ছিল খাদ হলো পথ
অশোককুমার মিত্র
পর্ব : ১
'ছিল রুমাল হয়ে গেল বিড়াল'–এমন কথা লিখেছেন আজগুবি লেখার জাদুকর সুকুমার রায়, তাঁর হ য ব র ল-য় কল্পনার উদ্ভুটি রসের রসায়নে। কিন্তু 'ছিল খাদ হয়ে গেল পথ'–এ তো ঘোর বাস্তব৷ আর ঘটনাটা ঘটেছিল এই কলকাতায়, যখন সেটা গ্রাম থেকে ক্রমে মহানগরীর রূপ নিচ্ছে৷ কলকাতা নামটি যতই পুরনো হোক না কেন, শহরের গড়ে ওঠা তো জোব চার্নক এখানে আসার পর ইংরেজদের হাতে, এতে দ্বিমত নেই৷ সেই কলকাতা গড়ে ওঠার কালেই খাদ বুজিয়ে পথ। এতে কল্পনার কোনও রসায়ন নেই–তা সত্যি ইতিহাস, সেই কাহিনিই বলব৷
তিনশো বছরেরও আগের ঘটনা, তখনও এদেশে ইংরেজদের রাজত্ব কায়েম হয়নি, তবে, বাণিজ্য করতে তারা এদেশে ঘাঁটি গেড়েছে ৷ নানা জায়গায় কুঠি বসিয়েছে৷ পূর্ব ভারতে হুগলিতে, কাশিম বাজারে, পাটনায়৷ কোম্পানির সেপাইদের সঙ্গে নবাবের সেনাদের মাঝে মাঝে ভারি গোল বাধত৷ আবার মিটেও যেত৷ সেবারে হুগলির গোল আর মেটার মত অবস্থায় রইল না। বাধ্য হয়ে কুঠিপ্রধান জোব চার্ণক ওখানকার পাট তুলে জাহাজে চড়ে বালেশ্বরের পথে পাড়ি জমালেন৷ যেতে যেতে চার্নকের নজরে পড়ল একটি গ্রাম–নদীর ধারেই, বনজঙ্গলে ঢাকা৷ জাহাজ থামিয়ে তিনি নামলেন৷ গ্রামের নাম সুতানুটি৷ এখানে হাট বসে৷ খড়ে ছাওয়া ক’টি মাটির ঘরও দেখতে পেলেন৷ সেখানে ক’দিন কাটিয়ে আবার পাড়ি জমালেন৷ বালেশ্বর হিজলিতে কাটল কিছুকাল।
শেষে অবস্থা বদল হল ৷ দিল্লির বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের নির্দেশে বাংলার নতুন নবাব খোজা ইব্রাহিম ইংরেজ কোম্পানিকে বাংলায় বাণিজ্য করতে ডাক পাঠালেন। জোব চার্নক বাংলায় ফিরে আর হুগলিতে গেলেন না। কলকাতাকেই তাঁর কর্মকেন্দ্র হিসাবে বেছে নিলেন৷ ১৬৯০ সালের ২৪ শে আগস্ট তিনি ঘাটে নামলেন। একদিকে বিশাল নদী, এখানে তা বাঁক নিয়েছে৷ ফলে বড় জাহাজের নোঙর করতে অসুবিধা নেই৷ বাকি দিকগুলিতে বনজঙ্গল ও বাদা-অঞ্চল৷ অর্থাৎ এটি প্রাকৃতিক দিক থেকেও সুরক্ষিত, তবে, বসবাসের পক্ষে অস্বাস্থ্যকর৷ তা সত্ত্বেও কুঠি পরিচালনার জন্য এই সুরক্ষিত অঞ্চলটি জোব চার্নকের মনে ধরল৷
তাছাড়া এখানে এদেশিদের একটি ব্যবসাকেন্দ্রও তখন গড়ে উঠেছিল৷ শেঠ-বসাক-মল্লিকেরা এখানে জাঁকিয়ে ব্যবসা করতেন৷ ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক সুসম্পর্কও গড়ে উঠেছিল৷ চার্নক সাহেবও এদেশিদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়তে নিজের পোশাকে বদল আনলেন। আচরণেও৷ ওঁদের সঙ্গে বৈঠকে বসতেন নিমতলার বিখ্যাত নিম গাছতলায়৷ বৈঠকে গুড়ুক গুডুক ফরসিতে টান দিয়ে তামাক খেতে খেতে এদেশিদের মত বৈষয়িক কথাও সারতেন৷ এদেশে ব্যবসার জমি তৈরি করে পাঁচ বছরের মাথায় ১৬৯৫-এর ১০ জানুয়ারি তারিখে চার্নক সাহেব এখানেই মাটি নিলেন৷ পরে সেখানে তার বড় জামাই চার্লস আয়ার এবং কোম্পানির এখানকার প্রধান পাকা সমাধি স্তম্ভ গড়ে দেন৷
চার্লস আয়ার সুতানুটি কুঠির প্রধান হয়ে আসার পর আর্মানি বণিক খোজা সরহদের কুশলী সহায়তায় নবাব আজিজ-উস-শ্বানকে ১৬০০০ টাকা উপহার দিয়ে কলকাতার প্রজাস্বত্ত্ব কেনার অনুমতি সংগ্রহ করলেন। পড়তি জমিদার বড়িষার সাবর্ণ রায়চৌধুরী লক্ষ্মীকান্তর বংশধর রামচাঁদ রায় মনোহর দিগরের কাছ থেকে মাত্র ১৩০০ (তের শত টাকা) টাকায় সুতানুটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর–এই তিন মৌজার জমিদারি কিনে ফেললেন৷ অলক্ষ্যে পৃথিবী জোড়া ব্রিটিশ সাম্রাজের বীজ রোপিত হয়ে গেল। (চলবে)
পাঠকদের মন্তব্য
250