ওক-দেওয়ার-পাইনে ঘেরা মায়াবতী
লিপি চক্রবর্তী
রাজধানী এক্সপ্রেস শিয়ালদা থেকে ছাড়ল চারটে বেজে পঞ্চাশ মিনিটে। পরদিন সকালে নিউদিল্লি। সারাদিন দিল্লিতে ঘুরুঘুরু। তারপর রাতে রানীক্ষেত এক্সপ্রেস ধরে কাঠগোদাম। সকালের আলো তখনও ফোটেনি, ঝিমঝিমে ঠান্ডা। কলকাতা থেকেই গাড়ি বুক করা ছিল। যাব মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম। প্রথমেই তোমাদের জায়গাটা সম্পর্কে জানাই। অদ্বৈত আশ্রমের নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে স্বামী বিবেকানন্দের স্বপ্ন। অদ্বৈত আশ্রমে কোনো দেবতার মূর্তি বা ছবি নেই। আছে শিষ্যদের সন্ন্যাস যাপন এবং যাঁরা দুদণ্ড শান্তির খোঁজে আসেন, তাঁদের মনে আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস জাগিয়ে তোলার উপযোগী সুন্দর প্রকৃতি ও পরিবেশ।
সেই কবে ১৮৯৫ সালে ইংল্যান্ডে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে দেখা হয়েছিল জেমস হেনরি সেভিয়ের ও শার্লট এলিজাবেথ সেভিয়েরের। তাঁদের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘোরাঘুরি। শেষে আল্পসে এসে স্বামীজি তাঁদের বলেন তাঁর স্বপ্ন–অদ্বৈত বেদান্ত অনুশীলনের জন্য শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে তিনি একটি অদ্বৈত মঠ প্রতিষ্ঠা করতে চান। ব্রিটিশ আর্মিতে কাজ করার সময় পাঁচ বছর ভারতে কাটিয়েছিলেন সেভিয়ের দম্পতি। ভালোও বেসেছিলেন এই সুন্দর দেশটিকে, উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের এই ভারতীয় সন্ন্যাসীকেও। এরপরই তাঁরা আলমোড়ায় আসেন। খোঁজ মেলে ওক-দেওদার-পাইন গাছে ঘেরা শান্ত নিরিবিলি স্থান মায়াবতীর। সেটা ১৮৯৮-এর জুলাই। ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ !! স্বামীজির স্বপ্ন সার্থক হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ রচিত হলো সেদিন। পরের বছরই মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম প্রতিষ্ঠা–দিনটি ছিল ১৯ মার্চ ১৮৯৯।
কাঠগোদাম পৌঁছবার কথা আগেই বলেছি। সেখান থেকে আমাদের পথ মায়াবতী-গামী। চলার পথে পরপর পড়ল ভীম তাল, কমল তাল, নওকুচিয়া তাল। তারপর আলমোড়াতে দেখলাম রামকৃষ্ণ মিশন। এখান থেকে যাগেশ্বর। যাগেশ্বরের একগুচ্ছ মন্দিরের দেবতারা হলেন শিব ঠাকুরের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ। এটি ভারত সরকারের হেরিটেজ তকমা পেয়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মন্দির চত্বর। বেশ খানিকটা সময় এখানে কাটিয়ে বিকেল গড়িয়ে পৌঁছলাম মায়াবতী। যেহেতু অন্ধকার নেমে এসেছিল, তাই ঘোরাঘুরি আর হলো না। গেস্ট হাউসে নির্ধারিত ঘরে জিনিসপত্র রেখে মায়াবতী আশ্রমে গেলাম।
প্রবেশ পথের প্রথমেই বাম দিকে পড়ল লাইব্রেরি। অনেকেই বই হাতে মগ্ন দেখলাম। প্রচুর মানুষ রয়েছেন মূল আশ্রমের বারান্দায়। সবাই কথা বলছেন খুব আস্তে। এমন শান্ত সমাহিত পরিবেশ যে কারও অকারণ জোরে কথা বলার ইচ্ছেই হবে না। ঘণ্টা বাজিয়ে রাতের খাওয়ার ডাক পড়ল। এখানকার ক্ষেতে উৎপন্ন সুস্বাদু সবজি, ডাল, ভাত, রুটি আর এখনকার ডেয়ারি ফার্মের গরুর দুধ–শীতের রাতে অমৃত। গেস্ট হাউসে ফিরে গরম জলে হাতমুখ ধুয়ে সোজা লেপের ভিতরে। পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙে বাইরে এসে দাঁড়াতেই সবুজে সবুজ প্রকৃতি। চোখ-মন-প্রাণ জুড়িয়ে গেল।
তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম আশ্রমের উদ্দেশ্যে। ওখানেই ব্রেকফাস্ট। হাঁটতে হাঁটতে অল্প চড়াই ভেঙে পৌঁছে গেলাম মূল আশ্রমে। আগের দিন রাতের অন্ধকারে বিশাল উঁচু উঁচু পাইন গাছগুলোকে দেখিইনি তেমনভাবে। আজ আশ্রম চত্বরে ঢুকতেই দেখি ফুলের সমারোহ। বর্ণ-আকার মিলিয়ে তুলনাহীন তারা। ব্রেকফাস্টের পর বাগানে এসে দেখি আশ্রমের একজন মানুষ অনেকগুলো লাঠি (পাহাড়ে চড়তে গেলে যেমন লাঠি লাগে) হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। প্রত্যেক যাত্রীর হাতে লাঠি পৌঁছে দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করছেন, ওপরে যাবেন তো? অনেকেই যেতে চাইলেন না। আবার আমাদের মতো বেশ কয়েকজন উৎসাহী যেতে চাইলেন।
প্রায় আড়াই কিলোমিটার হেঁটে পাহাড়ের মাথায় উঠে পৌঁছে গেলাম 'ধরমঘর'। একশো বছরেরও বেশি আগে, স্বামীজি ধ্যানে বসেছিলেন এখানেই। জঙ্গলে ঢাকা এবড়োখেবড়ো পথে উঠতে উঠতে এক জায়গায় একটু থেমে আমাদের পথপ্রদর্শক জানালেন, কথিত আছে এখানে মায়াদেবীর মন্দির ছিল–তার থেকেই মায়াবতী নামকরণ ! অদ্বৈত আশ্রম প্রতিষ্ঠার পরে স্থানীয় গ্রামের মানুষ দেবীকে তাঁদের গ্রামে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেই জায়গায় এখন ডেয়ারি ফার্ম হয়েছে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা পথ গিয়েছে চম্পাবতের দিকে। একটা জায়গা থেকে ভাগ হয়ে আমরা উঠতে লাগলাম ধরমঘরে পৌঁছনোর জন্য। রাস্তার সৌন্দর্য লিখে প্রকাশ করা খুব কঠিন। শুধু দুচোখ ভরে শান্ত কোমল প্রকৃতি দেখে যাওয়া আর অপার শান্তি অনুভব।
এই ছোট্ট সমতল জায়গাটিতে রয়েছে একটি ধ্যানগৃহ আর তার ঠিক বাইরে একটি জায়গায় ত্রিশূল গাঁথা মাটিতে। মহীরুহরা আকাশ ঢেকে ফেলেছে প্রায়। ধরমঘরে তখন ধ্যানমগ্ন পরিবেশ। মাটি ছুঁয়ে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। এই মাটিতে পা পড়েছিল সেই মানুষটির, যাঁর জন্য আজও আমাদের মাথা উঁচু হয়ে আছে সারা পৃথিবীর কাছে। এখানে গোটা কয়েক বসার জায়গাও আছে। আশ্রমে ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে গেস্ট হাউসে ফিরলাম। এখন সমস্ত জায়গা রোদে ঝলমল করছে। দেওদার, পাইনের ঘের দেওয়া রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারছিলাম, স্বামীজি সেভিয়ের দম্পতির সঙ্গে আল্পস বেড়াতে গিয়ে যে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, ভারতবর্ষে ঠিক সেই রকম জায়গা খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল এই মায়াবতীতে। আমাদের ভারতে সব আছে। প্রকৃতি সব সাজিয়ে রেখেছে সুন্দর করে। শুধু খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষা।
আড়াইটে নাগাদ বের হলাম আশেপাশে ঘুরতে। কাছেই লোহাঘাট। সেখানে নদীর পাড়ে আছে বহু পুরোনো এক শিবমন্দির। কাছাকাছি শুনেছি একটি গুরুদ্বার আছে, নাম রিঠা মিঠা সাহিব। অপূর্ব সুন্দর পরিবেশ। আমাদের যিনি প্রসাদ দিলেন, তাঁকে এই জায়গার এমন নাম কেন জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন, গুরু নানক নাকি কয়েকজন শিষ্য নিয়ে পথ চলতে চলতে এখানে এসে পৌঁছন। ঘন জঙ্গল, কোথাও কেউ নেই। একজন শিষ্য ক্ষুধার্ত হলে গুরু নানক তাঁকে রিঠা গাছের ফল খেতে বলেন। রিঠা ফল যে তেতো, আমরা সবাই জানি। সেই শিষ্যও সেকথা গুরুকে বলেন। গুরু নানক তখন গাছটি ছুঁয়ে বলেন, এবার ফল মিষ্টি হয়ে গেছে । শিষ্যরা সেই মিষ্টি রিঠা ফল খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করেন। তাই এই জায়গার নাম রিঠা মিঠা সাহিব। সেই রিঠা গাছটির কাণ্ডের খানিকটা অংশ কাচের ঘেরাটোপে সংরক্ষিত আছে।
রাতে আশ্রমে ফিরে ডিনার শেষে বিশ্রাম। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে আমাদের ফেরার পালা। আমরা এবার যাব উত্তরাখণ্ডের অন্যান্য অফবিট রুটে। সেইসব গল্প পরে কখনো সুযোগ পেলে শোনাব তোমাদের। মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমে থাকতে হলে বেশ খানিকটা আগে থেকেই বুক করতে হয়। অনলাইনে ওদের ওয়েব সাইটে গিয়ে ফর্ম ফিলাপ করতে হবে। ওঁরা ই-মেলে উত্তর দিয়ে দেন। থাকা এবং খাবারের জন্য কোনো মূল্য দিতে হয় না। ইচ্ছেমতো ডোনেশন দিলেই হয়। কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। গেস্ট হাউসে জায়গা না পেলে, খুব কাছেই লোহাঘাটে থেকে সারাদিন মায়াবতী আশ্রমে ঘুরে আসতে পারো। শিয়ালদা স্টেশন থেকে নিউদিল্লি-কাঠগোদাম হয়ে যাওয়ার কথা তো শুরুতেই বলেছি। এছাড়া হাওড়া স্টেশন থেকে বাঘ এক্সপ্রেস বা লালকুয়া এক্সপ্রেসে লালকুয়া নেমে গাড়িতে মায়াবতী যাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে বেরিলিতে নেমে ট্রেন বদলে টনকপুর হয়ে গেলে, মায়াবতী কাছাকাছি হবে। যাওয়ার পথে শ্যামলাতাল রামকৃষ্ণ মিশন ও নানকমাতা সরোবর দেখে যেতে পারো তোমরা। ভালো লাগবে।
পাঠকদের মন্তব্য
250