ছোটোদের চাঁদের হাসি / দেশ-বিদেশের গপ্পো / মার্চ ২০২৪

লক্ষ টাকার মুদ্রা

 

রমাই ছিল সরল মনের মানুষ৷ খুবই পরিশ্রমী। অনেকদিন ধরে সে জমিয়ে ফেলল একলক্ষ টাকা। এত টাকা সে কোথায় রাখবে? ঘরে মানুষ বলতে সে, তার বউ আর তাদের ছোটো ছোটো ছেলে। ভাবতে ভাবতে ভগুবাবুর কথা মনে এলো তার৷ প্রতিবেশী মানুষ, ব্যবসা করে৷ মানুষ হিসেবেও ভালো৷ বউকে সে কথা বলল রমাই–এ টাকা ভগুবাবুর কাছে জমা রাখবে, প্রয়োজনে ফিরিয়ে নেবে৷                   

বউ বলল, বেশ কথা, কিন্তু মানুষটাকে বিশ্বাস করা যায় তো?

রমাই বলল, বারে, কতদিন ধরে দেখছি৷ খুবই ভালো লোক।

বউ আর আপত্তি করল না।

তখন রমাই ভগুবাবুকে সে প্রস্তাব দিতে, ভগুবাবু এককথায় রাজি হয়ে গেল। রমাই অনেকগুলো থলিতে গুনে গুনে টাকা ভরে ভগুবাবুর বাড়িতে দিয়ে এলো৷ ভগুবাবু টাকা সিন্দুকে ভরে রাখল৷

 

দিনের পরে দিন গড়িয়ে গেল। মাঝে মাঝে, ক্কচিৎ কখনো ভগুবাবুর কাছ থেকে নিতান্ত প্রয়োজনে কিছু টাকা চেয়ে নিয়েছে রমাই। ইতিমধ্যে রমাইয়ের ছেলে ডাগর হয়েছে। তার বিয়ে দিতে হবে৷ সে নিজের মতো করে সংসার করবে। তাই টাকাগুলো এনে তার হাতে তুলে দেবে বলে রমাই এক সকালে ভগুবাবুর বাড়ি গেল৷

রমাই বলল, দাদা, ছেলেটা তো বড় হয়েছে, এবারে কাজকর্ম শুরু করবে৷ এবারে তো টাকার দরকার৷ তুমি আমার টাকাটা ফেরৎ দাও–এক লক্ষ টাকা৷

তা শুনে ভগুবাবু একটু চমকে উঠল, টাকা? কিসের টাকা? তারপরে বলল, এখন ভীষণ ব্যস্ত আছি, তুমি পরে একদিন এসো৷

রমাই বাড়ি ফিরে এলো৷ সাতদিন পরে ফের ভগুবাবুর বাড়ি গেল৷ দেখল, ভগুবাবু তার দোকানঘর সাজাচ্ছে ৷ তাকে দেখে বলল, দেখছো তো, জরুরি কাজে ব্যস্ত আছি৷ এখন যাও৷

কদিন বাদে রমাই আবার এল ভগুবাবুর বাড়ি৷

কড়া নাড়তে দরজা খুলে তাকে দেখে ভগুবাবু তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। কী আপদ, এমন অসময়ে তুমি এলে? আমার বউয়ের বড়ই অসুখ, তাকে নিয়ে মরছি আমি। এখন যাও–বলে দরজা বন্ধ করে দিলো ৷

 

রোজ রোজ নানা বাহানায় তাকে ফিরিয়ে দেওয়ায় রমাইয়ের মনে সন্দেহ দেখা দিলো৷ বাড়ি ফিরে বউকে সব কথা জানালো। বউ বলল, এবারে যখন তুমি যাবে, ওর কথায় কান না দিয়ে টাকা চাইবে৷ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরবে।

কদিন বাদে রমাই ফের ভগুবাবুর বাড়ি গেলে সে বলল, কিসের লক্ষ টাকা তুমি চাইতে এসেছ? হ্যাঁ, দিয়েছিলে বটে একলক্ষ টাকা। কিন্তু এত বছরে কত কাজে টাকা নিয়েছ তুমি, সে খেয়াল আছে? এই গুরুদেব এসেছেন, তার সেবায় পাঁচশো টাকা নিলে। ছেলের অসুখে তিনশো টাকা। সেবারে ঘি কিনতে পঞ্চাশ টাকা। জুতো কিনতে কুড়ি টাকা। এমনি সব হিসেব এই খাতায় লেখা আছে। ভালো করে সব দেখে নাও৷ তোমার পাওনা হয়তো সামান্য কিছু হবে, তা খাতা দেখে ঠিক করে নাও। আমার কাজে কোন ফাঁকি পাবে না৷ হিসেব করতে বসে, একসময় মনে হচ্ছিল আমারই বুঝি কিছু পাওনা হয়েছে তোমার কাছে। যাক সব তো দেখলে, আর জ্বালাতে এসো না আমার কাছে।

 

বাড়ি ফিরে বউকে এসব কথা বলার সময়ে কান্নায় রমাইয়ের গলা বুজে এল৷ এমন লোককে বিশ্বাস করে, সেই তো টাকাটা জমা করেছিল৷ সবটা তারই বোকামি। সব শুনে তার বউ কিন্তু ভাগ্যের দোহাই দিয়ে সবটা মেনে নিল না৷

সে বলল, লোকটা তো জোচ্চোর৷ আমার গোড়াতেই সন্দেহ হয়েছিল। যাক এখন হাল ছেড়ে দিলে হবে না৷ আমরা ন্যায়াধীশের কাছে বিচার চাইব।

তাদের অভিযোগ শুনে ন্যায়াধীশ ভগুবাবুকে ডেকে পাঠালেন৷ সে এসে তার তৈরি হিসেবপত্র দাখিল করল৷ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনে আরো বলল, লোকটা পাগল হয়ে গেছে হুজুর। সব টাকা নিজেই উড়িয়ে দিয়ে এখন আর মানতে চাইছে না৷

 

এই টাকা লেনদেনের কোন সাক্ষী ছিল না। ন্যায়াধীশ পড়লেন বিপাকে৷ সরল রমাইকে তিনি অবিশ্বাস করতে চাইছেন না, আবার ভগুবাবুর হিসাবের খাতাই বা অস্বীকার করেন কী ভাবে?

তার মানসিক দোটানার কথা রাজামশাইয়ের কানে গেল৷ তিনি নিজেই ভগুবাবুকে ডেকে পাঠালেন৷ সে এলে রাজামশাই বললেন, বাপু, সব তো শুনলাম৷ তা রমাই সব টাকা কি ফেরৎ নিয়েছে?

ভগুবাবু জবাব দিল, প্রায় সবটাই, তবে সামান্য কিছু পড়ে আছে।

–আচ্ছা,টাকা কি ওর দেওয়া থলিতেই রেখেছ, না তোমার নিজের টাকার মধ্যে মিশিয়ে রেখেছ? রাজামশাই শুধালেন৷

 –না,না, সে কী? ওর টাকা ওর থলিতেই আছে, তা থেকে ওর প্রয়োজনে টাকা দিয়েছি৷ ফাঁকা থলিগুলোই রাখা আছে।

রাজা মশাই বললেন, তা বেশ, পড়ে থাকা সেই থলির কিছু টাকা আমায় দেখাতে পারো?

–কেন পারব না, এই আনছি, বলে সে বাড়ি গিয়ে এক ছুটে টাকার থলি নিয়ে ফিরে এলো৷

 

রাজামশায়ের হাতে থলি তুলে দিলে, তিনি তা থেকে কটা মুদ্রা বের করে দেখলেন। তারপর আরো কটি বের করলেন, তাও মনোযোগ দিয়ে দেখলেন৷ তারপরে ভগুবাবুকে বললেন, বাপু তুমি সব মিথ্যা কথা বলেছ, সব মিথ্যা কথা৷ রমাই তোমায় কুড়ি বছর আগে যে মুদ্রার থলি তোমায় দিয়েছিল, তখন রাজা ছিলেন আমার ঠাকুর্দা। তখনকার মুদ্রায় ঠাকুর্দার মুখ আঁকা থাকত৷ রমাই তোমায় যে একলক্ষ মুদ্রা দিয়েছিল, তাতে হয় ঠাকুর্দার মুখ থাকবে নইলে তাঁর আগের কারোর। আমার মুখ আঁকা মুদ্রা কোনো মতেই বিশবছর আগে কেউ তোমায় দেয়নি৷ দিতে পারে না৷ তুমি মিথ্যে বলেছ৷ রমাইকে ঠকিয়েছ৷ ন্যায়াধীশকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করেছ ৷ রমাইয়ের টাকা ব্যবসায় খাটিয়েছ৷ আমার আদেশ, সাতদিনের মধ্যে রমাইয়ের পুরো একলক্ষ টাকা ফেরৎ দেবে৷ আর যতদিন ওই টাকা তোমার কাছে জমা ছিল, তার জন্য সুদ দেবে–এটা তোমার শাস্তি৷ আর হ্যাঁ, ভবিষ্যতে যদি তোমার নামে এমন কোন অভিযোগ পাই, তবে, তোমায় জেলে ঘানি টানতে হবে৷ এবারে যাও৷ রাজের আদেশে মাথা নিচু করে ভগুবাবু রাজসভা থেকে ফিরে এলো৷ রাজার ন্যায় বিচারে রমাই ফিরে পেল তার টাকা।

 

             

 


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up