ছোটোদের চাঁদের হাসি / হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা / জানুয়ারি ২০২৫

বৈদ্যনাথ ধাম, তপোবন আর ত্রিকূট পর্বত দেখতে চলো যাই দেওঘরে

 

তোমরা নিশ্চয়ই দেওঘরের নাম শুনেছ। ঝাড়খণ্ডের এই শহরের খ্যাতি মূলত বৈদ্যনাথের মন্দিরের জন্য। এর পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক মূল্য অসীম। এছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনুপম দেওঘরে রয়েছে নওলাখা মন্দির। শহর থেকে কিছুটা দূরেই অবস্থিত তপোবন ও ত্রিকূট পর্বত। একবার পয়লা বৈশাখের ছুটিতে গেছিলাম দেওঘর। বাহন হাওড়া-নিউদিল্লী দুরন্ত এক্সপ্রেস, নামতে হবে জসিডি স্টেশনে। হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়ল সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে, পৌঁছবে ১২টা ২৫-এ। যথা সময়ে ট্রেন জসিডি স্টেশনে পৌঁছে গেল। একটি দোকানে গিয়ে অটো স্ট্যান্ডের খোঁজ করতেই দোকানের মালিক দেখিয়ে দিলেন।

 

 

আগে থেকেই এলাকার একটি আশ্রমের অতিথিনিবাসে আমার বুকিং ছিল। প্রবেশ মাত্রই আশ্রম ও তার লাগোয়া অতিথিনিবাস দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। প্রচুর গাছগাছালি, ফুলের বাগান, তকতকে নিকোনো উঠোন। সিমেন্টের ঘরগুলি প্রাচীন ধরণের। চওড়া দেওয়াল। লাল সিমেন্টের মেঝে। সেখানেও পরিচ্ছন্নতা সর্বত্র। সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করে টাকাপয়সা জমা দিয়ে নির্ধারিত ঘরে গেলাম। একটু পরে স্নান করে খাওয়ার জায়গায় গেলাম। এলাহি বন্দোবস্ত। অতি সুশৃঙ্খল। বহু মানুষ একসঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু কোলাহল নেই।  চেয়ার আর লম্বা টেবিল, টেবিলে কলাপাতা, মাটির গ্লাস–এভাবেই খাবারের ব্যবস্থা। নিরামিষ খেতে হবে, আগেই জানতাম। চেটেপুটে খেলাম ভাত, ডাল, শুক্তো, ভাজা, সবজির দুটি পদ, চাটনি, দই।

 

 

বিকেল হলে চললাম নওলাখা মন্দিরে। গুরু বালানন্দ ব্রহ্মচারীর পরামর্শে কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ির রানী চারুশীলা দেবী ৯ লক্ষ টাকা ব্যয় করে এই মন্দির নির্মাণ করান। নির্মাণ খরচের অঙ্ক মেনেই নাম হয়েছে নওলাখা মন্দির। দারোয়ানের কাছে জুতো জমা রেখে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠা প্রথমে। তারপর একটি বিশাল সভাঘর পার হয়ে আর একটি কক্ষে মূল বিগ্রহের অধিষ্ঠান। ভিতরে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ। সন্ধ্যাপূজার আয়োজন চলছে দেখলাম। ওপরেই মন্দিরের চারপাশে সুন্দর একটি অলিন্দ। বাইরে তখন এক অনির্বচনীয় ছবি আঁকা হচ্ছে। পশ্চিম আকাশে লাল রঙ ঢেলে সূর্যদেব ডুবছেন। আর ঠিক উল্টোদিকে মায়াবী চাঁদ উঠেছে।

 

ফিরে এসে আশ্রমের ভিতরের মন্দিরে সন্ধ্যারতি দেখলাম। ডিনারে রুটি-সবজি খেয়ে পৌঁছে গেলাম ঘুমের দেশে। পরদিন সকালে চললাম তপোবন ও ত্রিকূট পর্বত দেখতে। বাহন সেই অটো। পিচের রাস্তা ধরে যেতে যেতে পড়ল খোলা প্রান্তর, তালগাছের সারি, মাঝে মাঝে প্রাচীন বট, অশ্বত্থ, ইতস্তত জঙ্গল। সকালে ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। একটু পর রাস্তাটা বাঁক নিতেই একটা অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। দুধারে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ। লাল লাল ফুলে সূর্যের কিরণ পড়ে ঝলমল করছে। ওই পথ ধরে আর একটু যেতেই তপোবন। অনেকটা উঁচু পাহাড়ের উপর শিবমন্দির। রামায়ণের কাহিনিতে আছে এর উল্লেখ।

 

 

মন্দিরে ওঠার ক্ষেত্রে বেশ মজার নিয়ম চালু এখানে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠা আর পাহাড় বেয়ে নামা। যতই কষ্ট হোক, নিয়ম মেনেই দর্শন করতে হবে। যেতে যেতে দেখি, পাহাড়ের এধার-ওধার থেকে বাঁদর ও হনুমান পরিবারের আনাগোনা। অনেকেই তাদের ফল খেতে দিচ্ছেন। সে ভারি মজার দৃশ্য ! একজন গাইড ছিলেন সঙ্গে। তাঁর হাত ধরে সিঁড়ি তো চড়তে শুরু করলাম। তারপরের কথা অবর্ণনীয়। কোথাও খাড়া সিঁড়ি, কোথাও গুহা, মাথা নিচু করে কোনও মতে নামতে হবে এমন নিচু আর সরু কাঠের ও সিমেন্টের সিঁড়ি। নামার সময় তো আরও কঠিন অবস্থা। স্রেফ খাড়া পাথর। কিছু কিছু জায়গায় চেটানো পাথরের ওপর দিয়ে শুধু শূন্যে ব্যালান্স করে নামতে হবে। যখন মাটিতে পৌঁছলাম, বিশ্বাস হচ্ছিল না। 

 

 

পরের গন্তব্য ত্রিকূট পর্বত। রামায়ণে এরও উল্লেখ আছে। এবার আর পাহাড়ে চড়ে মন্দির দেখার সাহস করলাম না। তাই দূর থেকেই দেখা। এখানেও আছে প্রচুর বাঁদর–তাদের মধ্যে একেবারে দু-আনা, চার আনা সাইজেরও আছে। বাঁদর বাহিনীর বিস্কুটের ডিমান্ড পূর্ণ করে আমি আখের রস খেলাম। এরপর ফিরে আসা আশ্রমে এবং লাঞ্চ করে বিশ্রাম। পরদিন রাত থাকতে উঠেছি। বৈদ্যনাথ দর্শনে যাব। আশ্রম থেকেই রিকশা ঠিক করে দিয়েছিল। সেই রিকশচালক একবারে ঘড়ি ধরে ভোর ৪টের সময় এসে হাজির। তখনও রাতের অন্ধকার কাটেনি। নির্জন রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল আমাদের রিকশা।

 

 

মন্দিরে পৌঁছনোর পর গেটে আমাকে নামিয়ে সে রিকশা স্ট্যান্ডে চলে গেল। আমি আশ্রম সেক্রেটারির এক চিলতে কাগজে লেখা চিঠি নিয়ে নির্দিষ্ট পান্ডার কাছে গেলাম। তিনি খুবই সমাদর করে মন্দিরের চাতালে বসার ব্যাবস্থা করে দিলেন। একটু একটু করে কাটছে অন্ধকার। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেই সাদা ধবধবে মন্দিরের চূড়ার উপর এসে পড়ল প্রথম রবির কিরণ। চারপাশে অগণিত ভক্ত, দূর দূর থেকে এসেছেন তাঁরা। ঘন্টা বাজছে। ফুল ও ধুনোর গন্ধ। সব মিলিয়ে এক অনির্বচনীয় প্রভাত চাক্ষুষ করে রিকশায় ফিরে এলাম  আশ্রমে।

 

 

পরদিন ফিরলাম গরীব রথ এক্সপ্রেসে। দেওঘরে বেশ কিছু হোটেল ছাড়াও আছে রামকৃষ্ণ মিশন ও অনুকূল ঠাকুরের আশ্রম পরিচালিত অতিথিশালা। কাছাকাছি আছে ময়ূরাক্ষী নদী। বৈশাখে তিরতিরে জল। বর্ষায় রীতিমতো ফুলেফেঁপে ওঠে শুনলাম। বৈদ্যনাথ ধাম ছাড়াও আরও কয়েকটি প্রাচীন মন্দির আছে দেওঘরে। খুব পরিচ্ছন্ন শহর। যেতে সময়ও লাগে না তেমন। আবহাওয়া চমৎকার। জল অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। এদিকওদিক যেতে কোনও সমস্যা নেই। খরচাপাতি আয়ত্তের মধ্যেই। সব মিলিয়ে চমৎকার ব্যাপার। তোমরাও একবার পরিবারের সঙ্গে দেওঘর  ঘুরে আসতে পারো।

 


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up