ছোটোদের চাঁদের হাসি / হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা / নভেম্বর ২০২৩

বর্ষামুখর দিনে মংপুর টেগোর মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে

সে এক অঝোর বৃষ্টিঝরা সকাল। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমেছি। গন্তব্য উত্তরবঙ্গের দাওয়াই পানি বলে এক ছোট্ট গ্রাম। গাড়ি রিজার্ভ করা ছিল। বৃষ্টির কারণে রাস্তার বাধাবিপত্তি পেরিয়ে গাড়ি নিয়ে স্টেশনে যখন পৌঁছল নেপালি তরুণ ড্রাইভার, তখন বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেছে। গাড়ি স্টার্ট দিয়েই ড্রাইভার ভাই জানাল, আমরা এখন যেদিক দিয়ে যাব, সেই পথে মংপু পড়বে, ওই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ! আপনাকে দেখিয়ে দেব। আমি বেশ বিস্মিত হয়েই তাকে জিজ্ঞেস করি, তুমি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জানো ? জানি তো ! কলকাতা থেকে অনেক ট্যুরিস্ট আসেন, আমি নিয়ে যাই তাঁদের, তাঁদের কাছেই শুনেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির কথা।

তোমরা নিশ্চয়ই নোবেলজয়ী, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম জানো। বুঝতেই পারছ, ড্রাইভারের কথা শোনা মাত্রই আমার মন কতটা আনন্দে ভরে উঠল ! কিছুদূর যাওয়ার পর, তখন বৃষ্টি একটু কমেছে, ড্রাইভার ছেলেটি পথের ধারের একটি ছোট্ট খাবারের দোকানের পাশে গাড়ি দাঁড় করায়। বেশ পরিচ্ছন্ন। দেখে শুনে জানালার পাশের একটি চেয়ার টেবিল বেছে নিয়ে বসে পড়লাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি অনেকটা নিচে বয়ে যাচ্ছে এক নাম না জানা নদী। আশপাশের ছোট ছোট জলধারাগুলি মিশে যাচ্ছে সেই নদীর বুকে। কী অপরূপ সেই দৃশ্য !

আধঘন্টা বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু। এবার তোমাদের কাছে সেই পথের রূপ বর্ণনা করব। পাহাড়ী বর্ষার অনির্বচনীয় রূপ দেখতে দেখতে, চড়াই-উৎরাই পথ ও বেশ কিছু হেয়ারপিন বেন্ড পার হয়ে একটা সময় আমরা মংপু পৌঁছলাম। বৃষ্টির বেগ ততক্ষণে তীব্র আকার ধারণ করেছে। দিনটা ১৫ আগস্ট, জাতীয় ছুটির দিন। অতএব, মংপু রবীন্দ্রভবন, যা এখন টেগোর মেমোরিয়াল মিউজিয়াম বলে খ্যাত, তার গেট বন্ধ। আমি আর ড্রাইভার ভাই ওই অঝোর বৃষ্টির মাঝেই গেটের সামনে অসহায় দাঁড়িয়ে। ড্রাইভারের ডাক শুনে দারোয়ান এসে সম্ভবত আমাদের অবস্থা দেখে দয়া পরবশ হয়ে গেট খুলে দেয়।

তার কথার মাঝেই অভূতপূর্ব একটি ঘটনা ঘটে। আমরা শুনি উদাত্ত কণ্ঠে কেউ গাইছেন, আকাশভরা সূর্য তারা…! সেই সুর মুহূর্তের মধ্যে চারপাশের পরমা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম করে দেয় আমাদের। গান গাইছিলেন কেয়ারটেকার মহাশয়। আমাদের গলা শুনে গান থামিয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালেন তিনি। প্রথমে বন্ধ থাকার কথা বললেও, পরে কলকাতা থেকে আসছি শুনে আমার অনুরোধ রাখলেন। আমাদের সামনে খুলে গেল মংপুর রবীন্দ্র স্মৃতি-বিজড়িত সেই ভবনের দরজা। বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। ভিতরে ঢুকতেই স্থানুবৎ হয়ে গেলাম দুটি গভীর ও মায়াময় চোখের দিকে তাকিয়ে। সামনে দেয়াল জোড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঁধানো এক ছবি। ছবিটা এমন ভাবে রাখা–প্রবেশপথে যিনিই ঢুকবেন, তাঁর মনে হবে, ছবির মানুষটি তাঁকেই দেখছেন। এরপর ঘুরে ঘুরে ছোট, মনোরম,পরিচ্ছন্ন বাড়িটি দেখলাম। এই ভবনে স্থিত খাট, টেবিল-চেয়ার, কলমদানি ইত্যাদি থেকে বাইরের উপাসনাগৃহ–সবই রবীন্দ্রনাথ নিজে ডিজাইন করে গিয়েছেন। মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা শিহরণ অনুভব করছিলাম। প্রণতও হলাম।

প্রসঙ্গত জানাই, ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ এই সময়টায় রবীন্দ্রনাথ মংপুতে প্রায়ই আসতেন ও এই বাংলোতেই থাকতেন, যা একটি ছোট আকারের মালভূমির মতো জমিতে অবস্থিত। বোঝাই যায়, চারপাশের অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতি তাঁকে বিপুলভাবে আকর্ষণ করেছিল। এই বাংলো ছিল রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য মৈত্রেয়ী দেবীর। তাঁর স্বামী মনমোহন সেন ছিলেন মংপু সিংকোনা ফ্যাক্টরির ডিরেক্টর। সেই বাংলোই আজকের টেগোর মেমোরিয়াল মিউজিয়াম। মিউজিয়াম দর্শনের অনন্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে যখন বের হলাম, তখনও অবিরাম ধারাপাত চলছে। শেষ করার আগে মংপু নিয়ে কিছু তথ্য জানিয়ে দিই তোমাদের।

উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং জেলার কার্শিয়ং সাব ডিভিশনের অন্তর্গত মংপুর খ্যাতি ছিল মূলত সিংকোনা চাষের জন্য। সিংকোনা থেকে ম্যালেরিয়ার ওষুধ কুইনাইন প্রস্তুত করা হয়। কালিম্পং থেকেও কাছেই পড়ে এই ছোট্ট গ্রাম। ১৮৬২ সালে মংপুর পার্বত্য অঞ্চলে প্রথম সিংকোনা চাষ শুরু হয়। দার্জিলিং থেকে ৩২ কিমি পূর্বে অবস্থিত মংপুর উচ্চতা ১০০০ থেকে ৬১৭০ ফুট। মিউজিয়ামের পাশেই রয়েছে ফ্যাক্টরি। এছাড়াও এখানে আছে একটি গুম্ফা। যাওয়ার পথেই পড়বে কালিঝোরা, ৫৫০ ফুট ওপর থেকে তিস্তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া দুরন্ত এক ঝর্না। এখানকার ফুল ও অর্কিডের বাহার মুগ্ধ করে দেওয়ার মতো। ৭ কিমি দূরত্বে একটি অর্কিড সেন্টারও আছে।

সবার ওপরে রয়েছে মংপু ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শনের দুর্লভ অভিজ্ঞতা লাভ। মোটামুটি অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি–আকাশ পরিষ্কার থাকলেই বিস্তৃত ক্যানভাসে দৃশ্যমান তিনি। থাকার জন্য রয়েছে বেশ কিছু হোমস্টে ও ফার্মস্টে। ইন্টারনেট সার্চ করলেই পেয়ে যাবে যোগাযোগ। হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনগামী যে কোনও ট্রেনে এসে, এখান থেকে গাড়িতে মংপু যাওয়া যায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আছেই। এছাড়াও টেগোর মেমোরিয়াল মিউজিয়াম দেখার জন্যও একবার অন্তত মংপু ঘুরে যেও অবশ্যই।

                                 ছবি : লেখক


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up