ছোটোদের চাঁদের হাসি / দেশ-বিদেশের গপ্পো / এপ্রিল ২০২৫

হারিয়ে যাওয়া পদ্মরাগমণি

(উত্তর ভারতের লোককথা)

 

বহুকাল আগে এক দেশে এক রাজা রাজত্ব করতেন। তিনি আশপাশের অন্য রাজাদের থেকে মহান এবং ক্ষমতাশালী ছিলেন। একদিন রাজ দরবারে বিষন্ন মনে মন্ত্রী এবং সভাসদদের নিয়ে বসেছিলেন রাজা। তাঁর প্রধানমন্ত্রী বিশেষ বিচক্ষণ, সৎ এবং জ্ঞানী মানুষ। তিনি রাজাকে বিষণ্ন দেখে প্রশ্ন করলেন, হে বিশ্বের রক্ষাকর্তা, আপনার মন আজ এমন বিষন্ন কেন? মহারাজ, আপনি বিজ্ঞ মানুষ, দুঃখ আপনার মনকে এভাবে বিচলিত করছে, একে প্রশ্রয় দেবেন না।

     

     রাজা তাঁর  দুঃখের প্রকৃত কারণ তো মন্ত্রীকে বললেনই না, বরং তাঁর জন্য মন্ত্রীর এই উদ্বেগ প্রকাশের সৎ ভাবনাতেও কিছুটা বিরক্ত বোধ করলেন। তিনি জবাব দিলেন, আমার জন্য আপনার দুশ্চিন্তাকে আমি সাধুবাদ দেবো। কিন্তু আপনার সত্যি-সত্যিই কোনও কারণে দুঃখ যদি হয়, তাহলে এই যে আপনি দুঃখকে মনের উপর প্রভাব না বাড়াতে দেবার উপদেশ দিলেন, তা কাজে করে দেখান–এই বলে রাজা মনে মনে ঠিক করলেন প্রধানমন্ত্রীর পরীক্ষা নেবেন। তিনি মন্ত্রীকে বললেন রাজসভা শেষ হবার পর প্রাসাদে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য।

 

     প্রধানমন্ত্রী সেই মতো দরবারের পর প্রাসাদে দেখা করতে গেলেন। রাজা হাতির দাঁতের এক সুদৃশ্য বাক্স থেকে একটি খুব দামী পদ্মরাগমণি বের করে মন্ত্রীর হাতে দিয়ে, সেটি খুব যত্ন করে রেখে দিতে বললেন।

     মন্ত্রী বাড়ি এসে দেখলেন তাঁর স্ত্রী আরাম কেদারায় বসে সুগন্ধি পান খাচ্ছেন। মন্ত্রী পদ্মরাগমণিটি স্ত্রীকে দিলেন রেখে দেবার জন্য। স্ত্রী সেটি তাঁর ক্যাশবাক্সের একটি খোপে রেখে আলমারিতে তুলে রাখলেন।

 

    ছলনাকারী রাজা কিন্তু মন্ত্রী রাজপ্রাসাদ থেকে বেরোতেই দু’জন গুপ্তচর মহিলাকে মন্ত্রীর অলক্ষ্যে তাঁর পেছনে লাগালেন—মণিটি তিনি কোথায় রাখেন সেটি খোঁজ করার জন্য। গুপ্তচরের খবর পাবার পর কয়েকদিন বাদে রাজা মন্ত্রীর বাড়িতে এক ভৃত্যকে প্রচুর টাকার প্রলোভন দেখিয়ে সেটি  জন্য চুরি করে আনতে বললেন।

         তারপর রাজা একদিন নদীর ধারে প্রাসাদের বারান্দায় বসে বিশ্রাম করার সময়ে সেই বহুমূল্যবান মণি সকলের আগোচরে সামনের নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।

      পরের দিন সকালে দরবার শেষ হবার পর রাজা মন্ত্রীকে ডেকে বললেন, আপনাকে যে  পদ্মরাগমণিটি সেদিন রাখতে দিয়েছিলাম, সেটি  কোথায়?

     মন্ত্রী জানালেন,আজ্ঞে মহারাজ, সেটি আমার কাছেই সযত্নে রাখা রয়েছে।

       খুব ভালো কথা, রাজা বললেন, সেটি আমাকে এখনি এনে দিন, জরুরি প্রয়োজন আমার।

 

   হতভাগ্য মন্ত্রী বাড়ি এসে স্ত্রীকে মণিটি দিতে বলাতে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিন্তু কোথাও সে মণির হদিস পাওয়া গেল না। মন্ত্রী তড়িঘড়ি করে রাজাকে মণি খুঁজে না পাওয়ার কথা জানিয়ে বললেন, মহারাজ, আপনি যদি অনুগ্রহ করে আমাকে কয়েকদিন সময় দেন, তাহলে আশা করছি সেটি আপনাকে খুঁজে ফেরত দিতে পারব।

     ঠিক আছে,রাজা মনে মনে হেসে বললেন, আমি আপনাকে তিন দিন সময় দিলাম পদ্মরাগমণি খুঁজে বের করার জন্য। যদি তার মধ্যে মণি না ফেরত দিতে পারেন, তাহলে আপনার নিজের এবং আপনার প্রিয়পরিজন সকলের প্রাণদন্ড দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, আপনার বাড়ি ভেঙে ধূলিসাৎ করে সেখানে গাধা দিয়ে লাঙল টেনে চাষাবাদ করানো হবে।

 

      প্রধানমন্ত্রী গভীর দুশ্চিন্তা আর মর্মবেদনা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। মণি তো নদীর জলের তলায়, তাই মন্ত্রীর সেটা খুঁজে পাবার সম্ভাবনাই ছিল না। সুতরাং মন্ত্রীর সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো।

       মন্ত্রী মনে মনে ভাবলেন, আমার এমন কেউ নেই, যার কাছে আমি আমার টাকা পয়সা ধনসম্পদ রেখে যেতে পারি। প্রিয়জন বলতে একমাত্র আমার স্ত্রী রয়েছে–আর মনে হচ্ছে আমরা দু’জনেই একসঙ্গে মারা যাবো তিন দিন পরে। তাহলে এই তিনদিন আনন্দে কাটানো ছাড়া আর কী ভালো হতে পারে! দুশ্চিন্তা করলেও মৃত্যু হবে আর আনন্দ করলেও মৃত্যু। এই বাকি কটা দিন তাহলে মনের সব ইচ্ছে পূরণ করে ভালোভাবে থাকা যাক! এমনই এক মানসিক অবস্থায় মন্ত্রী বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে রাজার কথা সব জানালেন এবং বললেন, আমাদের তো খুব শিগগিরই মৃত্যু হবে। তাই এসো টাকাপয়সা যা আছে সবই মুক্ত হস্তে খুশিমতো খরচা করি এই তিনদিন।

     তাঁর স্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু বললেন, তোমার যা ভাল মনে হয় তাই হোক। ভাগ্য আমাদের এক চরম আঘাত হেনেছে। আমরা তাকে খুশি মনে মেনে নিয়ে, বাকি সময়টুকু আনন্দে কাটিয়ে দেবো।

 

      সেদিন থেকে দেখা গেল মন্ত্রীর বাড়িতে তুমূল উৎসব আর অনুষ্ঠানের আয়োজন লেগেছে। সব ধরনের সংগীত শিল্পীরা গান-বাজনার আসর বসিয়েছে। বাড়ির সব হলঘরে শ্রোতারা বসে সঙ্গীতের আনন্দ উপভোগ করছে। সকলেই ভাবছে মন্ত্রীর নিশ্চয় কোনও বড় সৌভাগ্যের উদয় হয়েছে। অতিথি সকলকেই নানা সুস্বাদু খাদ্য পরিবেশন করা হচ্ছে। সকাল থেকে সন্ধে মন্ত্রীর বাড়ি হাসি-আনন্দ আর সংগীতের ঝংকারে মুখর হয়ে উঠল…!

    এছাড়াও আশেপাশের গ্রামের সকল গরিব-দুঃখীদের ভোজের ব্যবস্থা করা হলো। কেউই মন্ত্রীর বাড়ি থেকে খালি হাতে ফিরে গেল না। বণিকরা প্রথামতো ফল-সবজি নিয়ে দেখা করতে এসে স্বর্ণমুদ্রা পেল উপহার হিসেবে। তারা মহানন্দে মন্ত্রীর গুণগান করতে করতে বাড়ি গেল।

       পাশেই এক গ্রামে এক গরিব ফুল বিক্রেতার বউ আর জেলেবউ থাকতো। দুজনেই প্রতিবেশী আর তাদের মধ্যে খুবই সম্ভাব ছিল। ফুলবিক্রেতার বউ বাজারে গিয়ে খবর পেল যে মন্ত্রীর বাড়িতে অনুষ্ঠান হচ্ছে, ভোজ চলছে,আর সকলের অবাধ প্রবেশ। সে তাড়াতাড়ি কিছু মালা নিয়ে মন্ত্রীর বাড়ি গিয়ে মন্ত্রীকে তা দিতেই একটা সোনার মোহর পেল।  সে বন্ধু জেলেবউকে গিয়ে জানালো যে কোনো একটা মাছ নিয়ে যেন এখনই মন্ত্রীর বাড়িতে যায়। তাহলে সেও একটা মোহর পাবে।

 

     কিন্তু জেলেরা খুবই গরীব মানুষ। জেলেবউয়ের স্বামী রোজই মাছ ধরতে যায়। কিন্তু কখনো সখনো বড়ো কোনও মাছ জালে ওঠে। যেসব ছোট চারা-পোনা সচরাচর পায়, তা বাজারে বিক্রি করে সামান্য দু’চার পয়সা হয়। তাই জেলেবউ নিজের মনে বলে, আমার স্বামী যে চুনোপুঁটি মাছ নিয়ে আসে, তা মন্ত্রীকে দিতে গেলে তাঁকে অপমান করা হবে। তাই সে আর তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা ছেড়েই দিল। মনে মনে ভাবল তার কপালে উপহার লেখা নেই।

     কিন্তু পরের দিন সকালে, কপালের জোরে, তার স্বামী খুব ভালো জাতের বড়ো একটা রুই মাছ ধরে বাড়িতে এলো। জেলেবউ পরমানন্দে সেই মাছ ঝুড়িতে রেখে একটা পরিস্কার কাপড় চাপা দিয়ে মন্ত্রীর বাড়িতে উপস্থিত হল। মন্ত্রী এমন চমৎকার বড়ো রুই মাছ দেখে খুব খুশি হয়ে জেলেবউকে একটা মোহরের বদলে দুটো মোহর উপহার দিলেন। জেলেবউয়ের তো আনন্দ আর ধরে না। সে তো উপহার নিয়ে বাড়ির পথে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরে এলো। কারণ দুটো মোহরে তাদের অত্যন্ত সুখে বেশ কিছুদিন কেটে যাবে।

 

       এই ঘটনাটা মন্ত্রীর জীবনের শেষ তিনদিনের অন্তিম দিনে ঘটল। পরের দিন সকালে মন্ত্রী আর তাঁর স্ত্রীকে কোতল করা হবে। রুই মাছের কালিয়া মন্ত্রীর খুব পছন্দের খাবার। তিনি মাছ নিয়ে এসে স্ত্রীকে বললেন, খুব ভালো একটা টাটকা রুই মাছ পাওয়া গেছে। আজ দুপুরে এটা দিয়ে তোমার প্রিয় পদ কালিয়া রান্না করো। এমন মাছ আর খাওয়া হবে না এরপর। এটা তুমি নিজে পরিষ্কার করে কাটার ব্যবস্থা করো ।

        মন্ত্রীমশাই আর তাঁর স্ত্রী মাছ কাটা তদারক করতে বসলেন। রাঁধুনি বটি নিয়ে মাছ কাটতে বসলো। মাছটাকে দু’টুকরো করতেই মাছের পেট থেকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলা পদ্মরাগমণি বেরিয়ে এলো।  অবাক কান্ড আর কাকে বলে!

        মন্ত্রী আর তাঁর স্ত্রী তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। দুর্মূল্য মণিটাকে ভালো করে গোলাপ জল দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা হলো। মন্ত্রী তখনই মণি নিয়ে রাজাকে দিতে ছুটলেন।

 

     রাজা মণিটি দেখে খুবই বিস্মিত হলেন। তিনি নিজে মণিটিকে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। তিনি মন্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন কীভাবে মণিটি খুঁজে পাওয়া গেল। আর এত দিনই বা পাওয়া যায়নি কেন? মন্ত্রী তখন রাজাকে জানালেন, কীভাবে তিনি তাঁর সমস্ত ধনসম্পদ খরচ করার কথা ভেবেছিলেন এবং কীভাবে আজ উপহার হিসেবে একটা রুইমাছ পেয়ে তার পেট থেকে এই মণি পাওয়া গেল।

       রাজা তখন পদ্মরাগমণি হারানোর ব্যাপারে তাঁর ভূমিকার কথা সব স্বীকার করলেন এবং বললেন, কিন্তু আপনি আমাকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন দুঃখকে প্রসন্নমনে গ্রহণ করা উচিত, তা নিজেও পালন করেছেন নিজের জীবনে। এই বলে রাজা প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করলেন এবং সভাঘরের অন্য সকল মন্ত্রীকে তাঁর এই পরীক্ষার কথা জানালেন প্রসন্ন মনে।

      এভাবেই মন্ত্রীর গ্রহের ফের তাঁর জীবনে সৌভাগ্যের কারণ হয়ে ফিরে এল।

    আর একেই হয়তো বলে, যে রাখে হরি তো মারে কে? অথবা ভাগ্যবিধাতা সৎ ও গুণী মানুষের রক্ষা করে থাকেন সর্বদাই !


পাঠকদের মন্তব্য

হিমাদ্রিশেখর রায় লিখেছেন... ১৮ই এপ্রিল, ২০২৫
গল্পটি কিশোর থেকে প্রবীণ সকলকে মুগ্ধ করবে বলে মনে করি!

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up