ছোটোদের চাঁদের হাসি / দেশ-বিদেশের গপ্পো / মে ২০২৫

ব্যাঙ কেন বৃষ্টি পড়লে গ্যাঁ-গোঁ করে ডাকে

(কোরিয়ান লোককথা)

 

গ্রামের এক এঁদো পুকুরে একটা ব্যাঙ আর তার ছানা বাস করত। ব্যাঙের একটিমাত্র ছানা, কিন্তু সেই একটাকে সামলাতে গিয়েই মা-ব্যাঙকে সর্বদা হিমসিম খেতে হয়। ছানা ব্যাঙটা কি দুরন্ত! হাজার দোষের ভেতর একটাই তার গুণ, গ্যাঁ-গোঁ করে সুরেলা গলায় ডাকতে পারে। তার গ্যাঁ-গোঁ ডাক শুনে তার মা ছানার নাম রেখেছে ‘গ্যাঁ-গোঁ’।

   গ্যাঁ-গোঁ’র  মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। বাচ্চাটা যে কোনো কাজকর্মই করে না। বন্ধুদের নিয়ে সব সময় ফুর্তি করে আর সারা পুকুর সাঁতরিয়ে বেড়ায়। মায়ের দুর্ভাবনা দেখে গ্যাঁ-গোঁ মজা করে বলে–আমায় নিয়ে কোনো চিন্তা করো না মা। আমি আমার খাবারদাবার ঠিক জুটিয়ে নেব।

 

     মায়ের চিন্তা তবু দূর হয় না। কালক্রমে মা-ব্যাঙ বুঝতে পারছে তার ছেলে শুধু ফুর্তিবাজই নয়, পদে পদে মিথ্যা কথা বলতেও তার ইদানিংকালে বাধছে না। মাকেও সে কারণে-অকারণে মিথ্যা কথা বলছে। মায়ের কোনো কথাই সে আর শোনে না। তাকে যা করতে বলা হবে, সামনে সে ঠিক তাই করবে বলে ঘাড় নাড়লেও পরে সে ঠিক তার উল্টো কাজটাই করবে।

 

মা হয়তো বলল–ওরে  গ্যাঁ-গোঁ, আজ  যেন পুকুরের পূব পাড়ে যাস না। ওখানে সকাল থেকে একটা বড়ো মোটা ঢোঁড়া সাপ ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। তুই ভুল করে সেখানে গিয়েছিস কি মরেছিস। তার চেয়ে তুই বরং আজ পশ্চিম পাড়ে গিয়ে খেলাধূলা কর। গ্যাঁ-গোঁ সুবোধ ছেলের মত মাকে বলল, বেশ তাই করব মা। তোমার কথা তো আমি অমান্য করতে পারব না।

     মা-ব্যাঙ ছেলের কথায় বিশ্বাস করে অন্য জায়গায় গেল খাবারের খোঁজে। মা যেই চলে গেল অমনি গ্যাঁ-গোঁ তার বন্ধুদের ডেকে বলল–চল, চল আমরা আজ পুকুরের পূব পাড়ের ঘাটে গিয়ে জলখেলা করি। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে গ্যাঁ-গোঁ পূব পাড়ের ঘাটে এসে হাজির হলো। এরপর আনন্দে তারা জলে ঝাঁপাই জুড়তে থাকে।

 

       এদিকে একটা জলঢোঁড়া সাপ ঘাটের সিঁড়ির আড়াল থেকে গ্যাঁ-গোঁদের নাচানাচি লক্ষ্য করছিল। সাপটা মনে মনে চিন্তা করছে–আর একটু এগিয়ে এসো বাছাধনরা। তারপর আমি মজা দেখাব তোমাদের। গ্যাঁ-গোঁরা লাফাচ্ছে, নাচছে আর সাঁতার কাটছে মনের সুখে। এসব করতে করতে তারা একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। সামান্য বিশ্রাম নেবার জন্য যে-ই না গ্যাঁ-গোঁ ঘাটের সিঁড়ির কাছে এলো অমনি সাপটা খপাৎ করে গ্যাঁ-গোঁ’র একটা পা ধরে টানতে শুরু করে। সাপকে দেখে গ্যাঁ-গোঁ’র তো আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার জোগাড়। প্রাণভয়ে সে তারস্বরে চিৎকার জুড়ল। গ্যাঁ-গোঁ’র পরিত্রাহি ডাক শুনে বন্ধুরা সবাই ছুটে এলো গ্যাঁ-গোঁ’কে সাপের মুখ থেকে রক্ষা করার জন্য। বন্ধুদের মিলিত আক্রমণের জন্য সে-যাত্রায় সাপের মুখ থেকে গ্যাঁ-গোঁ বেঁচে ফিরল।

 

         মা-ব্যাঙ ছেলের দস্যিপনার কথা শুনে ভয়ে মরে। তার চিন্তা হচ্ছে সে মরে গেলে, গ্যাঁ-গোঁ’র কি হবে, কে দেখবে তাকে। অন্যসব ব্যাঙ-বন্ধুরা তো তার ছানার মতো একগুঁয়ে আর মিথ্যুক নয়। ছেলের কথা ভাবে আর মনের দুঃখে সে চোখের জল ফেলে আর গুমরিয়ে মরে। আর তার ফলে মায়ের শরীর দিন দিন ভেঙে পড়ে।

         একদিন মা-ব্যাঙ তার ছেলেকে ডেকে বলল–আমি বেশ বুঝতে পারছি যে আমার আয়ু ফুরিয়ে আসছে। আমি মরে গেলে তোর যে কি গতি হবে সেই ভাবনাতেই আমি অস্থির হচ্ছি। আমি যে মরেও সুখ পাব না বাবা! যাক, একটা কথা তোকে বলি শোন। আমি মরে গেলে আমাকে নদীর গর্তে পুতে দিস। ভুলেও যেন পাহাড়ের উপরে আমায় ফেলে আসিস না। গ্যাঁ-গোঁ শান্তভাবে বলল—বেশ, তাই করব মা।

 

     আসলে গ্যাঁ-গোঁ’র  মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল যে তার মৃতদেহ যেন পাহাড়ের উপরে পুঁতে দেয় তার ছেলে। নদীর গর্তে তার দেহ যেন কখনো না পোঁতে গ্যাঁ-গোঁ। তার মা মনে মনে ভেবেছে সে ছেলেকে যা আদেশ করবে, ছেলের  দুষ্টু স্বভাব অনুযায়ী নিশ্চয়ই ছেলে তার উল্টো কাজ করবে, তাই কৌশল করে গ্যাঁ-গোঁ’কে তার মা নিজের আসল ইচ্ছা না জানিয়ে উল্টো ইচ্ছার কথা শোনালো। মা নিশ্চিত যে ছেলেকে সে যা বলেছে, ছেলে ঠিক তার উল্টো কাজটাই করবে। তাহলেই তার মনের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হবে।

 

     মায়ের মৃত্যুর সময় গ্যাঁ-গোঁ মায়ের পা ছুঁয়ে শপথ করল যে সে তার মায়ের মরদেহ নদীর গর্তেই পুঁতে দেবে। মায়ের চোখে জল দেখে গ্যাঁ-গোঁ’ও কাঁদতে শুরু করল। সে মনে মনে অনুশোচনা করছে যে মা বেঁচে থাকার সময়ে মায়ের কোন কথাই সে শোনেনি। কথা রাখা তো দূরের কথা, বরং উল্টো কাজই করেছে। কিন্তু আজ মায়ের মৃত্যুদৃশ্য দেখে তার মনে সত্যি পরিবর্তন এলো। সে আপন মনে প্রতিজ্ঞা করল যে মায়ের শেষ ইচ্ছা সে পূরণ করবেই করবে। কোনো মতেই অন্যথা করবে না।

     কিছুক্ষণের মধ্যেই মা-ব্যাঙ মারা গেল। গ্যাঁ-গোঁ মায়ের শেষ ইচ্ছার কথামতো চোখের জল ফেলতে ফেলতে মায়ের দেহ নদীর গর্তে পুঁতে দিল। বিধাতাপুরুষ গ্যাঁ-গোঁ’র এই  মাতৃভক্তির নমুনা দেখে আড়ালে হাসলেন।

 

      মায়ের মৃত্যুর পর বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। গ্যাঁ-গোঁ আর আগের মতো দুষ্টুমি করে না, মিথ্যা কথাও বলে না। মায়ের শোক তাকে অনেক শান্ত আর ভদ্র করে তুলেছে, মাকে সে কোনো মতেই ভুলতে  পারছে না। সব সময় মায়ের মুখ তার চোখের সামনে ভাসে। সে নীরবে কেবল চোখের জল ফেলে। এক সময় বর্ষা শুরু হল। চারিদিক জলে থৈ-থৈ করছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে নদীতে বান ডাকল। আর বানের স্রোতে গ্যাঁ-গোঁ’র মায়ের দেহ কোথায় যেন ভেসে গেল। গ্যাঁ-গোঁ বৃষ্টি ধরলে আর বানের জল কমে গেলে নদীর পাড়ে এলো তার মায়ের কবর দেখতে। কিন্তু কবর কোথায়? চারিদিক জলের স্রোতে ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে। বর্ষার এই তাণ্ডবের প্রতিবাদ জানানোর জন্য গ্যাঁ-গোঁ দুঃখে-কষ্টে প্রচন্ড শব্দে গ্যাঁ-গোঁ, গ্যাঁ-গোঁ করে চিৎকার শুরু করল। সেদিন থেকে বর্ষার দিনে বৃষ্টি পড়লেই ব্যাঙেরা আর্তস্বরে ডাক ছাড়ে–গ্যাঁ-গোঁ, গ্যাঁ-গোঁ।


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up