথে বদলে যাবার কথা এ প্রসঙ্গে বলতে ইচ্ছে করছে। ক্রিক মানে নদীর খাঁড়ি। প্রাকৃতিক কারণে নদী বা সাগর থেকে কোথাও কোথাও খাঁড়ি বা খাল বের হয়। স্থলভাগে বেশ কিছুটা ঢুকে আসে। কলকাতায় গঙ্গারও এমনি একটি খাঁড়ি ছিল। বি বা দী বাগ অঞ্চলে গঙ্গা থেকে বর্তমানের হেয়ার স্ট্রিট, গণেশ চন্দ্র এভিনিউ, ক্রিক রো হয়ে মৌলালি-বেলেঘাটা পেরিয়ে সোজা লবণহ্রদে এসে পৌঁছেছিল। ১৭৩৭-এর পুলস্কার ঝড়ে গোবিন্দরাম মিত্রের কুমোরটুলির গগনস্পর্শী নবরত্ন মন্দিরের চূড়া ভেঙে পড়ে। ইংরেজ খ্রিস্টানদের উপাসনালয় সেন্ট অ্যানে চার্চ ভূ-লুণ্ঠিত হয়। সেই ঝড়ে এক মস্ত জাহাজ গঙ্গার খাঁড়ি পথে ঢুকে বেশ কিছু জল ঢুকে আটকে যায়। কলকাতার শ্রীবৃদ্ধিতে নাগরিক প্রয়োজনে এ খাঁড়ি বুজিয়ে পথ হয়েছে–তার স্মৃতি ক্রিক রো, ক্রিক লেন নামের রাস্তায় বেঁচে আছে।

 

আর একটি খাল কাটা হয়েছিল উল্টোডাঙার কেষ্টপুর ক্যানালের মুখ থেকে, কলকাতার পূর্ব সীমানা দিয়ে গড়িয়ার দিকে যার গতিপথ ছিল। আমরা ছোটবেলায় গত শতকের চারের দশকের শেষে আমাদের নারকেলডাঙ্গার বাসস্থান থেকে ১ পয়সা দিয়ে নৌকা ফেরিতে খাল পেরিয়ে চিংড়িঘাটায় ভেরির মালিক মহেন্দ্রনাথ ঘুঘুর পারিবারিক দুর্গা প্রতিমা দেখতে যেতাম। বিখ্যাত প্রতিমা শিল্পী রমেশ কয়েকটি সার্বজনীন পূজা ছাড়া একটি মাত্র পারিবারিক পূজার নাকি প্রতিমা গড়তেন–যেটি হলো এই চিংড়িঘাটার মহেন্দ্রনাথ ঘুঘুর পারিবারিক দুর্গা প্রতিমা।

 

সল্টলেক উপনগরী গড়ে ওঠার প্রথম যুগের বাসিন্দাদের স্মৃতিকথায় পড়েছি, গত শতকের সাতের দশকের বাসিন্দারা শেষ বিকেল হলে মোটামুটি দল বেঁধে এসপ্লানেডের ১৪ নং বাস গুমটিতে জড়ো হয়ে এক বাসে ফিরতেন। শুনেছি নিউ কাট ক্যানালের ফেরি পেরিয়ে কারো বাড়ি থেকে বয়ে আনা লণ্ঠনের আলোয় পথ দেখে বাড়ি ফেরার গল্প। সেই নিউ কাট ক্যানালও এখন ভ্যানিশ। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস সে ক্যানালকে গিলে ফেলেছে। মানুষের প্রয়োজনে শুধু ক্যানালই পথ হয় নি, অনেক পরিকল্পনা করে ভেরি অঞ্চলের বিশাল জলাশয় বুজিয়ে লবণহ্রদ উপনগরীও গড়ে উঠেছে। নগরায়নে থাকার আরো কত সাধ–তাই শ্যামল প্রকৃতি কোথায় মুখ লুকোবে, তা কে জানে?

 


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up