আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস
মৃণালিনী ঠাকুর
আগামী ২৯ শে জুলাই হলো আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্রদিবস। প্রতিবছর অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দিনটিকে পালন করে সারা বিশ্ব। ব্যাঘ্র সংরক্ষণ অর্থাৎ বাঘদের বাঁচিয়ে রাখার বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই এই বিশেষ দিনটিকে পালন করা শুরু। ২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ শীর্ষক এক আলোচনাচক্রের আয়োজন করা হয়, যেখানে যোগ দেয় ব্যাঘ্র প্রজাতির বসবাস, এমন ১৩টি দেশ। এখানেই শপথ নেওয়া হয়, যেভাবেই হোক নানা কারণে ক্রমশ কমে যাওয়া বাঘের সংখ্যাকে বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করা হবে। তাদের সংরক্ষণে যথাযথ গুরুত্ব দেবে এই দেশগুলি–যার মধ্যে ছিল রাশিয়া, ভারত, চিন, বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস ও কম্বোডিয়া। এখানে উল্লেখ্য অরণ্যের এই অতি সুন্দর প্রাণীটিকে কিন্তু বিশ্বের সব দেশে পাওয়া যায় না।
কিন্তু কেন সংরক্ষণের প্রয়োজন হলো, সেই বিষয়ে আগে আলোচনা করা প্রয়োজন। তোমরা অনেকেই চিড়িয়াখানায় গিয়ে বাঘ দেখেছ। সংরক্ষিত অরণ্যেও (যাকে অভয়ারণ্যও বলা হয়) কেউ কেউ দেখেছ বাঘের চলাফেরা। এই দুই ক্ষেত্রেই কদাচিৎ বাঘের হুঙ্কারও শুনেছ। অরণ্যের প্রসঙ্গে আমার মতো তোমাদেরও নিশ্চয়ই মনে পড়ছে আমাদের রাজ্যের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত বিখ্যাত সুন্দরবনের কথা। বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বসবাস এখানেই। বাঘকে হিংস্র প্রাণী বলেই জানি আমরা। তাই দূর থেকেই দেখি তাদের। তবে, তারই পাশাপাশি এটাও তোমাদের জেনে রাখা জরুরি প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অন্যান্য বন্যপ্রাণীর মতোই বাঘও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য মানবসমাজের অস্তিত্ব রক্ষার অন্যতম প্রধান অঙ্গ। অর্থাৎ আমাদের ভালো থাকার প্রয়োজনেই জঙ্গলে বাঘের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা জরুরি।
মুশকিল হলো, একটা সময় বন্যপ্রাণী শিকারের ক্ষেত্রে কোনও বিধিনিষেধ না থাকায় প্রতি জঙ্গলেই যথেচ্ছ পরিমাণে বাঘ শিকার করা হয়। এর ফলে বাঘের সংখ্যা কমতে কমতে বিপদসীমায় পৌঁছে যায়। শুধু বাঘ নয়, জঙ্গলের অন্যান্য প্রাণীরাও নির্বিচারে শিকারিদের হাতে মারা যেত তখন। এরপর আইন করে বন্যপ্রাণী শিকার বন্ধ করা হলো। এতেও নিস্তার নেই, চলল চোরা শিকারিদের উপদ্রপ। বাঘের ওপরেই তাদের লোভ বেশি। যাই হোক, আইনের শাসন আরও কঠিন ও শক্ত করা হলো। কিন্তু ততদিনে বিশ্বে বাঘের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে হাতে গোনা। প্রবল চিন্তায় পড়ে গেলেন বিশ্বের তাবড় প্রাণীবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞগণ। তাঁরা অনুভব করলেন যেভাবেই হোক, বাঘদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এই উপলব্ধি থেকেই সেন্ট পিটার্সবার্গে ওই ব্যাঘ্র সংরক্ষণ শীর্ষক আলোচনাচক্রের আয়োজন ও প্রতি বছর ২৯ শে জুলাই আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্রদিবস পালনের উদ্যোগ।
বলা বাহুল্য, এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো বাঘের আবাসস্থল রক্ষা করা, অবৈধ শিকার এবং তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্যবসা প্রতিরোধের প্রচেষ্টা সমর্থন করা। এরই পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে এই বিপন্ন প্রজাতির সংরক্ষণের গুরুত্বও তুলে ধরা ছিল সমগ্র কর্মকান্ডের অংশ। এই দিনটিকে অর্থবহ করে তুলতে ও যথাযথ গুরুত্ব দিতে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ইভেন্ট, শিক্ষা প্রোগ্রাম এবং তহবিল সংগ্রহ করা হয় এবং মানুষকে বাঘ সংরক্ষণ উদ্যোগ সমর্থন করতে উৎসাহিত করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য অচিরেই এর সুফল ফলতে দেখা যায়। ২০১৭ সালে সপ্তম আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস বিশ্বজুড়ে উদযাপনে বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত ইত্যাদি ব্যাঘ্র প্রজাতির বসবাস যুক্ত দেশগুলির পাশাপাশি ইংল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাঘহীন দেশগুলিও উল্লেখযোগ্যভাবে অংশগ্রহণ করে। ইতিবাচক এই পদক্ষেপ পরবর্তী বছরগুলিতেও নজরে আসে।
সবশেষে যেটা জানলে তোমরা খুশি হবে, সেটা হলো, বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঘের আবাসস্থল হলো আমাদের দেশ। সংরক্ষণের ফলে ভারতে বাঘের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৬ সালে বাঘের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল ১৪১১-য়। গত বছর পর্যন্ত পরিসংখ্যান–সেটা বেড়ে ৩৬৮২ হয়েছে। তোমরা অনেকেই নিশ্চয়ই জিম করবেটের নাম শুনেছ। ভারতের প্রথম জাতীয় উদ্যান, জিম করবেট টাইগার রিজার্ভ তাঁরই নামে তৈরি। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রকল্প বাঘ সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে–যা একাধারে পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে সহায়তা করছে।
ছবি ঋণ ইন্টারনেট
পাঠকদের মন্তব্য
250