ছোটোদের চাঁদের হাসি / দেশ-বিদেশের গপ্পো / অক্টোবর ২০২৪

কাচের আয়না

(কোরিয়ার লোককথা)

 

অনেক অনেক দিন আগের কথা। কিম বলে একজন লোক থাকত পাহাড়তলির গাঁয়ে। তার সঙ্গে থাকতো বুড়ো বাবা-মা, বউ আর তার ছোট্ট ছেলে। কিম মন দিয়ে চাষ-আবাদ করে, সুখে দিন কাটে তাদের।

একদিন হল কী, কিম এসে বলল, মা, আমার অনেক দিনের ইচ্ছে–একবার  রাজধানী যাই। শুনেছি সেখানে দেদার মজা। একবার সেখানে না গেলে আর চলছে না।

 

বলল আর চলল কিম গাঁ ছেড়ে রাজধানী শহরের পথে। পথ চলতে তার অনেক কষ্ট হলো ঠিকই, কিন্তু শহরে পৌঁছে তার মন ভরে গেল। আঃ কত মজা চারিদিকে ছড়ানো। কত বড়ো রাস্তা, কত লোকজন, কত গাড়িঘোড়া। কত রোশনাই–রাতের আঁধার কেটে দিন হয়ে যায়। কি ঝলমলে পোশাক পরা মানুষজন! বাতাসে ভাসছে খাবারের খুশবু ! যেদিকে যা দেখে কিম, তাতেই সে তাজ্জব বনে যায়। বাব্বারে, শহরে এত মজা! দুদিন ধরে সে দুচোখ ভরে শহর দেখে নিল। তারপরে এলো বাড়ি ফেরার পালা।

 

ফেরার পথে সে সবার জন্যে কিছু কিছু উপহার কিনল। আর নিজের জন্য নিল এক আজব জিনিস–একখানা কাচের আয়না। মুখ দেখার আয়না। এমন জিনিস কেউ দেখেনি। সে দেখেনি, তার বাবা দেখেনি, বউ দেখেনি, তার গাঁয়ের কেউ দেখেনি। আয়নায় সে নিজের মুখ দেখে আর মোহিত হয়ে যায়।

     যাক, বাড়ি ফিরে সে সকলের হাতে তাদের জন্য আনা উপহার তুলে দিল। বাবার জন্যে চুরুট, মায়ের জন্যে শাঁখা, বউয়ের জন্যে কাচের চুড়ি আর চুলবাঁধার রঙিন ফিতে, ছেলের জন্যে বেলুন। উপহার পেয়ে সবাই ভারী খুশি।

 

    কিন্তু আয়নাটির কথা কাউকে সে বলল না। এমন আজব জিনিস কাউকে দেখালও না। নিজের ঘরে নিজের বাক্সের ভেতরে রেখে দিল। আর সময় পেলে নিজের ঘরে ঢুকে বাক্স খুলে টুক করে আয়নাটি বের করে বারে বারে নিজের মুখ দেখে আর মুগ্ধ হয়ে যায়। মুগ্ধ হয়ে ফের নিজের মুখখানি দেখে আর বাক্সের ভেতরে লুকিয়ে রাখে তার আজব আয়না, পাছে কেউ তা দেখে ফেলে।

 

এমনি করে দিন যায়, লুকিয়ে কিম তার নিজের মুখ দেখে মুগ্ধ হতে থাকে। একদিন হয়েছে কি–কিম  মুগ্ধ হয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখছে, আর সেই সময় তার বউ সেই ঘরে ঢুকেছে। সে দেখে কিম তন্ময় হয়ে কী যেন দেখছে। দেখছে আর পুলকে মিটিমিটি হাসছে। বউয়ের সাড়া পেয়ে সে তড়িঘড়ি আয়নাখানা বাক্সের ভেতর চালান করে দিল।

  বউ জিজ্ঞেস করল, ওটা কী, ওটা কী গো?

  না, না, কিছু না তো। বলেই কিম উঠে পড়ল, আমায় এক্ষুনি আলু খেতে নিড়েন দিতে হবে–বলে সে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে গেল।

 

বউয়ের কেমন যেন সন্দেহ হল–লোকটা কি যেন লুকলো। কিম বেরিয়ে যেতে বাক্সখানা খুলে হাতড়ে হাতড়ে সে আয়নাখানা নিজের মুখের সামনে তুলে ধরল। আয়নায় তখন বউয়ের মুখ ফুটে উঠেছে। কিন্তু সে তো তা জানে না। সে ভাবল ছিঃ ছিঃ কী কান্ড! এই চাঁদপানা সুন্দরী মেয়েটা কে রে? সে ফের আয়নায় মুখ দেখে আর অবাক হয়ে ভাবে–এই সুন্দরী মেয়েটা কোত্থেকে এল! ওঃ, কিম তাহলে এবারে শহরে গিয়ে এক সুন্দরী মেয়ে এনে, এখানে লুকিয়ে রেখেছে। আর মাঝে মাঝে ঘরে ঢুকে তার সঙ্গে দেখা করছে। হায়, হায়, লোকটা এত খারাপ হয়েছে! একেবারে গোল্লায় গেছে।

 

এরপর ভীষণ রেগে সে আয়নাখানা নিয়ে ছুটে এলো তার শাশুড়ির কাছে। বলল–দ্যাখো, দ্যাখো, তোমার ছেলের কান্ড দ্যাখো। সে আমায় আর একটুও ভালোবাসে না, শহর থেকে এক চাঁদপানা মুখের সুন্দরী নিয়ে ঘরে ঢুকিয়েছে। দ্যাখো,তুমি ভালো করে দ্যাখো। বলে ভয়ঙ্কর অভিমানে সে আয়নাখানা শাশুড়ি মায়ের হাতে তুলে দিল। আয়নাখানা হাতে পেয়ে শাশুড়ি তা তুলে দেখতে গেল, কেমন শহুরে সুন্দরী রয়েছে সেখানে। মুখের কাছে আয়না তুলে ধরে সে অবাক! আরে দূর দূর! আমার বৌমার মাথা খারাপ হয়েছে। এখানে শহুরে সুন্দরী কোথায় গো, এ তো দেখছি এক বুড়ির মুখ।  তার মুখের চামড়া গেছে ঝুলে, মাথা ভর্তি পাকা চুল। নাঃ আমার বউমাটা দেখছি আস্ত পাগল। এই থুত্থুড়ে বুড়িকে দেখে বলে কী না শহুরে সুন্দরী!

  –না, মা না, ও একটা সুন্দরী মেয়ে নিয়ে এসেছে, আমি নিজের চোখে দেখেছি। তাই তো বাক্সের ভেতরে লুকিয়ে রাখে।

–তুমি ভুল বলছো বউমা, আমি পরিষ্কার দেখছি এখানে একটা বুড়ি রয়েছে মাথায় পাকা চুল চামড়া ঝুলে গেছে।

বলছি একটা সুন্দরী মেয়ে!

–নাঃ এক পাকা চুলের বুড়ি!

–নাঃ সুন্দরী।

–নাঃ বুড়ি !!

 

     আয়নার মানুষ নিয়ে শাশুড়ি-বউয়ে তুমুল তর্ক বেধে গেল। সে তর্ক শুনে শ্বশুরমশাই সেখানে এসে হাজির!

কী ব্যাপার কী, তোমাদের? বাড়ি যে একেবারে মাথায় করে তুললে?

    দেখুন বাবা–বউ বলতে শুরু করল,আপনার ছেলে শহরে গিয়েছিল, সেখান থেকে আমাদের জন্যে কত কী উপহার নিয়ে এলো, তা তো জানেন। কিন্তু জানেন কি যে নিজের জন্যে ও শহর থেকে–তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শাশুড়ি বলল, শহর থেকে একটা সুন্দরী মেয়ে নিয়ে এসেছে, এই কথা বলবে তো ! কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখেছি ওখানে কোনো সুন্দরী মেয়ে নেই। রয়েছে এক থুত্থড়ে বুড়ি, যার চামড়া গেছে কুঁচকে, আর চুলে ধরেছে পাক। তবে আমার একটা খটকা লেগে রয়েছে, কিম শহর থেকে একটা বুড়ি আনলো কেন? বুড়ি ওর কোন কাজে লাগবে?

 

          তাদের কথা শুনে শ্বশুরমশাই প্রথমে খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারপরে ওদের কাছ থেকে আয়না চেয়ে নিয়ে নিজের মুখের সামনে তুলে ধরল। ধরেই ফের ভ্যাবাচ্যাকা খেলো–আরে এ কে? তোমাদের দুজনেরই দেখছি মাথা খারাপ হয়েছে। শ্বশুরমশাই বলল–কোথায় বাপু তোমাদের শহুরে সুন্দরী আর কোথায় থুত্থুরে বুড়ি? আমি তো তাদের কাউকেই দেখছিনে, বরং দেখছি এক বুড়ো–পাকা দাড়ি-গোঁফে তার মুখ ঢাকা পড়েছে। নাঃ এটা এখানে থাক, বরং কিম এলে ব্যাপারটা জেনে নিলেই হবে। বলে বুড়ো আয়নাখানা মেঝেয় রেখে চলে গেল।

 

   কিছুক্ষণ পরে সেখানে এল বাড়ির ছোট্ট নাতি। মেঝেতে ফেলে রাখা আয়নাখানা হাতে তুলে নিল। চমৎকার একটা খেলনা ভেবে সেখানা নিজের মুখের কাছে তুলে ধরতে সে দ্যাখে তার ভেতরে একটা বাচ্চা ছেলের মুখ। তা দেখে সে ভারী মজা পেল। ছেলেটিকে সে একটু ভেংচি কেটে দিলো, ছেলেটিও তাকে তেমনি ভেংচি কেটে দিলো। ওর দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাল। তা দেখে বাচ্চাটাও ভুরু কোঁচকাল। নাতি এবারে তাকে এক ঘুষি দেখাল। বাচ্চাটিও তাকে ঘুসি দেখাল। তা দেখে নাতির ভারি রাগ হলো–সে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল।

   তার কান্না শুনে পাশের বাড়ির চ্যাঙদাদা ছুটে এল–কী হয়েছে সোনা, কী হয়েছে? বলে চ্যাঙ তাকে কোলে তুলে নিল।

     কাঁদতে কাঁদতে নাতি বলল, ও, ও আমার মার্বেল নিয়ে নিয়েছে।

–কে, কে  নিয়েছে?

–ও, ও নিয়েছে বলে নাতি আয়নাকে দেখাল।

    চ্যাঙদাদা আয়নাখানা তুলে দেখে তার ভেতরে একটা বড়োসড়ো ছেলের মুখ–মানে চ্যাঙদাদার মুখ। সে তো জানে না, তাকে দেখেই চ্যাঙদাদা বলল, পাজি, বদমাশ, বুড়োধাড়ি! বাচ্চা ছেলের মার্বেল কেড়ে নিয়েছিস। যা হতভাগা, একথা বলেই আয়নাটা ধরে মেঝেয় আছাড় মারল। ভাঙা আয়নার কাচের টুকরোয় মেঝে ভরে গেল।

 


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up