ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্প শুধু গল্প নয় / জানুয়ারি ২০২৪

শেকসপিয়র যা পারে, নিউটন তা পারে কি?

 

 

এ বছরে মধুসূদন দত্তর দ্বিশতবার্ষিকী পূর্ণ হবে। তিনি জন্মেছিলেন ১৮২৪-এর ২৪ শে জানুযারি। ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু। মধুসূদন বয়সে বড়ো, ভূদেব ছোটো। কিন্তু মেধার ওজনদাঁড়িতে দুজনেরই পাল্লা ভারী ছিল। দুজনেই ছিলেন হিন্দু কলেজের নামী ছাত্র, একই ক্লাসে পড়তেন। মধুর বাবা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের জমিদার আর কলকাতা আদালতের নামজাদা উকিল। প্রচুর পশার ছিল তাঁর। এ শহরের খিদিরপুরে তাঁর নিজের বাড়ি । মধু তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তান। তাই তিনি পরম আদরে লালিত হচ্ছিলেন । খিদিরপুর থেকে হিন্দু কলেজে যাতায়াতের জন্য একটি জুড়ি-গাড়ি ছিল তাঁর। মধু বাবার কাছ থেকে হাতখরচা পেতেন–অনেক টাকা, তা ফুরোলে আরও। কেউ খরচ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করত না। মধু তাই বিলাসী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু মন ছিল তাঁর দরদে ভরা।

 

আর ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তান। তাঁর বাবা বিশ্বনাথ তর্কভূষণ এই শহর কলকাতারই বাসিন্দা ছিলেন। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে কোনওক্রমে সংসার চালাতেন। তবে, তাঁর পুত্ররা সকলেই মেধাবী ছিলেন বলে সাধ্যের অতীত হলেও হিন্দু কলেজে তাঁদের ভর্তি করেছিলেন। কলেজে মধু আসতেন জুড়ি-গাড়িতে চড়ে, আর ভূদেবের শ্রীচরণই ভরসা। একবার হল কী, পিতৃদেব অর্থের সংস্থান করতে না পারায় ভূদেবের বেশ কয়েক মাসের স্কুলের বেতন বাকি পড়ে গেল। বকেয়া বেতন না দিলে ভূদেবের পরীক্ষা দেওয়া হবে না সে কথা জানতে পেরে, মধুসূদন ভূদেবের বকেয়া মিটিয়ে দিতে চাইলেন। আত্মসম্মানী ভূদেব সে অর্থ গ্রহণে প্রথমে রাজি হননি। শেষে মধুসূদনের পীড়াপিড়িতে তাঁর অর্থে বকেয়া বেতন পরিশোধ করেন। পরবর্তীকালে এ ধরণের সমস্যা আর হয়নি। ভূদেব পরীক্ষায় সুফল দেখানোয় তাঁকে বেতনমুক্ত ছাত্র গণ্য করা হয় এবং ছাত্র-বৃত্তি হিসাবে প্রতি মাসে বেশ কিছু টাকা পেতেন তিনি।

 

 

মধুসূদনের ছাত্রজীবনও অতি উজ্জ্বল ছিল। ইংরেজি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে তিনি স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। মধুর জীবনের স্বপ্ন ছিল ইংরেজিতে কাব্যরচনা করে কবিখ্যাতি লাভ করা। তিনি ইংরেজি পড়াবেন বলতেন। এমনকি ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর বাসনা ছিল বিলাতে যাবেন। বলা যায়, সেই উদ্দেশে তিনি স্বধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছিলেন। ইংরেজিতে কাব্য লিখে কিছু খ্যাতি হলেও আর্থিক লাভ কিছু হয়নি। বরং, ছাপাখানার পুরো পাওনা মেটানোও সম্ভব হয়নি। সেই সময় তিনি মাদ্রাজে থাকতেন। পরে দেশে ফিরে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাংলা কবিতায় তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেন। সনেট বা চতর্দশপদী কবিতারও শুরু তাঁর কলম থেকে। বাংলায় তিনি মাত্র দুটি প্রহসন লিখেছিলেন তাঁর অনুরাগীদের অনুরোধে। সে দুটি আজও বাংলা ভাষায় সেরা প্রহসন হিসাবে বিবেচিত হয়।

 

আর ভূদেব মুখোপাধ্যায় হয়েছিলেন শিক্ষাবিদ। তখন বাংলায় আধুনিক শিক্ষার প্রথম যুগ চলছে। ভূদেব শিক্ষকতা করেছেন, প্রধান শিক্ষক হয়েছেন। স্কুল পরিদর্শকের কাজও করেছেন। বিদ্যালয় পরিচালনার ত্রুটি সংশোধন করে সঠিক পথে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসাবে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকল্পনা করেছেন এবং পাঠ্য পুস্তক রচনা করে আদর্শ পাঠমালা প্রস্তুত করেছেন।

 

ভূদেব আর মধুর ছাত্র জীবনের একটি ঘটনার কথা জানিয়ে ভূদেব-মধু বৃত্তান্ত শেষ করি। আগেই বলেছি মধুর স্বপ্ন ছিল ইংরাজি কাব্যকার হবেন । আর ভূদেব মেধাবী ছাত্র–তিনি অঙ্কে পারদর্শী ছিলেন। একবার তাঁদের অঙ্কের ক্লাসে একটি অঙ্কের উত্তর কেউ সঠিক দিতে পারে নি, ভূদেবও না। আশ্চর্য, সে অঙ্কটি তরতর করে মধু করে দিয়েছিলেন। কোনও কারণে সেটি হয়তো তাঁর আগেই অনুশীলন করা ছিল। মধু গর্বভরে বললেন, তেমন হলে শেকসপিয়র অঙ্ক করে দিতে পারে, কিন্তু নিউটন কখনও কবিতা লিখতে পারে না।

 


পাঠকদের মন্তব্য

কৃষ্ণেন্দু ভট্টাচার্য লিখেছেন... ২০শে জানুয়ারি, ২০২৪
খুব ভাল লাগলো , অনেক অজানাকে জানলাম।

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up