ছোটোদের চাঁদের হাসি / গল্প শুধু গল্প নয় / এপ্রিল ২০২৫

সোনার বন্ধুরা

সোনা ও সোনা কোথায় গেলি রে? মায়ের বারে বারে এমন ডাকে সাড়া না দেওয়ায়, সোনার বাবা ঘরের থেকে চিৎকার করে জানালো–

সে কি বাড়িতে আছে, দেখো দিঘির পাড়ে গিয়ে হয়তো বসে আছে।

সোনার ভালো নাম সনাতন মাহাতো। বছর চারেক আগে আমফান ঝড়ে সুন্দরবন লাগোয়া নামখানায় ওদের বাঁশের বেড়া আর টিনের চালের ঘরটি উড়ে গিয়েছিল। তাই উদ্বাস্তু হয়ে ওরা উঠে আসে নদিয়ায়। কালীনারায়নপুর স্টেশনের পাশে বেদেপাড়ায় ওরা নতুন ঘর বেঁধেছে। কালীনারায়নপুর আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে সনাতন, বাবা-মার একমাত্র আদরের ছেলে সোনা।

বাবা ভগীরথ মাহাতো বেতের ঝুড়ি-মোড়া এসব তৈরি করে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে বিক্রি করে। কোনো মতে ওদের সংসার চলে। এককথায় দিন আনা দিন খাওয়ার মতো।

 

সোনার প্রতিদিনের একটি কাজ হলো, সকাল সকাল বাড়ির পেছনে যে দিঘিটা আছে সেখান থেকে শাপলা, কলমি বা অন্যান্য শাক তুলে নিয়ে আসা। ওই শাক-ভাত খেয়েই ওকে স্কুলে যেতে হয়। বাবা দুপুরের পর ঘরে ফিরে ডাল, সয়াবিন বা ডিম বাজার করে আনে। তবেই ভাতের সাথে একটা অন্য পদ রান্না হয় ওদের। সোনার জন্য ওদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে একটি কুকুর ও একটি বেড়াল। নিজের খাবারের থেকে কিছুটা খাবার প্রতিদিন ওদের জন্য বরাদ্দ রাখে সোনা। এর জন্য বাবা-মার কাছে ওকে কথাও শুনতে হয় উঠতে বসতে। ওর মা তো মাঝে মাঝেই বলে ওঠে, নিজের খাবারের ঠিক নেই, পরের জন্য ওর যত চিন্তা।

তবে বাড়ির খাবার থেকেই যে সোনা ওর প্রিয় বেড়াল-কুকুরকে খাবার দেয় তা নয়। মিডডে মিলে স্কুলে যে খাবার দেয়–সেখান থেকেও একটা প্লাস্টিকের টিফিন বক্সে কিছুটা খাবার নিয়ে আসে ওদের জন্য।

ওরা দুজন ওর যেন প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছে। সকালে দিঘির পাড়ে সোনার সাথে ওদের যাওয়া চাই। স্কুল থেকে ফিরে এসে বিকেলে ওর সাথে আবার স্টেশনের পাশে ঘুরতে যাওয়া–এসব ওদের দৈনন্দিন রুটিন।

 

সুন্দরবন এলাকার বাসিন্দা হলেও সোনা সেভাবে সাঁতারটাকে রপ্ত করতে পারেনি। এটাই ওর বাবা-মায়ের ভয়ের কারণ। তাই সকালে বেরনোর সময় ওর মা বারবার সতর্ক করে দেয়।                  

        —দিঘির পাড় দিয়েই ঘুরিস, জলের ভেতরে যাস না কিন্তু!

তবুও সোনা হাঁটু বা কোমর জলে নেমে শাক, শাপলা এগুলো তুলে আনে। সে যখন এগুলো তোলে তখন কতগুলো রাজহাঁস দিঘিতে খেলা করে। সোনাও ওদের সাথে ‘আয় আয় প্যাঁক প্যাঁক‘ ক’রে খেলায় মেতে ওঠে।

 

একদিন হঠাৎ এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। সোনা সকালবেলা ওর সঙ্গী বেড়াল-কুকুরকে সাথে নিয়ে শাপলা তুলতে দিঘির পারে এসেছে। হাঁটু জল বা কোমর জলেই হাঁটতে হাঁটতে সেগুলো তুলছিল। হঠাৎই কেমন করে যেন একটু দূরে চলে গিয়েছিল পার থেকে।

ও লক্ষ্য করছিল রাজহাঁসগুলো ক্রমশ ওর সামনে এসে প্যাঁক প্যাঁক করে চিৎকার করছে। ও ভাবল হাঁসগুলো বোধহয় ওকে সাহস জোগাচ্ছে আরও একটু এগিয়ে যেতে। ও তাই সাহস করে আর একটু এগোতে চেয়েছিল। কিন্তু বিপদ হল তাতেই। ও জানতো না যে সামনেই জলের তলায় ছিল একটা বড় খাদ।

এগোতে এগোতে হঠাৎই চিৎকার–ও মাগো…!

সোনার একটা পা পড়ল খাদে। কিছুতেই উঠতে পারল না। তলিয়ে যেতে থাকল। কিন্তু বুদ্ধি করে হাত দুটোকে মাথার ওপরে তুলে রাখল।

 

এদিকে হাঁসগুলো আরো জোরে চিৎকার করে প্যাঁক প্যাঁক করে ডাক শুরু করে দিয়েছে। তা দেখে সোনার কুকুর হঠাৎ ঝাঁপ দিলো জলে। সাঁতরে গিয়ে সোনার প্যান্ট কামড়ে ধরে টানতে টানতে ডাঙায় নিয়ে এলো।

এরপর ক্লান্ত সোনা কিছুক্ষণ দিঘির পাড়ে শুয়ে থাকে। পাশে ওর বেড়াল আর কুকুর। ওরা ক্রমশ মাথা থেকে পা পর্যন্ত কেবল ছোটাছুটি করছে। আসলে হাঁসগুলো ওকে ডাকছিল না। হাঁসগুলো ওর সামনে এসে চিৎকার করে হয়তো বোঝাতে চেয়েছিল, তুমি আর সামনে এগিয়ো না, ওখানে অনেক জল।  আর ও ভেবেছিল বোধহয়…!

নিজের ওপর খুব রাগ হলো সোনার। কী  নির্বুদ্ধিতার কাজ করতে যাচ্ছিল সে! বুঝল খুব বাঁচান বেঁচে গেছে। কুকুরটার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করলো।

 

আরও একটু সুস্থ বোধ করলে সোনা ওর সঙ্গীদের সাথে ঘরে ফিরে এলো। মা ও বাবাকে সব খুলে বলল। ওর বাবা তো ভীষণ রেগে গেল ওর মার ওপর।

নুন দিয়ে ভাত খেয়ে স্কুলে যাবে, তবুও যেন ও শাক তুলতে না যায়–বলল বাবা।

ওর মা কিন্তু নীরব হয়ে সোনার বেড়াল আর কুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পরে স্কুলের হোমটাস্ক শেষ করে সোনা খেতে বসেছে। খাবার মুখে তুলেই ও দেখল একটি আলাদা পাত্রে ওর মা আজ খাবার দিচ্ছে ওর প্রিয় সেই কুকুর ও বেড়ালটিকে, যাদের মা একদম পছন্দ করত না।

আবেগে সোনা বাঁ হাতে নিজের  দুচোখ মুছে নিল।

 


পাঠকদের মন্তব্য

কণিকা দাস লিখেছেন... ১৩ই এপ্রিল, ২০২৫
খুব সুন্দর একটা শিক্ষামূলক গল্প পড়লাম।
ঐন্দ্রিলা সরকার লিখেছেন... ১৩ই এপ্রিল, ২০২৫
আমার গল্পটা খুব ভালো লেগেছে
শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ লিখেছেন... ১৩ই এপ্রিল, ২০২৫
একটি পরিচ্ছন্ন ও সরল পশুপ্রেমের সুলিখিত গল্প। লেখককে কুর্ণিশ।
Himadri লিখেছেন... ১৩ই এপ্রিল, ২০২৫
গল্পটা পড়ে শেষে মনটা খুব ভারী হয়ে এলো, খুব সুন্দর গল্প, sonar মত আমাকেও চোখ মুছতে হলো /
তপন বাগচী লিখেছেন... ১৫ই এপ্রিল, ২০২৫
অসাধারণ প্লট!! প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা জাগানিয়া লেখা। ভাষা সুন্দর! ছোটোরা উদ্বুদ্ধ করবে। অভিনন্দন জানাই
Jhumpa sarkar লিখেছেন... ১৬ই এপ্রিল, ২০২৫
Sona o tao bondhuder notun bochorer valobasa . Golpotar khub bhalo laglo
Tanuja Chakraborty লিখেছেন... ১৬ই এপ্রিল, ২০২৫
জীবজন্তুরা এভাবেই প্রতিদান দেয়।খুব ভালোলাগল।

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up