ছোটোদের চাঁদের হাসি / দেশ-বিদেশের গপ্পো / জুন ২০২৪

পরিযায়ী পাখি

(অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ)

 

যদিও বেশ শীত এবং কুয়াশা জেঁকে বসেছে, তবুও আজকের সকালটা খুব ভালো লাগল তিতলির। আজ খুব মজা হবে। সারাদিনের জন্য বন্ধুদের সাথে পিকনিক করে কাটাবে। স্কুলের বাসে চলছে সবাই গান গাইতে গাইতে। উদ্দেশ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে নাচ-গান হবে, খেলাধুলা হবে। দুপুরে পোলাও-মাংস, রোস্ট। তারপর বিকেলে ফেরার আগে পাখি দেখা। খুব এক্সাইটেড লাগছিল তিতলির। শান্তা, পুষ্পিতা, টুম্পা, নিধি আরও কত কত বন্ধু! বাবা-মাকে ছাড়া শিক্ষকদের সাথে–শুধু বন্ধুরা–কী যে মজা! বাসে কেক, কলা, ডিম দিয়ে নাস্তা। এভাবেই কখন যেন পৌঁছে গেল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে হারিয়ে যাওয়ার অনেক জায়গা। তবু কাছাকাছি থাকা চাই সবার। শান্তা আর টুম্পা ঘাসে হাত ছুঁইয়ে খুশিতে হেসে ওঠে। তিতলি কাছে যায়। অবাক হয়ে যায় কাণ্ড দেখে। হাত ছোঁয়ালেই চিরল চিরল পাতার সবুজ লতা কেমন চুপসে যায়। শান্তা তিতলিকে বলল–দ্যাখ দ্যাখ, এটা লজ্জাবতী লতা। তিতলিও খেলায় যোগ দেয়। হাত ছোঁয়ায়, আর চুপসে যায়। গাছেরও লজ্জা আছে! জীবনে এই প্রথম দেখল, গাছও মানুষের মতো লজ্জা পায়। চোখে তার বিস্ময়। খেলাধুলা হলো, নাচ-গান হলো, দুপুরের খাওয়া হলো। এরপর পাখি দেখতে বেরনো।

 

লেকের জলে হাজার হাজার পাখি। পদ্মফুলের মতো ফুটে আছে, লাল শাপলার ফাঁকে ফাঁকে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে। নামছে। জলে ভাসছে। কিচিরমিচির করছে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। এ যেন পাখিদের গান। এত পাখি একসাথে কখনও দেখে নি সে। ধরিত্রী আপু বুঝিয়ে দিলেন–এগুলো পরিযায়ী পাখি। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আসে। সাইবেরিয়াতে তখন প্রচণ্ড শীত। মাইনাসে চলে যায়। হিমালয় ডিঙিয়ে এ পাখিরা তখন উড়ে উড়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে। শীত শেষে আবার চলে যায়। মাত্র কয়েক মাসের জন্য আসে। এ জন্য এদেরকে অতিথি পাখি বলে। এক ধরনের বালিহাঁস। এরা খুব পরিশ্রমী হয়। অনেকে পাখি হত্যা করে। পাখির মাংস খায়। পাখি ধরে বিক্রি করে। তা অন্যায়। বাড়িতে কোনো অতিথি এলে আমরা কি তাকে মারি? আদর-যত্ন করি। তাকে অপমানিত করি না। অথচ মানুষ পাখিকে মারে। কোনো কোনো শিক্ষিত মানুষও পাখির মাংস খায়। অতিথি পাখি নিধন করা অন্যায়।

 

মনোযোগ দিয়ে এসব কথা শুনছিল তিতলি ও তার বন্ধুরা। এত কিছু জেনে তাদের ছোট্ট হৃদয় কানায় কানায় ভরে গেল। সবে ক্লাস থ্রিতে উঠেছে তারা। বছরের শুরুতেই আনন্দ-ভ্রমণ। খুব ভালো লেগেছে গোটা আয়োজন। সন্ধে হয় হয়। সবাই বাসে উঠে গেছে। এবার ঘরে ফেরার পালা। তিতলির মনে হলো পরিযায়ী পাখিরাও এরকম কিছুদিনের জন্য বেড়াতে আসে। তারপর বাড়ি ফিরে যায়। বাবা-মা’র কথা মনে পড়ল। সারাদিন তেমন মনে পড়েনি। এখন মনটা কেমন করছে। তিতলির মনে হলো অতিথি পাখিদেরও খুব কষ্ট। ঘর ছেড়ে কতদিন এদেশে। ওরাও যখন বাড়ি ফেরে, ওদেরও এমনি আনন্দ হয় নিশ্চয়ই!

 

স্কুলের গেটে যখন পৌঁছল, তখন সন্ধে উৎরে রাত। বাবা দাঁড়িয়েছিল তার অপেক্ষায়। সবার বাবা-মাই অপেক্ষা করে আছে। তিতলির মনে হলো পরিযায়ী পাখিদের বাবা-মাও কি তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে? বাবাকে দেখে কী যে খুশি হলো তিতলি! পাখিরাও নিশ্চয় তেমন খুশি হয়? পাখিরা তার মনের মধ্যে একটা দাগ কেটে গেছে। পাখির সাথে নিজের, আর নিজের সাথে পাখির মিল খুঁজতে থাকে সে। এরপর বাবার সাথে বাসায় পৌঁছে গেল তিতলি। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া শেষ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বকবক করে বাবা-মাকে সারাদিনের মজার কথা বলতে লাগল। লজ্জাবতী লতার কথা, পরিযায়ী পাখির কথা, খাবার কথা, বন্ধুদের কথা–কত কথা! বেশ পরিশ্রম হয়েছে। বিছানায় শোওয়ামাত্র বকবক করতে করতে ঘুমিয়ে গেল তিতলি।

 

তিতলি দেখতে পেল, সে লেকের ধারে একা বসে আছে। দুটো পরিযায়ী পাখি এসে তাকে বলছে–তুমি যাবে আমাদের দেশে? সাইবেরিয়া? অনেক দূর। প্রচণ্ড শীত। চারদিকে শুধু তুষার আর তুষার। হিমালয়ের উপর দিয়ে যেতে হয়। খুব ভালো সে দেশ। কোনো মানুষ সেখানে যেতে পারে না। তুমি যাবে? আবার ফেরত দিয়ে যাব তোমাকে তোমার বাবা-মার কাছে। তিতলি রাজি হয়ে গেল। একটা বড় পরিযায়ী পাখির পিঠে চড়ে বসল সে। অমনি পাখিটা উড়তে শুরু করল। আকাশ থেকে পৃথিবীকে অন্যরকম দেখায়। গাছপালা ছোট ছোট গুল্মের মতো। নদীগুলো যেন রাস্তার মতো শুয়ে আছে। রাস্তাগুলো দড়ির মতো। কী যে ভালো লাগছিল তার! হিমালয়ের উপর দিয়ে সাইবেরিয়া পৌঁছে গেল। তিতলির বেশ শীত শীত লাগছিল। কিছুদিন পরে আবার বাংলাদেশের পথে উড়াল দিল। লেকের কাছাকাছি আসতেই বিকট এক শব্দ। এক শিকারী পাখিটাকে গুলি করল। পাখিটা রক্তাক্ত হলো। ডানা ভেঙে গেল। তিতলি ছিটকে পড়ল, জলের মধ্যে। সাঁতরাতে চেষ্টা করছে। পারছে না। চিৎকার দিয়ে উঠল। ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় বসে পড়ল। পাখিটার জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। যদিও স্বপ্ন, তবুও। তার মনে হলো, মানুষ কত খারাপ! এভাবে পাখিকে কেউ গুলি করে?

 

কিছুদিন বাদে এক বিকেলে তিতলির বাবা ঘরে ঢুকেই ডাকল, তিতলি, দেখে যাও, কী এনেছি ?

তিতলি দৌড়ে দরোজার কাছে গিয়ে হতবাক। একজোড়া বালিহাঁস। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। বলল,

–বাবা, এ তো পরিযায়ী পাখি! এদের কেন এনেছো?

–তুমি কী করে জানলে, এদের পরিযায়ী পাখি বলে?

–ধরিত্রী আপুমণি বলেছে। অনেকে এ পাখির মাংস খায়। এটা অন্যায়।

–আমিও তো খাবার জন্যেই কিনে এনেছি।

কথাটা শুনেই কান্না জুড়ে দিল তিতলি। তার বাবাও তাহলে অন্য মানুষের মতো? ছুটে দৌড়ে বেডরুমে গিয়ে দরজা আটকে দিল। তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। পাখি দু’টো তার দিকে কেমন কাকুতি করে তাকাচ্ছিল। বালিশে মুখ গুঁজে সে কান্না জুড়ে দিল। হাত-মুখ ধুয়ে বাবা এসে সান্ত্বনা দিচ্ছে, এগুলো তো পাখি! মানুষ তো পাখির মাংস খায়! তুমিও তো আগে খেয়েছ! এতে সমস্যা নেই তো!

–আগে তো আমি বুঝিনি। তাছাড়া আমি তখন জানতাম না। আমি আর পাখি খাব না। তোমরাও খাবে না। কেউ খাবে না। ওরা অতিথি। অতিথিকে কেউ খায়?

–অনেক টাকা দিয়ে কিনেছি মা ! এবার খাই। পরে আর খাব না।

–না। এবারও খাওয়া যাবে না। তুমি ওদের ছেড়ে দাও। বলো বাবা, ছেড়ে দেবে? ওদের ছেড়ে না দিলে আমি আর কিচ্ছু খাব না।

–আচ্ছা, আচ্ছা, আমার বুদ্ধিমতী মেয়ে। সত্যি আমার ভুল হয়েছে মা। আর কোনোদিন পাখির মাংস খাব না। ওরা অতিথি। কাল সকালেই ধানমণ্ডি লেকে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসব।

–আমিও যাব তোমার সাথে।

–আচ্ছা মা। তুমি আমার চোখ খুলে দিলে।

সকালে ধানমণ্ডি লেকে গিয়ে দু’টো হাঁসকেই নিজের হাতে উড়িয়ে দিল তিতলি। তারা প্রথমে গিয়ে জলে পড়ল। তারপর উড়াল দিল আকাশে। হাঁসদুটো ক্যাঁক ক্যাঁক করে ডেকে উঠল। তিতলির মনে হলো, হাঁস দুটো তাকে থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ বলল। পেছনে ঘুরে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল তিতলি–থ্যাঙ্ক ইউ বাবা। তুমি খুব ভালো।       

   

 

 


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up