বেনারসী ঝরনার খোঁজে
লিপি চক্রবর্তী
তোমরা নিশ্চয়ই জানো বেনারস মানেই বাবা বিশ্বনাথের মন্দির, দশাশ্বমেধ ঘাটে সন্ধ্যারতি, নৌকায় চড়ে গঙ্গায় বেড়ানো, বেনারসী শাড়ি আর অতি সুস্বাদু প্যারা ও লস্যি। আজ তোমাদের আমি এক অন্য বেনারসের গল্প বলব! বলব বেনারসী ঝরনার কথা। আমরা সরাসরি বেনারসের জন্য ট্রেনের টিকিট পাইনি। তাই ভোরবেলা মোগলসরাই স্টেশনে নেমে অটো করে রওনা দিই বেনারসের উদ্দেশ্যে। আর পৌঁছেও যাই সকাল দশটার মধ্যে। ঝরনা দেখার গল্প পরে। আগে চেনা বেনারসের কথা। দিনের বেলাটা হোটেলে স্থিতু হয়ে খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম ইত্যাদির পর বিকেলবেলা দলবেঁধে বের হলাম। প্রথমে কেদার ঘাট থেকে নৌকোয় উঠলাম গঙ্গার বুকে ভেসে সন্ধ্যারতি আর বিভিন্ন ঘাটও ঘুরেও দেখব বলে।
বেনারসে রয়েছে চৌত্রিশটা ঘাট। এখানে গঙ্গা কিন্তু উল্টোদিকে বইছে, উত্তর থেকে দক্ষিণে নয়। আর বারাণসী (বেনারস) নামকরণ হয়েছে বরুণা আর অসি নদী থেকে। এই দুই নদীর মাঝখানের ভূখণ্ড হল বেনারস। বরুণা নদী এখনও আছে। কিন্তু, অসিকে এখন আর পাওয়া যায় না। যদিও, অসি ঘাট এখনও আছে, যেখানে বসে তুলসীদাস রামায়ণ লিখেছিলেন। ইতিহাসের পাশাপাশি এই শহরের অস্তিত্বের কথা পুরাণেও পাওয়া যায়। ঘাটগুলি দেখতে দেখতে সন্ধের মুখে এসে আমাদের নৌকা দাঁড়িয়ে পড়ল দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে। অনেক নৌকা সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে–যাত্রীরা সবাই মা গঙ্গার আরতি দেখবে। সে যে কী অপূর্ব দৃশ্য–ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
এরপর বাবা বিশ্বনাথ মন্দিরের ঘাটে নেমে সোজা চলে গেলাম দেব দর্শনে। ঘাটটি খুব সুন্দরভাবে আলো দিয়ে সাজানো। মন্দিরের ভিতরে ঢুকতে হলে ব্যাগ, মোবাইল, জুতো রেখে পুজোর ডালি নিয়ে মন্দিরে ঢুকতে হয়। দুবার সিকিউরিটি চেকিং হয়েছে। লম্বা লাইন। বেশ অনেকটা সময় লাগে। পরিচ্ছন্ন মন্দির চত্বর। সবকিছু সেরে হোটেলে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল আমাদের। ক্লান্তিও ছিল। তবে, মন ভরে উঠেছিল তৃপ্তির সুধারসে। সেই রেশ নিয়েই খেয়েদেয়ে চললাম ঘুমের দেশে।
বেনারস বেশ কয়েকবারই গিয়েছি। কিন্তু ঝরনার কথা কখনও শুনিনি। সম্প্রতি এক বন্ধুর কাছে হঠাৎ শুনে উৎসাহের শেষ নেই আমাদের। পরদিন ভোরবেলা বেরিয়ে পড়লাম ঝরনা দেখতে। সেই ঝরনা কোথায় আছে জানো? চন্দ্রপ্রভা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির ভিতরে। এই চন্দ্রপ্রভার কথা একটু বলি। বেনারস শহর থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৬৫ কিলোমিটার। কাশীর রাজা আজও বাস করেন রামনগর ফোর্ট-এ। এই রামনগর ফোর্ট ডান হাতে রেখে বাম দিকে ঘুরে এগিয়ে চলেছিলাম আমরা। উত্তর প্রদেশের চন্দৌলি জেলায় এই চন্দ্রপ্রভা অবস্থিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ পর্যন্ত কাশীর রাজাদের অধীনে ছিল এই ঘন জঙ্গল। তাঁরা শিকার করতে আসতেন এখানে।
সময় পাল্টালো। ১৯৫৭ সালে এই জঙ্গল চন্দ্রপ্রভা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি বলে ঘোষিত হলো। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে তিনটি সিংহ ছানা এনে ছাড়া হয়েছিল এখানে। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তারা সংখ্যায় বেড়ে হয়েছিল এগারোটি। তারপর কীভাবে যেন সিংহগুলো উধাও হয়ে গেল। আর তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এখনও এখানে বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, ভালুক, নীলগাই, বন্য বরাহ, বানরের দল সহ আরো বেশকিছু বন্যপ্রাণ রয়েছে। চন্দ্রপ্রভা হলো পাখিদের স্বর্গরাজ্য। প্রায় দেড়শো প্রজাতির পাখি দেখা যায় এখানে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে চন্দ্রপ্রভা নদী।
এই স্যাংচুয়ারিতে প্রবেশের মূল গেট হল চন্দ্রপ্রভা জলাধারের পাশ দিয়ে। কাশী ওয়াইল্ড লাইফ ডিভিশনের অন্তর্গত এই জঙ্গল। এখানে প্রবেশ করতে ভারতীয়দের জন্য টিকিটের দাম ৩০ টাকা, বিদেশিদের জন্য ৩৫০ টাকা। গাড়ি পার্কিং ৫০ টাকা। ক্যামেরা থাকলে তারও আলাদা মূল্য দিতে হয়। আমাদের সঙ্গে শুধু মোবাইল, তাই এই মূল্য লাগেনি। প্রবেশদ্বারের মুখেই অজস্র বাঁদর লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে অভ্যর্থনা করল আমাদের। তার পরের পথটুকু শব্দহীন নির্জন জঙ্গল। বেশ একটু গা ছমছম করা পরিবেশ। কিন্তু ঝরনারা কোথায়। তারা কোন গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে আছে, কে জানে! রাস্তা ধীরে ধীরে পাহাড়ে উঠছে, আমরাও উঠছি গাড়িতে। শেষে একটা বেশ উঁচু-নিচু পাহাড়ের ঢালে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। তখনও জানি না, কোন অনির্বচনীয় দৃশ্য অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
সামনেই একটা ওয়াচ টাওয়ার। একটু ঘুরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে গেলাম একটা বড় রুদ্রাক্ষ গাছের গোড়ায়। সেখানে খাদের দিকে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন একজন সন্ন্যাসী। আমরা কয়েকজন ছাড়া আর কোনো জনপ্রাণীর অস্তিত্ব নেই। খাদের ধারে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম প্রায় সাতশো কিংবা হাজার ফুট, কত হবে ঈশ্বর জানেন, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে অনেক অনেক নিচে এক সুন্দরী ঝরনা পাহাড়ের খাঁজ থেকে ঝাঁপিয়ে নামছে। দুপুরের প্রখর রোদে পাথরে ধাক্কা খেয়ে জলের কণা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। জল আর আলোয় মিলে তৈরি হয়েছে সাতরঙা রামধনু, ঠিক যেন বেনারসী শাড়ির পাড়। অত উপর থেকেও তার গর্জন শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। সে একটা ছোট হ্রদ সৃষ্টি করে বয়ে গিয়েছে অন্য পাহাড়ের খাঁজে। উল্টোদিকের পাহাড়ের গায়ে জলের গড়িয়ে নামার পথ বেয়ে তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক গুহাচিত্র। এই সুন্দরী ঝরনার নাম দেবদারী।
দেখে দেখে আশ মেটে না। বেশ কিছু সময় আনমনে কেটে গেল। তারপর ফেরার পালা। তবে তার আগে আর এক সুন্দরী অপেক্ষা করছে তার জংলি সৌন্দর্য নিয়ে। নাম তার রাজদারী। মাঝখানে পিকনিক স্পট আছে নির্দিষ্ট করা। একটা ছোট্ট দোকান, খাওয়ার জলের। দুটো একলা বেঞ্চ পথিকের জন্য বসে আছে। পাহাড়ি পথে ওঠানামা। তাই একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার চলা। এবার খানিকটা ঢাল আর অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম এক বিশাল ঝরনার কাছে। সে তো পাহাড়ের ধাপ বেয়ে বেয়ে নেমে এসে অনেক নিচে ঝাঁপ দিয়েছে জঙ্গলের ঘেরাটোপে। কী তার দুরন্ত গতি! ভয় যেমন লাগে, তেমনই ঘোর লেগে যায়। নিরাপত্তার জন্য লোহার রেলিং দিয়ে জায়গাটা ঘেরা। প্রকৃতির টানে দেশের নানা প্রান্তে গিয়ে কত অপরূপ ছবিই না দেখেছি। কিছু তার আজও রয়ে গেছে স্মৃতিপটে। দেবদারী আর রাজদারী তেমনই বেনারসের এই দুই ঝরনাকে কোনোদিন ভুলব না। তোমরাও একবার বেনারস গেলে দেখে নিও ওদের। প্রসঙ্গত জানাই, চন্দ্রপ্রভা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির গেট পর্যটকের জন্য খোলা থাকে সকাল ন'টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।
পাঠকদের মন্তব্য
250