ভগবানের বিপদ
জ্যোতির্ময় দাশ
(প্রাচীন বাংলার লোককথা)
ভগবান হলেন ভাগ্যবিধাতা। জন্মের সময় তিনি সকলের কপালে তার ভাগ্যের কথা লিখে দেন। একবার এক ব্রাহ্মণের আগের জন্মের শাস্তি দেবার জন্য তার কপালে বিধাতা একটা আশ্চর্যজনক কথা লিখে দিলেন, যে, সে কোনোদিন পেট ভরে খেতে পাবে না। আধ-পেটা খাবার পর তার আর খাওয়া হবে না। দেখা গেল, তাই ঘটতে লাগল, কেন না কোনো কারণে ব্রাহ্মণ আর পুরো খেতে পারে না।
ব্রাহ্মণকে একদিন সে দেশের রাজা খাওয়ার জন্যে নেমন্তন্ন করলেন। নেমন্তন্ন পেয়ে ব্রাহ্মণ তো ভীষণ খুশি। ব্রাহ্মণীকে ডেকে বলল, “এতদিন আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়েছে। পেটপুরে খাবার আনন্দ যে কীরকম হয়, তা কখনো জানতেই পারিনি। আজ রাজার নেমন্তন্ন পেয়েছি, এমন সৌভাগ্য আগে হয়নি। কিন্তু নেমন্তন্ন খেতে যাই কী করে? আমার কাপড় ছেঁড়া, জামা ময়লা। এমন কাপড়-জামা পরে গেলে তো রাজপ্রাসাদের পাহারাদারেরা আমাকে ঢুকতেই দেবে না।”
ব্রাহ্মণী বলল, “তোমার কাপড় সেলাই করে, জামা কেচে দিচ্ছি ভালো করে।” সত্যি-সত্যিই ব্রাহ্মণী যত্ন করে ব্রাহ্মণের পোশাক ঠিক-ঠাক করে দেয়।
সেসব করে ব্রাহ্মণের রাজবাড়িতে পৌঁছতে বেশ দেরি হয়ে গেল। তখন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে চলেছে। তাও রাজার লোকজনেরা ব্রাহ্মণকে খাতির-যত্ন করে খাবার ঘরে নিয়ে গেল। নানা ধরনের খাবারদাবার দেখে ব্রাহ্মণের মন ভরে গেল। সে ভাবল, ‘যে যাই বলুক, আজ পেটপুরে, দরকার হলে দুজনের খাবার একা খাবে।’ খাবার আসনে বসে ব্রাহ্মণ খেতে আরম্ভ করল। সে যেখানে খেতে বসেছিল, ঠিক তার মাথার ওপরে একটা দড়ির শিকেতে একহাঁড়ি মশলাপাতি টাঙিয়ে রাখা ছিল। ব্রাহ্মণের আধ-পেটা খাওয়া হতেই সেই শিকে ছিঁড়ে হাঁড়িটা তার খাবার থালায় পড়ে ভেঙে খাবার সব নষ্ট হয়ে গেল। ব্রাহ্মণ খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ল। আজও তার কপাল খারাপ, পেটপুরে খাওয়া জুটল না।
হাত-মুখ ধুয়ে সে রাজার সঙ্গে দেখা করতে গেল। রাজা তাকে আদর করে সভায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বামুন ঠাকুর, আজ খাওয়া কেমন হল। ভালো করে সবকিছু খেয়েছেন তো?”
ব্রাহ্মণ জানাল, “মহারাজ, আপনার লোকজনেরা তো আদর-যত্ন করে সবকিছু দিয়েছিল। কিন্তু আমার কপালে লেখা না থাকলে আমি পেট ভরে খাব কী করে?”
রাজা আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলেন, “কেন, কী এমন হল যে, আপনার খাওয়া হলো না।”
ব্রাহ্মণ তখন রাজাকে শিকে ছিঁড়ে পড়ার কথা বলল। সে কথা শুনে মহারাজের খুব আফসোস হল। তিনি লোকজনদের ডেকে ধমক-ধামক দিলেন খুব। ব্রাহ্মণকে বললেন, “পন্ডিত ঠাকুর, আজ রাতটা আপনি রাজবাড়িতেই বিশ্রাম করুন। কাল সকালে আমি নিজের হাতে আপনাকে খাবার পরিবেশন করব।” সে কথায় গরিব ব্রাহ্মণ রাতটা সেখানেই থেকে গেল।
সকালবেলা রাজা নিজে দেখাশোনা করে রান্না করালেন। তারপর কথামতো তিনি ব্রাহ্মণকে ডেকে নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করলেন। বিশাল খাবার ঘরে আজ আর কোথাও এমন কিছু ছিল না যে খাবার পন্ড হতে পারে। ব্রাহ্মণ নিজের সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখে, রাজার আতিথ্যে খুশি হয়ে খেতে বসল। ঠিক যখন ব্রাহ্মণের আধ-পেট খাওয়া হয়েছে, বিধাতা দেখলেন এবার ব্রাহ্মণকে থামাতে হবে। কিন্তু কীভাবে তা করবেন? বিধাতা কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারলেন না। শেষে ভগবান এক সোনা -ব্যাঙের রূপ ধরে ব্রাহ্মণের থালার কাছে এসে ভাতের মধ্যে লাফিয়ে পড়লেন।
এদিকে ব্রাহ্মণ প্রচুর ভালো ভালো খাবার দেখে আনন্দে মশগুল হয়ে প্রাণভরে খাচ্ছিল। সে কিছু না দেখে সেই ব্যাঙশুদ্ধ ভাতের গ্রাস মুখে পুরে খেয়ে ফেলল। খাওয়া শেষ হতে রাজা জানতে চাইলেন, “এবার বলুন পুরুতমশাই, আজ তৃপ্তি করে খেয়েছেন তো?”
ব্রাহ্মণ জানাল, “হ্যাঁ মহারাজ! এমন তৃপ্তি করে আগে কোনদিন জীবনে খাইনি আমি।” এরপর দানশীল রাজার কাছে ভোজন-দক্ষিণা আর ব্রাহ্মণীর খাবার বেঁধে নিয়ে বাড়ির জন্য রওনা হলো ব্রাহ্মণ।
বাড়ি ফেরার পথে একটা জঙ্গল পড়ে। জঙ্গলের কাছে পৌছাতেই ব্রাহ্মণ শুনতে পেল কেউ যেন বলছে, “ব্রাহ্মণ, এবার আমাকে ছেড়ে দাও।” ব্রাহ্মণ সে কথা শুনে চারপাশে চেয়ে কে কথা বলল দেখতে পেল না। কিন্তু একটু পরেই সে সেই একই কথা আবার শুনতে পেল, “ব্রাহ্মণ, আমাকে ছেড়ে দাও।”
ব্রাহ্মণ জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে কথা বলছ?” উত্তরে শুনতে পেল, “আমি বিধাতা বলছি।”
ব্রাহ্মণ এবার প্রশ্ন করে, “তুমি কোথা থেকে কথা বলছ? তোমাকে তো আমি দেখতে পাচ্ছি না।”
ভগবান বললেন, “তোমার পেটের ভেতর থেকে বলছি। তুমি আমাকে খেয়ে ফেলেছ।”
ব্রাক্ষণ বলল, “অসম্ভব! এমন হতেই পারে না।”
বিধাতা বললেন, “হ্যাঁ, এমনই হয়েছে। আমি ব্যাঙের রূপ ধরে তোমার খাওয়া বন্ধ করতে, তোমার ভাতের মধ্যে ঢুকেছিলাম। তুমি ভাতের সঙ্গে আমাকে পর্যন্ত খেয়ে নিয়েছ।”
ব্রাহ্মণ সে কথা শুনে বলল, “এর থেকে ভালো আর কিছু হতে পারে না। তুমি মোটেও মানুষ ভালো নও। সারাজীবন তুমি আমাকে কেবল দুঃখ দিয়েছ। এবার তোমাকে আমি ছাড়ব না। আমি মুখ চেপে বন্ধ করে থাকব যাতে তুমি বেরোতে না পারো।”
ভগবান এবার একটু ভয় পেয়ে বললেন, “ব্রাহ্মণ, আমাকে বেরিয়ে আসতে দাও। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আমার কষ্ট হচ্ছে।”
ব্রাহ্মণ সে কথায় কান না দিয়ে আরো তাড়াতাড়ি পা-চালিয়ে বাড়ি পৌঁছে ব্রাহ্মণীকে বলল, “চট করে হুঁকোতে তামাক ভরে নিয়ে এসো, আর সঙ্গে বাঁশের লাঠিটা নিয়ে এসো।” ব্রাহ্মণী হুঁকো আনতে ব্রাহ্মণ হুঁকো খেকে শুরু করতে পেটের মধ্যে ধোঁয়া ঢোকায় বিধাতাপুরুষের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেল। তিনি চিৎকার করতে থাকেন,কিন্তু ব্রাহ্মণ সে কথায় কান দেয় না।
এদিকে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল, তিনলোকেই হৈ-চৈ পড়ে গেল। বিধাতা না থাকলে ত্রিলোকের কাজকর্ম সব সুষ্ঠুভাবে হবে কী করে! ব্রহ্মাণ্ড রসাতলে যাবার উপক্রম হল। দেবতারা জরুরি আলোচনায় বসলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁদের মধ্যে কেউ একজন ব্রাহ্মণকে বিধাতাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করতে যাবেন।
কিন্তু কে যাবেন? শেষে সকলে মিলে ঠিক করলেন লক্ষ্মীদেবীর যাওয়াই ভালো হবে।
লক্ষ্মী বললেন, “আমি ব্রাহ্মণার ঘরে গেলে সে যদি আমাকেও ধরে রাখে? তাহলে তো আমিও ফিরে আসতে পারব না।” কিন্তু অন্যসব দেবতা হাতজোড় করে অনুরোধ করাতে লক্ষ্মী যেতে রাজি হলেন।
ব্রাহ্মণ যখন জানতে পারলেন যে ঐশ্বর্যের দেবী তার বাড়িতে এসেছেন, তখন সে গলবস্ত্র হয়ে লক্ষীকে আদর-আপ্যায়ন করে পুজোর আসনে বসিয়ে, জানতে চাইলেন তার মতো গরিবের কাছে তিনি কেন এসেছেন?
লক্ষ্মী বললেন, “ঠাকুরমশাই, তুমি বিধাতাকে বন্দী করে রেখেছ। তাঁকে ছেড়ে দাও। না হলে সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে।”
সে কথা শুনে ব্রাহ্মণ স্ত্রীকে বললেন, “ব্রাহ্মণী লাঠিটা নিয়ে এসো একবার। তোমাকে দেখিয়ে দেব সৌভাগ্যের দেবীর কেমন দুর্গতি হবে এবার। জন্ম থেকে আজ অবধি কোনোদিন আমাদের দিকে ফিরে তাকায়নি কখনো। দুর্ভাগ্য ছাড়া আমাদের কপালে কিছুই জোটেনি। আজ সেই লক্ষ্মীকে যখন হাতে পেয়েছি একবার, এবারে আর ছেড়ে কথা বলব না।” এ কথা শুনে লক্ষ্মীদেবী ভয়ে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আজকের আগে এত যুগ ধরে তাঁর সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলেনি। স্বর্গে ফিরে তিনি অন্য দেবতাদের সব বললেন। তাড়াহুড়ো করে সকলে আলোচনায় বসে ঠিক করলেন যে এবার বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে ব্রাহ্মণের কাছে পাঠানো হোক।
সরস্বতী ব্রাহ্মণের বাড়ির সদরে এসে ডাক দিলেন, “বামুন ঠাকুর, তুমি বাড়িতে আছো কী?” ব্রাহ্মণ বাইরে বেরিয়ে এসে তাঁকে প্রণাম করে বলল, “মা সরস্বতী, এক গরিব ব্রাহ্মণের কাছে আপনি কেন এসেছেন বলুন?”
সরস্বতী জানালেন, “ঠাকুর, তোমার জন্যে ব্রহ্মাণ্ডের ঘোর অনিষ্ট হতে চলেছে। তুমি বিধাতাপুরুষকে ছেড়ে দাও।”
ব্রাহ্মণ রেগে লাল হয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, “ব্রাহ্মণী, আমার লাঠিটা একবার আনো তো! আমি এবার বিদ্যার দেবীকে একটু লেখাপড়া করাব। যে দেবী আমাকে কোনোদিন অক্ষরজ্ঞানের শিক্ষা পর্যন্ত দেয়নি, আজ সেই সরস্বতী কী বলতে আমার বাড়িতে পা রেখেছে, দেখে নেব এবার।” সরস্বতী ব্রাহ্মণের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন আবহাওয়া বিশেষ ভালো নয়। তিনিও দিদি লক্ষীর মতো সেখান থেকে তড়িঘড়ি পালালেন।
শেষ পর্যন্ত দেবাদিদেব ভগবান শিব সমস্যার সমাধান করতে এলেন। ব্রাহ্মণ পরম শিবভক্ত। সকালে শিবের পুজো না করে সে মুখে জল পর্যন্ত দেয় না। শিব বাড়িতে পা রাখতেই ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী শিবের পা ধুইয়ে, ফুল বেলপাতা চন্দন কুশ দিয়ে নিয়মমতো তাঁর পূজা-আরতি করে।পুজো-পাটের পর শিবঠাকুর আসন গ্রহন করে বললেন, “ব্রাহ্মণ, বিধাতাকে ছেড়ে দাও!”
ব্রাহ্মণ হাতজোড় করে বলে, “দেবাদিদেব, আপনি যখন এসেছেন স্বয়ং, তখন জানি বিধাতাকে আমায় ছেড়ে দিতেই হবে। তবে , এই অবস্থার জন্যে ওই বিধাতাই দায়ী।”
ভোলানাথ শংকর বললেন, “আর তোমাদের কোন চিন্তা করতে হবে না। আমি তোমাদের সশরীরে স্বর্গে নিয়ে যাব আমার সঙ্গে।”
এ কথা শুনে ব্রাহ্মণ গলা আলগা করে মুখ হাঁ করে দাঁড়াতেই বিধাতাপুরুষ তড়াক করে লাফিয়ে বেরিয়ে এলেন। ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীকে শিব নিজের সঙ্গে স্বর্গের নন্দনকাননে পারিজাত গাছের তলায় এসে নামালেন।
পাঠকদের মন্তব্য
250