ছোটোদের চাঁদের হাসি / দেশ-বিদেশের গপ্পো / ডিসেম্বর ২০২৪

এক নিষ্কর্মা বুদ্ধুরামের গল্প

(আজারবাইজানের লোকগল্প)

 

অনেক আগের কথা। এক গাঁয়ে সিদ্উল্লা নামে ছিল একটি ছেলে। অলস, নিষ্কর্মা, বুদ্ধুও বটে। অকারণে রাস্তায় ঘোরে, কিন্তু কাজের কথা বললেই ফুড়ুৎ।

   ঘরে সিদ্উল্লার বউ-ছেলে আছে। তাদের কপাল বড়ই খারাপ। এমন মানুষের হাতে পড়েছে যে দিনের পর দিন তাদের খাবারই জোটে না। নতুন জামা-কাপড়? সে স্বপ্নও তারা আর দেখে না, ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে কোনওরকমে দিন পার করে দেয়।

 

   এমন অবস্থা তো দিনের পরে দিন চলতে পারে না। একদিন বউ তার বিদ্রোহ করে বসল–“তুমি কোন ব্যবস্থা করবে কী না বলো। আমার কথা বলছি নে, কিন্তু ছেলেটার দিকে তো আর চোখ মেলে চাওয়া যায় না। বলো কী করবে।”

    সিদ্উল্লা তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “বাপু, আর দুঃখ করো না। তোমার কপাল খুলল বলে। এখন আমরা গরিব আছি বটে। তবে আর ক’দিনের মধ্যে আমরা বড়লোক হয়ে যাচ্ছি।”

    “বলছো কি!” বউ অবাক হয়ে বলে। এতদিনে তো শুয়ে বসেই কাটালে–কুটোটি নাড়তে দেখলাম না একদিনও। আর বলছ, বড়লোক হয়ে যাবে? মানেটা কী?”

   সিদ্উল্লা বলল, “বলছি তো ক'টা দিন সবুর করো। আর কদিনের মধ্যে আমরা বড়লোক হব।”

 

   দিনের পর দিন কেটে গেল, বউ-ছেলে অপেক্ষায় রইল। অবস্থার কোন বদল হলো না। তারা তেমনি হদ্দ গরিব পরিবারই রয়ে গেল।

   বউ এবারে খুব রেগে বলল, “আমার কথা নয় ছেড়ে দিলাম, ছেলেটার দিকে কখনো চেয়ে দেখেছ–হাড়ের ওপর চামড়াটা শুধু লেগে রয়েছে। এবারে মরব সবাই।”

      তাই তো! কী করা যায়? ভেবে ভেবে সিদ্উল্লা ঠিক করল, সে এবারে এক জ্ঞানী পুরুষের খোঁজে বের হবে, যিনি ওকে বড়লোক হবার পথ বাতলে দেবেন। মনস্থির করেই সে পথে বেরিয়ে পড়ল।

 

   তিনদিন তিনরাত সে হেঁটে হেঁটেই চলল। যেতে যেতে দেখা হলো এক নেকড়ের সঙ্গে। রোগা লিকলিকে  চেহারা। যেন কতকাল খাবার জোটেনি তার। সে সিদ্উল্লাকে জিজ্ঞেস করল, “এমন হনহনিয়ে কোথায় চলেছ ভাই?” সিদ্উল্লা বলল, “আমি সেই জ্ঞানীলোকের সন্ধানে যাচ্ছি, যিনি বলে দেবেন, কোনো কাজ না করে কিভাবে আমি বড়োলোক হতে পারি।”

     সে কথা শুনে নেকড়ে তাকে বলল, “তুমি তো যাচ্ছ, আমার কথাটাও তাকে একটু শুনিয়ে দেবে? তিন বছর ধরে আমি পেটের ব্যথায় দারুণ কষ্ট পাচ্ছি। দিনরাত ব্যথায় তিষ্টোতে পারছি না। দোহাই, তুমি তো যাচ্ছ, তাঁর  কাছে জেনে নেবে কীভাবে এ ব্যথার উপশম হবে?”

   সিদ্উল্লা বলল, “ঠিক আছে, আমি তোমার কথাও শুধিয়ে নেব।”

 

   আবার ফের তিন দিন তিন রাত সে হেঁটে হেঁটে চলল। এবার সে দেখল, পথের ধারে একটি আপেল গাছ রয়েছে। সে সিদ্উল্লাকে জিজ্ঞেস করল, “এমন হনহনিয়ে কোথায় চলেছ ভাই?” সিদ্উল্লা বলল, “আমি সেই জ্ঞানীলোকের সন্ধানে যাচ্ছি যিনি বলে দেবেন, কোনো কাজ না করে কীভাবে আমি বড়োলোক হতে পারি”

   সে কথা শুনে আপেল গাছ তাকে বলল, “তুমি তো যাচ্ছ আমার কথাটাও তাঁকে একটু শুনিয়ে নেবে? প্রতি বছর আমার ডালে কুঁড়ি ধরে, ফুল হয়, কিন্তু ফল ধরে না। ফুল বিবর্ণ হয়ে ঝরে যায়। তুমি তো যাচ্ছ, তাঁর কাছে জেনে নেবে কীভাবে আমার ডালে ফের ফল ধরবে?”

    সিদ্উল্লা বলল, “ঠিক আছে, তোমার কথাও আমি শুধিয়ে  নেব।”

 

   তারপর ফের তিন দিন তিন রাত সে হেঁটে হেঁটে চলল। শেষে বড় এক দীঘির সামনে এসে থামল। হঠাৎই সেই দীঘির গভীর জলতল থেকে প্রকান্ড এক মাছ জলে ঘাই মেরে মাথা তুলে বলল, “এমন হনহনিয়ে কোথায় যাচ্ছ ভাই?” সিদ্উল্লা বলল, “আমি সেই জ্ঞানী মানুষের সন্ধানে যাচ্ছি, যিনি বলে দেবেন কোনো কাজ না করে কীভাবে আমি বড়োলোক হতে পারি।”

   সে কথা শুনে মাছ বলল, “তুমি তো যাচ্ছ, আমার কথা তাঁকে একটু শুধোবে? আমার গলায় ভয়ানক যন্ত্রণা, তিষ্টোতে পারি না, কীভাবে তার উপশম হবে?”

    সিদ্উল্লা বলল, “ঠিক আছে, তোমার কথাও আমি শুধিয়ে নেব।”  

      

   আবার তিন দিন তিন রাত সে হেঁটে হেঁটে চলল। এবারে এসে পৌঁছল এক কুঞ্জবনে। চারিদিকে শুধু গোলাপ–নানা রঙের গোলাপ ফুটে রয়েছে। সেই কুঞ্জবনের মাঝে এক আসনে এক সৌম্য বৃদ্ধ বসে রয়েছেন। একমুখ সাদা দাড়ি। তাঁর দিকে চাইলেই শ্রদ্ধায় মন ভরে ওঠে। তিনি বললেন, “সিদ্উল্লা, তুমি এখানে? কী চাই তোমার?” সিদ্উল্লা চমকে উঠল, বৃদ্ধ তার নাম জানেন! আশ্চর্য! ইনিই, হ্যাঁ ইনিই সেই জ্ঞানী পুরুষ, যাঁর সন্ধানে সে এতদূর এসেছে।

    সিদ্উল্লা করজোড়ে তাঁকে শুধোল, “আপনি আমার নাম জানলেন কি করে? আপনিই কি সেই জ্ঞানী পুরুষ যাঁর সন্ধানে আমি এত পথ হেঁটেছি?”

    স্মিত হেসে বৃদ্ধ বললেন, “ঠিক ধরেছ, তবে আমার কাছে যা চাইবে ভেবেছ তা চট করে বলে ফেল।”

    সিদ্উল্লা মন খুলে তার এখানে আসার কারণ বলল, বৃদ্ধ তার কথা শুনলেন। পরে বললেন, “তোমার আর কিছু বলার আছে?” তা শুনে সিদ্উল্লার মনে পড়ল পথে দেখা নেকড়ে, আপেল গাছ আর মাছের কথা। সে তাদের দুর্দশা থেকে মুক্তির পথ জ্ঞানী পুরুষের কাছে জানতে চাইল।

 

   সব শুনে বৃদ্ধ বললেন, “ওই মাছটার গলায় মস্ত বড়ো একটা মণি আটকে রয়েছে, ওটা খুলে দিলেই ওর রোগ সেরে যাবে, কোনো যন্ত্রণা থাকবে না। আর, আপেল গাছের নিচে মাটিতে মোহর-ভরা একটা রুপোর কলস রয়েছে। মাটি খুঁড়ে কলস তুলে দিলেই আপেল গাছে ফল ধরবে, ফুল আর বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়বে না। আর নেকড়েকে বলো, ওর দেখা প্রথম নিষ্কর্মা বুদ্ধুকে গিলে খেলেই ওর সব যন্ত্রণার অবসান হবে।”

   “আর আমার কথা প্রভু কিছু বললেন না তো !”– সিদ্উল্লা বিনীত প্রশ্ন করল। জ্ঞানী বৃদ্ধ বললেন, “তুমি যা চেয়েছ, তা তো দিয়েই দিয়েছি। এবার বিদেয় হও।”

 

    আর কিছু জানতে না চেয়ে সিদ্উল্লা বাড়ির পথে পা বাড়াল। দীঘির জলে মাছ তার  অপেক্ষায় ছিল।  সিদ্উল্লা তাকে বলল, “প্রভু তোমার ব্যথা উপশমের হদিস দিয়েছেন। তোমার আর চিন্তা নেই। তোমার কানকোয় একটা মস্ত বড়ো মণি আটকে রয়েছে, সেটা খুলে দিলেই তোমার যন্ত্রণার উপশম হবে।” মাছ বলল, ‘তা হলে তুমিই ওটা খুলে দাও ভাই। ওটা খুলে তুমি নাও, আমি প্রাণে বাঁচি। ও মণির অনেক দাম”

   “না বাপু, আমি ওসব পারব না। আমি এত খাটতে পারব না। প্রভু আমায় বড়োলোক হবার পথ বাতলে দিয়েছেন। আমার আর কুটোটি নাড়তে হবে না।” এই বলে সে বাড়ির পথে পা বাড়াল।

 

  পথে আপেল গাছ তার অপেক্ষায় ছিল। সিদ্উল্লা তাকে বলল, “প্রভু তোমার সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। তোমার আর চিন্তা নেই। তোমার নিচে মাটির ভেতরে একটা মোহর ভরা কলস রয়েছে। মাটি সরিয়ে কলস বের করে দিলেই, তোমার ডাল ফলে বোঝাই হয়ে যাবে আর বিবর্ণ ফুল ঝরে যাবে না।”

    “তাহলে তুমি মোহর ভরা কলস তুলে আমার সমস্যার সমাধান কর। আমার গাছে ফল হোক আর তুমি মোহর ভরা কলস নিয়ে যাও।”–গাছ বলল।

    “না বাপু, আমি ওসব পারব না। আমি অত খাটতে পারব না। প্রভু আমায় বড়লোক হবার পথ বাতলে দিয়েছেন, আমায় কুটোটি নাড়তে হবে না।” এই বলে সে বাড়ির পথে পা বাড়াল।

 

   রোগা লিকলিকে নেকড়ে তার আসার অপেক্ষায় ছিল। সিদ্উল্লা তাকে বলল ‘প্রভু তোমার ব্যথা উপশমের হদিস দিয়েছেন। বলেছেন তোমার সঙ্গে প্রথম যে নিষ্কর্মা বুদ্ধুর দেখা হবে, তাকে গিলে খেলেই তোমার আর কোনো যন্ত্রণা থাকবে না।” নেকড়ে তা শুনে বলল, “আর কি বলেছেন প্রভু, তুমি সবটা খুলে বল।”

    “কী আর বলব,” বলে, সিদ্উল্লা মাছ, আপেল গাছের কথা সব বলল। নেকড়ে একটু ভাবল, আরে, এমন গরিব মানুষ হাতে মণি, মোহর-ভরা কলস ছেড়ে আসে! একটু কষ্ট করে তুলতে পারে না–এমন নিষ্কর্মা আর বুদ্ধু মানুষ কোথায় পাব!–এই ভেবে এক চড়ে সিদ্উল্লাকে পেড়ে ফেলে তাকে উদরসাত করল সে।


পাঠকদের মন্তব্য

Tanuja Chakraborty লিখেছেন... ০৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪
পরিশ্রম আর বুদ্ধু মানুষের উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে। তবে একটা মিসটেক হয়েছে গল্পে। মণিটা একবার গলা আর একবার কানকোতে আটকানোর কথা বলা হয়েছে।

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up