অমর বীণকার
দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
(বর্মা)
তাগাউ শহরে থাকতেন একজন বড়োমানুষ, তার একটিমাত্র ছেলে। ছেলের নাম মাউঁ পৌঁ। মানুষটির
ইচ্ছে, তাদের জীবনটা তো কাটল টাকা টাকা করে, ছেলেটা একটা কিছু হোক, যাতে বংশের একটু নামডাক হয়।
চোদ্দপুরুষ ধরে কেবল সোনাদানা আর ঘরজিরেত–এই তো করে গেছে সব। ভেবেছিলাম, চুলোয় যাক গিয়ে, আমি দিন কাটিয়ে দি গানটান নিয়ে। আমারও হলো না। তা ছেলেটারই যদি কিছু হয়…!
অবশেষে অনেক ভেবে বাজার ঘুরে একখানা হংসরাজ বীণ নিয়ে এলেন কিনে। শিখুক, বীণা শিখুক। গলাটলা যতটুকু শুনেছেন, গানটা বোধহয় গাওয়া ঠিক হবে না। যন্ত্র শিখুক।
সোনার বাটাম করা সাঁউ, রুপোর ধারার মত তেরোখানা ঘন রেশমি তারের বাঁধুটি। সাঁইতিরিশ দেবতার পুজো দিয়ে তাগাউ শহরের সেরা বীণকারের কাছে মাউঁ পৌঁ চলল নাড়া বাঁধতে।
তারপর নিত্যি সকালবেলায় দেখা যায় সোনা-ঝমকানো সাঁউটি কাঁধে ফেলে মাউঁ পৌঁ চলেছে গুরুর ঘর। কামাই নেই।
মাউঁ পৌঁর বয়েস বেশি নয়। আর তার মনটনও বীণার কানুন রপ্ত করার চাইতে রাস্তাঘাট বনবাদাড়েই ঘুরতে চায় বেশি। কাজেই বছর ঘুরতে গেল, তার মধ্যে শুধু তার ছিঁড়ল আর তার বাঁধা হলো, আর কিছু হলো না।
আরো দিন গেল–ভাঙল সাঁউ, এলো নতুন যন্ত্র। জোয়ারের জলের মতো বয়ে গেল বাপের উপদেশ। অনেক গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানিয়েছে সে। শেষ অবধি তাকেও ছেলেকে বলতে হলো, বাবু হে, ঢের হয়েছে, এবারে ঘরের কাজেকম্মে লেগে পড়ো। খুব মুষড়ে পড়ল মাউঁ। তারপর ভয়ানকভাবে মন দিতে যেতেই, হাউ হাউ ডাক পেড়ে যন্ত্রটাই ভেঙে আটখানা হয়ে গেল আচমকা। ভারি অপ্রস্তুত লাগে মাউঁ পৌঁর।
গুরু হাল ছেড়ে দিলেন। কিন্তু ছাড়তে পারলেন না নাছোড় শিষ্যটিকে। মাউঁ পৌঁর বাবা জোড়হাতে এসে হাজির–ছেলেমানুষ, একটু বুঝতে শিখলে দু দিনে শিখে নেবে দেখবেন! কত বড়ো বংশের ছেলে! আপাতত গুরুর প্রণামী কিছু বাড়লো। আর দু-একদিনের ফারাকে-ফারাকেই মাউঁ পৌঁ আসতে লাগল আনকোরা আনকোরা। পেছনে পেছনে রেশম তারের বোঝা মাথায় নফর। বাড়িতে মাউঁ পৌঁর জন্য তৈরি হলো আলাদা একটেরে ঘর। না, আর কোথাও মন পড়লে চলবে না। হাজার হলেও গানবাজনা হল সাধনা। যেন অযথা কেউ বিঘ্ন না করে–মাউঁ পৌঁর ঘরে তার সঙ্গীসাথীর উপদ্রবও কমে গেল। আর এমনি করে দিন গড়িয়ে চলল। মাউঁ পৌঁর গুরু বুড়ো হলেন। মারা গেলেন। মাউঁ পৌঁর বাবা শহর ঢুঁড়ে রাতারাতি ঠিক করল নতুন গুরু।
এদিকে মাউঁ পৌঁরও বয়েস বাড়তে লাগল। বিয়ে থা করল, ছেলেপুলে হল তার। আর এবারে নিজের থেকেই যেন তৈরি হয়ে উঠলো তার মন। মেলামেশা তার ছিলই না বলতে গেলে। সময় যাতে আরো ঠিকঠাক থাকে, তার জন্যে ঘরেই সে জমিয়ে ফেলল বাজারশুদ্ধু যন্তর আর তারের পাহাড়, ঘরেই তুলল এনে গুরুকে। এক গুরুর পরে আরেক গুরু। এমনি করে চলল দিন।
মাউঁ পৌঁর ছেলেপুলেরাও দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে গেল। বিয়ে থা হল তাদেরও। একবাড়ি ছেলেমেয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল আগানবাগানে।
আর আশ্চর্য! একদিন মাউঁ পৌঁও হঠাৎ লক্ষ্য করে বসল, তারও মাথার চুলগুলো যেন সাদা সাদা, মুখটাও যেন তার নয়, কোনো বুড়োমানুষের…!
সাউঁয়ের পরে মাথা রেখে মাউঁ পৌঁ মারা গেল একদিন। তাকে নিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে ছড়া বাঁধল দুষ্টু লোকে
তারের বোঝা তার
সব হল কাবার,
বাজল না বাজল না বীণা
বাজল না একবার!
কার বীণা বাজল না? কার আবার মাউঁ পৌঁয়ের।
মাউঁ পৌয়ের ঘরটা ছিল বাইরে একটেরে। বরাবরই যাতায়াত বারণ ছিল তার ঘরে। এবারে তালা পড়ল মস্ত বড়ো। আবার দিন চলল রয়ে বসে।
কতদিন হয়ে গেল তারপর, বোধহয় মাঁউ পৌঁয়ের নাতি-পুতিদের ছেলেপুলেদেরই কেউ হবে–হঠাৎ একদিন খেলার ঝোঁকে জংধরা অজগর তালাটা ফেলল খুলে। ও বাবা! এ যে দেখছি মস্ত বড় ঘর! কতদিন বন্ধ ছিল কে জানে, বহুদিনকার একটা পুরনো গন্ধের ভাপ খোলা পেতেই গোটা ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল ধক্ করে। ও বাবা, এ যে সাতপুরু ধুলো! কী ঝুল কী ঝুল সারা ঘরভর্তি–দিশে হয় না। জানালা-টানালা গিয়ে খুলে দিতেই–অবাক! শুধু সোনালি-রুপোলি রাশি রাশি বাজনা–কত রকম ঢং, কতরকম কারুকাজ! জানলা গলে আলো এসে ঢুকতেই ঝলমলিয়ে উঠল তাদের অলিগলির সোনারুপো।
কার ঘর রে? কার এ সমস্ত? কে ছিল এই ঘরে? বড়রাও মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তাই তো! ঘরটা খোলা বারণ হয়ে আছে জন্মের আগের থেকে। কিন্তু কেন যে, তা তো খোঁজ নেওয়া হয়নি! না এসে না এসে এদিকটায় আসাই প্রায় উঠে গিয়েছিল। কিন্তু কেন যে…!
শেষটায়, অনেক ভেবে, খুব বুড়োদের একজন বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ! মনে পড়েছে বটে। আমাদের পুরোনো বংশে কে যেন ছিলেন–শুনেছিলাম বটে, মাউঁ পৌঁ না কী যেন নাম! ওস্তাদ বীণকার…!
অল্পদিনেই, যে যেখানে আছে স্বজনকুটুমের মধ্যে ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল ব্যাপারটা।
মাউঁ পৌঁই তো বটে! শুনেছিলাম যেন! আস্তে আস্তে সবারই মনে পড়তে লাগল, এই বংশেই তো জন্মেছিলেন! মাউঁ পৌঁ।
দেশের গৌরব বীণকার! কী ভুল!
সারা দেশ পাগল ছিল তাঁর বাজনায়…! বাজনা শুনতে নেমে আসতেন সাঁইতিরিশ নটদেবতা–এই ঘরে…! বাজনা শুনে মুখের শিকার ফেলে দোরগোড়ায় সারারাত বসেছিল বনের বাঘ।
সেই মাউঁ পৌঁ…!
প্রথম প্রথম মাউঁ পৌঁয়ের কীর্তিকথা নিয়ে অল্পস্বল্প বাদবিরোধ থাকলেও শেষ অবধি এমন হলো, মাউঁ পৌঁয়ের নাম বলতে মাথা নুয়ে আসত আপনা থেকে। শুধু স্ববংশীদের নয়, অন্যদেরও। একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো শিল্পীর কল্পনায় আঁকা মাউঁ পৌঁর নানান ধারার ছবি। বিকোতে লাগল দোকানবাজারে। সারা দেশে।
আর, এই সূত্রপাত হল মাউঁ পৌঁ মরবার অন্তত একশ সাতাশ বছর পরে…!!
পাঠকদের মন্তব্য
250