বাঁশি
শীতল চট্টোপাধ্যায়
ছোটবেলায় বংশীকে সঙ্গে নিয়ে ওর ঠাকুমা একবার দীঘির মেলা দেখতে গেছিল। বাড়ি থেকে দু’তিনটে গ্রাম পরে একটা মাঠের মাঝে এক বিশাল বড়ো দীঘির পাড় জুড়ে ওই মেলা বসে। গ্রামের মদনের ছই লাগানো গোরুর গাড়ি ভাড়া করে ঠাকুমা-নাতি ওই মেলায় গেছিল।
অনেক দূর যাওয়ার পর রাস্তা থেকে শোনা যায় মেলার মানুষদের একটা কাউ-কাউ শব্দ।
বংশী বলল, ও ঠাকুমা, ওই তো মেলার শব্দ শোনা যাচ্ছে, আর কতটা?
ঠাকুমা বলল, এই তো রে ভাই, এসেই গেছি।
আর একটু এগোতেই দীঘির উঁচু পাড়ে মেলাটা দেখা যাচ্ছিল, অতি আনন্দে বংশী মেলার দিকে আঙুল তুলে বেশ একটু জোরেই বলে উঠলো, ওই তো, মেলা!
ঠাকুমা হাসি মুখে বলল, হ্যাঁ, ওটাই।
দীঘির পশ্চিম পাড়ের ঢালে বিশাল একটা শিরীষ গাছের তলায় গিয়ে গরুর গাড়ি থামলো। মেলায় পৌঁছে গেল বংশী। গোরুর কাঁধ থেকে গাড়ির জোয়াল নামিয়ে দিল মদন।
ঠাকুমা মদনের হাতে দু’টাকা দিয়ে বলল, কলা, মিষ্টি কিনে মুড়ি খেয়ে নিবি। আমরা মেলায় যাচ্ছি তাহলে।
দীঘির মেলায় এমন কিছু নেই যে পাওয়া যায় না। মাটি, লোহা, বেত, কাঠ ইত্যাদি উপকরণে তৈরি বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র। আর সবচেয়ে বেশি হলো বাঁশির দোকান। বিভিন্ন ধরণের বাঁশি বিক্রি হয় এই দীঘির মেলায়। দীঘির চারটে পাড় জুড়ে দোকান আর মানুষের ভিড় ।
মেলায় ঢুকে প্রথম বাঁশির দোকানটা চোখে পড়তেই বংশী বলল, ও ঠাকুমা, আমাকে একটা বাঁশি কিনে দাও।
ঠাকুমা বলল, বাঁশি কি করবি? এমন বাঁশের বাঁশি তুই বাজাতে পারবি না কি?
বংশী বলল, আমি ঠিক শিখে নেব, তুমি কিনে দাও না।
একটা বাঁশের বাঁশি কিনেও দিল ঠাকুমা।
কিন্তু বংশী বাজাতে পারবে কেন? সারা মেলাটায় বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে ঘুরলেও শব্দ বের হয়নি একটুও। আসলে বাঁশি কেনার ঝোঁকের কারণ, বংশীর স্কুলের পথে যেতে ডোমপাড়া পড়ে। ওরা সবাই বাঁশের ঝুড়ি, চুপড়ি, কুলো ইত্যাদি নানান ধরণের জিনিস তৈরি ক'রে বিক্রি করে। একেবারে রাস্তা লাগোয়া যার বাড়ি,ওই বাড়ির একজন মানুষ মাঝে-মাঝেই আড়বাঁশি বাজায়। সেই সুরটা প্রায়ই স্কুলে যেতে-আসতে বংশীর কানে আসে। বাঁশির সুর শুনে মনটা যেন কীরকম হয়ে যায়, খুব ইচ্ছে করে বাঁশি বাজানো শিখবে সে। আজ দীঘির মেলা থেকে সত্যি সত্যিই তাই একটা বাঁশি কিনে বাড়ি ফিরল বংশী।
তারপর, পড়াশোনার ফাঁকে-ফাঁকে ওই বাঁশিটাতে শব্দ বের করার আপ্রাণ চেষ্টা। না, বাড়ির মা-বাবা বংশীর ওই শখে বাধা দেয়নি কেউই। বেশ কিছুদিন পর, বংশী একদিন ওর বাবাকে বলল, ও বাবা, ডোম
পাড়ার একটা লোক খুব ভালো বাঁশি বাজায়। আমাকে শেখাতে বলে দাও না, রবিবার সময় পেলে যাব। ছেলের শখের জন্য বাবা না করেনি। রবিবার ছেলেকে নিয়ে গেছিল ওই বাঁশি বাজানোর লোকটির বাড়ি। ওর নাম কানাই। কানাইকে বাঁশি শেখানোর কথা বলতেই, সে বলল, আমি তো নিজে-নিজেই শিখেছি, যতটুকু পারি শেখাবো। ও ছোটছেলে শিখতে চাইছে, পাঠাবেন। সেই শুরু। মাঝে-মাঝে বংশী বাঁশি নিয়ে চলে আসতো কানাইয়ের কাছে। এরপর একটু-একটু সুর ফুটলো বংশীর বাঁশিতে।
বংশী যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন সে বাঁশি বাজানো শিখেছে কিছুটা। বন্ধুরা, মাস্টারমশাইরাও খবরটা জানে। বংশীকে উৎসাহ দেয় সকলেই। কিছুদিন পরে বংশীর ইচ্ছেয় ওর বাবা ওকে একটা মাউথ অর্গানও কিনে দিল। বংশী ওটাও বাজানো শিখে নিল। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরে বংশী চাকরি পেয়ে গেল ভারতীয় সেনা বিভাগে। গর্বিত বংশী চলে গেল দেশরক্ষার কাজে।
সেই বংশী এখন সামরিক সজ্জায় বিউগলে বাজায় দেশাত্মবোধক গানের সুর। সঙ্গতে সামরিক সহকর্মীরা। বংশীর বাজানো সুর মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বংশীর বাজানো বিউগলের সুর শুনে শুধু তার গ্রামের মানুষ নয়, বংশীকে শ্রদ্ধা জানায় সারা দেশের মানুষ !
পাঠকদের মন্তব্য
250