ঘরের কাছেই সুন্দরবন
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়
ছোট্টো বন্ধুরা, জানো কি আমাদের দেশ ভারতবর্ষের একুশ শতাংশ বনাঞ্চল! আর বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ সুন্দরবন! সবুজ অরণ্যে ছাওয়া ছোট-বড় দ্বীপ। ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির, কামট, হাঙর আরো নানান হিংস্র প্রাণী। খানা-খন্দে বিষধর কেউটে, গোখরো, কালনাগিনী ইত্যাদি নানান ধরনের সাপ। গাছে গাছে নানান প্রজাতির রংবেরঙের পাখি, নানান প্রজাতির হরিণ, ডালে ডালে বানর, রূপসী ময়ূর। এইসব নিয়ে মোহময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে রেখেছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন৷ মূলত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং বিভিন্ন ছোটো বড়ো নদী বঙ্গোপসাগরে মিশেছে এবং বিশাল ব-দ্বীপ গড়ে তুলেছে, বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মোহনা জুড়ে। লোনা দ্বীপের জলাভূমিতে প্রাকৃতিক নিয়মে মাটি ফুঁড়ে শিকড় এবং নিম্নমুখী ডালপালা ছড়িয়ে সৃষ্টি হয়েছে ম্যানগ্রোভ তথা লবনাক্ত সুন্দরী গাছের গহীন অরণ্য–যার নাম সুন্দরবন ৷ কলকাতা ছাড়া ভারতের আর কোনো মহানগরীর কাছাকাছি এরকম নয়নাভিরাম আরণ্যক সৌন্দর্যের অস্তিত্ব নেই ৷
সম্প্রতি দুদিনের সংক্ষিপ্ত সফরে ঘুরে এলাম রহস্যময় অনবদ্য সুন্দরবন এবং সঙ্গে নিয়ে এলাম দুর্নিবার আকর্ষণের মায়া৷ পাঁচ থেকে পঁচাত্তর বিভিন্ন বয়সের চল্লিশজন সদস্য নিয়ে শুরু হলো আমাদের যাত্রা ঠিক সকাল আটটায়৷ ঘন্টা দুয়েক সময় লাগলো সোনাখালি পৌঁছতে ৷ সোনাখালি জেটি থেকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমরা মাঝারি মাপের একটি ভাড়া করা লঞ্চে উঠে পড়লাম। সাড়ে দশটার মধ্যে লঞ্চ ছেড়ে দিলো, হোগল নদীতে ভেসে চললাম৷ হোগল নদী বেশ বড়সড় এবং প্রশস্ত ৷ এক পারে সোনাখালি অন্য পারে বাসন্তী৷ দু-পারেই বেশ ঘনবসতি।
সুন্দরবন অঞ্চলের ১০২টি দ্বীপের মধ্যে ৩৪টি দ্বীপে জনবসতি আছে। নদীর মাঝ বরাবর এগিয়ে চললো লঞ্চ৷ পেরিয়ে চলেছি অসংখ্য ছোট-বড় দ্বীপ ৷ বাঁদিকে পেরোলাম বড় জনপদ–গোসাবা৷ নদীর ধারেই অনেকখানি জায়গা নিয়ে অনুকূল ঠাকুরের আশ্রম। ভাসতে ভাসতে দুর্গাদোয়ানি নদীতে এসে পড়লাম ৷ ইতিমধ্যে চা এবং প্রাতরাশ পর্ব সারা হয়ে গেছে ৷ লঞ্চ এসে পড়লো বিদ্যাধরী নদীতে ৷ অসংখ্য নদী এদিক-ওদিক থেকে মাকড়সার জালের মত এসে মিশেছে৷ কোন নদী কোথা থেকে কার সঙ্গে এসে মিশেছে, তা বোঝার জন্য দুদিন একেবারেই যথেষ্ট নয় বেশ বোঝা গেল৷ বিদ্যাধরী নদীতে পড়ার কিছুক্ষণ পরেই জনবসতিহীন দ্বীপ শুরু হলো৷ ম্যানগ্রোভের জঙ্গল–প্রথমে ফাঁকা ফাঁকা, কিন্তু যত এগোতে লাগলাম ততই দুপাশের জঙ্গল ক্রমশঃ ঘন হয়ে উঠল৷ এত ঘন যে দুপুরের চড়া রোদেও দৃষ্টির অগম্য গহন অরণ্য৷ লাঞ্চ সারা হলো৷ শীতের মিষ্টি রোদে সবাই বসে আছি ডেকের উপরে ৷ মনের মধ্যে শিহরণ, অচেনা আনন্দ৷ নদীর হিমেল হাওয়ায় জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর।
বিদ্যাধরী ধরে চলতে চলতে একসময় আমরা পৌঁছলাম সজনেখালি ফেরিঘাটে–বিট অফিস থেকে অভয়ারণ্যে থাকার পারমিট আর ক্যামেরা ব্যবহারের অনুমতি নেওয়ার জন্য। গোমতী ও পীচখালি নদীর সঙ্গমে সুন্দরবন ব্যাঘ্রপ্রকল্পের দ্বীপ সজনেখালি ৷ আবার শুরু হলো চলা সুধন্যখালি ওয়াচ টাওয়ারের উদ্দেশ্যে। সজনেখালি থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ৷ জল আর ঘন জঙ্গলে ভরা দ্বীপ, তার মধ্যেই ওয়াচ টাওয়ার পর্যন্ত পাকাপোক্ত খাঁচার মত পথ তৈরি করা হয়েছে নিরাপত্তার কথা ভেবে৷ সুধন্যখালি নদীর পাড়ে সুধন্যখালি ওয়াচ-টাওয়ার৷ ঘন জঙ্গলে সুন্দরী ছাড়াও রয়েছে হেতাল, গরান, হোগলা ইত্যাদি গাছ৷ ছয় থেকে বারো ফুট উঁচু ম্যানগ্রোভ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ন্যাচারাল বাসস্থান ৷ ওয়াচ টাওয়ারের নিচে মিষ্টি জলের পুকুর৷ বনচরেরা সেখানে আসে তৃষ্ণা মেটাতে৷ শুনলাম ওখানে কখনো কখনো বাঘের দর্শনও পাওয়া যায়। আমাদের কপালে অবশ্য তা জুটলো না। তবে দুই জোড়া হরিণ-হরিণীর দেখা পাওয়া গেল৷ প্রচুর বানর, চার-পাঁচ রকমের রংবাহারি পাখি আর ময়ূর৷
ওয়াচ -টাওয়ার থেকে নদীর দিকে তাকিয়ে দেখি অস্তগামী লাল সূর্য ৷ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করলাম পড়ন্ত বেলায় নদীর ওপারে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য ! ওদিকে তাড়া আছে সন্ধের আগেই সজনেখালি পৌঁছুতে হবে। কারণ বেশি অন্ধকার হয়ে গেলে জেটিতে নামা বিপদজনক। তাছাড়া বন্যপশুর ভয়ও আছে ৷ যাই হোক সব আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণ করে নিরাপদে আমরা সজনেখালি ট্যুরিস্ট বাংলোয় পৌঁছলাম ৷ সজনেখালি জেটিঘাটেই সজনেখালি লজ ৷ বসতি বা দোকানপাট কিছুই নেই সজনেখালি দ্বীপে ৷ খাবার-দাবার পাওয়া যায় লজের ক্যান্টিনে ৷ আগে সোলার এনার্জিতে আলো জ্বলত, এখন জেনারেটর চালানো হয় রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত । তারপর হ্যারিকেনের আলোই ভরসা ৷ লজের পুরো বাড়িটাই কাঠের তৈরি ৷ সংখ্যায় চল্লিশ হওয়ার জন্য লজের ঊনত্রিশ খানা ঘরই আমরা বুক করে নিয়েছিলাম৷ সবাই যে যার বরাদ্দ ঘরে ঢুকে পড়লাম ৷ মুখ-হাত ধুয়ে জামাকাপড় বদলে হাজির হলাম ডাইনিং হলে ৷
রীতিমতো হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেছে ডাইনিং হলে ৷ কে বাচ্চা, কে বড় বোঝা যাচ্ছে না ৷ একটা টিভি রয়েছে–ছবির অবস্থা খুব খারাপ। টিভি বন্ধ করে শুরু হলো জুনিয়র বনাম সিনিয়র টিমের অন্তাক্ষরী৷ ঘণ্টাদুয়েক কীভাবে পেরিয়ে গেল টের পাওয়া গেল না৷ লজের কর্মীরা তাগাদা দিলো ডিনার সেরে নেওয়ার জন্য, যেহেতু রাত এগারোটার পর জেনারেটর বন্ধ হয়ে যাবে৷ ডিনার সেরে বেশ কিছুক্ষণ চললো টুকরো টুকরো আড্ডা৷ ঘরে ঘরে হারিকেন দেওয়া হলো। ভিতরে টিমটিমে আলো, বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, জঙ্গলের নিজস্ব শব্দ–বেশ গা-ছমছমে পরিবেশ ! বাঘ দেখা না হোক, বাঘের ডাক শোনা গেলেও তো হয় !
পরের দিন পূর্ব পরিকল্পনা মতো সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে সবাই রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ৷ সজনেখালি লজের ক্যাম্পাসের মধ্যে রয়েছে বাদাবন পরিচিতি কেন্দ্র বা ম্যানগ্রোভ ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার, সুন্দরবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর ব্যঘ্র-আসীনা বনবিবির মন্দির৷ বিট অফিস আর লজের মাঝে রয়েছে কচ্ছপ পুকুর, কামট পুকুর, কুমির পুকুর৷ ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টারের লাগোয়া পুকুরের মিষ্টি জলে নানা রকমের মাছ। পুকুরের ধারে ধারে নানান প্রজাতির গাছ৷ ঠিক সাড়ে আটটায় লঞ্চ ছাড়লো অথৈ জল আর জঙ্গল৷ ঘন্টাখানেক পরে আমরা পৌঁছলাম দোবাঁকি ওয়াচ-টাওয়ারে৷ এখানেও যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা৷ মজবুত খাঁচার মধ্য দিয়ে প্রায় আধ কিলোমিটার পথ হেঁটে ওয়াচ-টাওয়ারে পৌঁছলাম ৷ এখানেও মিষ্টি জলের পুকুর খনন করা হয়েছে বনচরদের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য৷ অত্যন্ত ঘন জঙ্গল, পাখিদের কিচিরমিচির, ময়ূরের ক্যাঁ ক্যাঁ শোনা গেল৷ অভিভূত হয়ে গেলাম চিতল হরিণ দেখে৷ চারটি হরিণ চার প্রজাতির, এদিকে ওদিকে গাছ-পাতা খাচ্ছে ৷ কারও পাঁচটি কারও তিনটি শিং, মনে হচ্ছে যেন কেউ যত্ন করে সাজিয়ে দিয়েছে। গায়ের বুটির ডিজাইনও আলাদা৷
ওয়াচ-টাওয়ারে ওঠার মুখেই রয়েছে একটি স্মৃতি-স্তম্ভ–ওয়াচ-টাওয়ার তৈরি করার সময় যে সমস্ত মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই স্তম্ভ ৷ জানা গেল সুন্দরবনে প্রায় ২০০টি বাঘ এবং ৩০ হাজারের বেশি চিতল হরিণের বাস ৷ লঞ্চে উঠলাম ৷ সুধন্যখালি নদী দিয়ে এসে পড়লাম বনবিবি ভারানিতে ৷ এখানে জলপথ অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ। এরপর পীরখালি নদী পেরিয়ে কাদিখালি, তারপর আবার বিদ্যাধরী৷ এখানে বিদ্যাধরীর চেহারা রীতিমতো ভয়াবহ। কোনদিকেই কূল দেখা যায় না, নদীর ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে লঞ্চের গায়ে ৷ ভয় আর খুশি–অদ্ভুত শিহরণ ৷ এইভাবে চলতে চলতে একসময় কূলের দেখা মিলল। আবার দুপাশে জঙ্গল, ছোট ছোট দ্বীপ ৷ আবার দুর্গাদোয়ানি, ছোট ছোট জনবসতি পেরিয়ে অবশেষে হোগলা নদী ৷ লঞ্চ ভিড়লো সোনাখালি জেটিতে ৷ স্বপ্নজগৎ থেকে ফিরে এলাম কঠিন বাস্তবে৷ কলকাতার খুব কাছেই এই ম্যানগ্রোভ অরণ্য, সুন্দরবন। সময় সুযোগ পেলে অবশ্যই ঘুরে আসবে। সবশেষে জানাই, ইউনেসকোর হেরিটেজ সম্মানে ভূষিত এই অনন্য বনভূমি–সুন্দরবন ।।
পাঠকদের মন্তব্য
250