স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম
সুবীর ঘোষ
প্রায় দুশো বছর ব্রিটিশদের শাসনে পরাধীন ছিল ভারতবর্ষ, আমাদের দেশ। বহুদিন ধরে স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী লড়াই-এর শেষে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট দেশ স্বাধীন হয়। দেশ বলতে আমরা কি বুঝি? দেশ হল চারপাশের অন্য দেশ দিয়ে ঘেরা এলাকার মধ্যে যে ভূখণ্ড সেটিই একেকটি দেশ। সেই নির্দিষ্ট দেশে যারা স্থানীয়ভাবে বসবাস করে সেই দেশ তাদের I
প্রতিটি দেশেরই স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সীমানা থাকে। বিনা অনুমতিতে সেই সীমানা লঙ্ঘন করা যায় না। এক একটি দেশের ভিতর যে সব প্রাকৃতিক সম্পদ থাকে যেমন নদী, সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত, গ্রাম-শহর, অরণ্য–সবেরই মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সেই দেশের হাতেই থাকে। এছাড়া ভূগর্ভস্থ জল, খনিজ পদার্থ যেমন, লৌহ আকরিক, তামা, সোনা, কয়লা, চুনাপাথর ইত্যাদিও দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। শুধু মানুষ কেন, কোনো দেশের ভিতর থাকা সমস্ত পশুপাখি সরীসৃপ–যেমন, বাঘ, সিংহ, গন্ডার, হরিণ, ময়ূর, সাপ, কুমির প্রভৃতিকেও প্রাণিসম্পদ হিসেবে গণ্য করা হয়। এককথায় সবকিছু নিয়ে যে দেশ, তাকে ভালোবাসা ও রক্ষা করার দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিকের I
একটি স্বাধীন দেশের প্রশাসন যেমন প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে, তেমনি প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য হল তার দেশকে ভালোবাসা এবং এমন কিছু না করা যাতে দেশের ক্ষতি হতে পারে। যখন ভারত ব্রিটিশ সরকারের অধীন ছিল, তখন দেশকে স্বাধীন করার বাসনা-সংগ্রাম করার প্রেরণার উৎস ছিল দেশপ্রেম I তবে, এখন ভারত স্বাধীন হয়ে গেছে, তাই, আমাদের দেশকে ভালোবাসার আর কোন প্রয়োজন নেই এমন হতে পারে না। বরং এখন দেশকে ভালবাসার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। দেশের সমস্ত সম্পদকে রক্ষা করা এবং বৃদ্ধি ঘটানোর দায়িত্ব দেশের প্রতিটি মানুষের I কিছু কিছু উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টাকে স্পষ্ট করা যেতে পারে।
ধরা যাক অরণ্যসম্পদ। কোনো মানুষেরই অকারণে গাছকাটা উচিত নয়। তাছাড়া এটি দণ্ডনীয় অপরাধও বটে। কিছু বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া যেমন রাস্তা সম্প্রসারণ বা ঝড়ে ভেঙে যাওয়া গাছ কেটে সরানো ইত্যাদি ছাড়া যখন-তখন গাছ কাটা যায় না। এর কারণ কী? বৃক্ষ মরুবিজয় করে। পথের পথিককে ছায়া দেয়। পরিবেশ শীতল রাখে। বৃষ্টিপাতে সহায়তা করে। বৃক্ষ নিধনের ফলে আমাদের দেশে যে উষ্ণতা বেড়ে যাবে, সে কথা একজন ঋষিতুল্য মানুষ প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন এবং তা বহু বছর আগে ১৯২৮ সালে অর্থাৎ আজ থেকে ৯৪ বছর আগে।
সেই উপলব্ধি থেকেই সেই মানুষটি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে প্রথম বৃক্ষরোপণ উৎসবের সূচনা করেছিলেন। গাছ লাগানোকে একটি আনন্দ-সমারোহের রূপ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরে যখন ভারত স্বাধীন হল,তারপর ১৯৫০ সালে ভারত সরকার এই বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে চালু করলেন বন মহোৎসব। রবীন্দ্রনাথের বৃক্ষরোপণ এবং ভারত সরকারের বন মহোৎসব দুই-ই পালিত হয় প্রতি বছর জুলাই মাসে। বৃক্ষরোপণের এই উৎসব দেশপ্রেমের একটি মহৎ দৃষ্টান্ত।
তারপর ধরা যাক পশুপ্রেম। একটা সময় ছিল যখন আমাদের দেশে প্রচুর অরণ্য ছিল এবং সেই অরণ্যে অসংখ্য জীবজন্তুর বাস ছিল। কিন্তু সে সময়কার রাজা-মহারাজা বা ধনী সম্প্রদায়ের মানুষজন মৃগয়ার আনন্দ উপভোগ করতে গিয়ে নির্বিচারে পশুশিকার করতেন। ধীরে ধীরে আমাদের দেশে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমতে থাকে। পরে আইন করে বন্য পশুহত্যাকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। যে যার সাধ্যমতো যদি পশুপক্ষীদের স্বচ্ছন্দভাবে বেঁচে থাকার পথে বাধা সৃষ্টি না করে, সেটাও কিন্তু এক অর্থে দেশপ্রেম হিসেবেই ধরা যেতে পারে।
আমাদের যেমন দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বা দেশের ক্ষতি করার কোনো অধিকার নেই, সেরকম আমরা দেশের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজ করতে পারি না। এসব যারা করে তারা দেশকে ভালোবাসে না। এসব আমরা অহরহ চোখের সামনে দেখি যেমন, পুকুর বা জলাভূমি ভরাট করা, স্কুল, অফিস বা হাসপাতাল ভাঙচুর করা, নদী থেকে বেআইনিভাবে বালি তুলে নদীপ্রবাহের ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত করা, প্রাণিসম্পদ যেমন গোরু, উট, কচ্ছপ বা পাখি বেআইনিভাবে অন্য দেশে পাচার করা–এ ধরনের কাজ কিন্তু দেশদ্রোহিতারই সামিল। আমরা যদি নিজেদের দেশপ্রেমে গর্ববোধ করি, তাহলে আমাদের এসব কাজ থেকেও বিরত থাকতে হবে।
কবি অতুলপ্রসাদ সেন আমাদের দেশের আসল স্বরূপটি প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছিলেন–
নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান
বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান…!
আমরা গর্ববোধ করতে পারি যে আমরা ভারতবর্ষ নামক একটি সুপ্রাচীন দেশের নাগরিক। আমাদের দেশের ইতিহাস গাঁথা আছে এক মহান ঐতিহ্যের সঙ্গে I এখানে নানা ভাষা, নানা ধর্মের মানুষ চিরদিন শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে এসেছে I সকলে মিলে একত্রিত হয়ে শান্তিতে বসবাস করাই দেশপ্রেমের মূলকথা।
পাঠকদের মন্তব্য
250