আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
মৃণালিনী ঠাকুর
যে ভাষায় প্রথম মাকে ডাকি আমরা, সেটাই তো মাতৃভাষা। যে ভাষায় মায়ের স্নেহ-মমতা বর্ষিত হয়, তাই হলো মাতৃভাষা। তোমরা সকলেই নিশ্চয়ই জানো, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিনটি বাঙালির কাছে ভাষা আন্দোলনের মর্মস্পর্শী ও স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস রূপে স্মরণীয় হয়ে আছে। প্রতি বছরের মতো এবারও পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করবে ২১শে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ার আগে দিনটি ছিল ভাষা শহীদ দিবস। কী তার ইতিহাস, এই অবকাশে জানাই তোমাদের।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। আজকের বাংলাদেশ সেদিন ছিল পূর্ব-পাকিস্তান, যার অধিকাংশ মানুষই ছিলেন বাঙালি অর্থাৎ বাংলা-ভাষী। পাকিস্তান সরকার তাদের ওপর জোর করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র বঙ্গসমাজ। আন্দোলনে নামে ছাত্রসমাজ। পাক সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সেই ১৪৪ ধারা অমান্য করে দলে দলে পথে বেরিয়ে পড়ে। পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। সেই গুলিতে শহীদ হন বহু ছাত্র, যাঁদের শীর্ষে ছিলেন রফিক, জব্বার, শফিউর, সালাম, বরকত প্রমুখ।
এরপর বিক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হয়ে ছাত্রদের পাশাপাশি প্রতিবাদে সোচ্চার হন। ২২শে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনকারী ছাত্র ও জনতা নেমে আসে রাজপথে। মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত জানাজায় (শবযাত্রা) অংশগ্রহণ করে সমস্ত মানুষ। এরপর ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে গড়ে তোলা হয় একটি স্মৃতিস্তম্ভ।
২৬শে ফেব্রুয়ারি পাক সরকার সেই স্মৃতিস্তম্ভ গুঁড়িয়ে দেয়। এই ঘটনায় একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন আরও তীব্র হয়। অবশেষে ১৯৫৪ সালের ৭ই মে বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি। ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ১৯৯৯-এর ১৭ই নভেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে, তাতে ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানায় ও প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।
এরপর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে এই দিনটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে উদযাপিত হয়ে আসছে। ভাষা শহীদ দিবসের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া একদিকে যেমন আমাদের গর্বিত করে, তেমনই শেখায় আরও বেশি করে মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে। গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি সেই শহীদদের প্রতি, যাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে মাতৃভাষাকে মর্যাদা ও সম্মান করতে শিখিয়ে গেছেন।
পাঠকদের মন্তব্য
250