ছোটোদের চাঁদের হাসি / হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা / ফেব্রুয়ারি ২০২৪

শান্ত নির্জন তাজপুর

 

সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ। ঝোড়ো হাওয়াও বইছে। আর তাতেই যেন আরও খুলেছে সমুদ্রের রূপ! আজই আমরা এসেছি তাজপুর বলে একটি ছোট্ট গ্রামে। সাগরপাড়ের এই গ্রামটি একেবারে নির্জন আর শান্ত। তোমরা যারা তাজপুরের নাম এখনও শোনোনি, তাদের জানাই, এটা বঙ্গোপসাগরের তীরে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত। কলকাতা থেকে গাড়িতে তাজপুর যেতে সময় লাগে মোটামুটি চার ঘণ্টা। শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে গেলেই পথের ধারে ছোটো ছোটো গ্রাম, পুকুর, গাছপালা–দেখলেই মন ভালো হয়ে যাবে তোমাদের। আর যারা প্রকৃতির ছবি আঁকতে ভালোবাসো, তাদের তো খুবই ভালো লাগবে।  

 

কলকাতা থেকে বের হয়ে প্রথমে বেশ খানিকটা পথ হাইওয়ে। তারপর, সেখান থেকে পিচের রাস্তা গিয়েছে গ্রামের দিকে। এরপর পিচ-রাস্তা ছেড়ে ধরতে হবে গ্রামের পথ। বড় বড় বিলের মতো দেখতে জলাশয়ের মাঝখান দিয়ে গিয়েছে মেঠো পথ, পাশে দাঁড়িয়ে তাল ও খেজুর গাছের সারি–যেন পটে আঁকা ছবি। এই বিলগুলি আসলে মাছের ভেড়ি। ভেড়ি অর্থাৎ মাছ চাষ হয় যেখানে। মাছ ধরার জালও পাতা রয়েছে সেখানে। এইসব দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম সাগরের পাড়ে। ঢেউয়ের রাশি তখন উত্তাল। তবে, বৃষ্টি কমেছে। দেখলাম বেশ কয়েকটি নৌকো বাঁধা রয়েছে বালিয়াড়িতে। এগুলি সবই জেলে নৌকো। এই নৌকোগুলি করেই সাগরের গভীরে অনেক দূরে দূরে মাছ ধরতে যায় জেলেরা।

 

 

আর যা দেখলাম বালিয়াড়ি জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রচুর লাল কাঁকড়া। আমাদের পায়ের আওয়াজ পেলেই তারা দ্রুতগতিতে পালিয়ে, লুকিয়ে পড়ছে এদিক-ওদিক ছড়ানো নিজেদের গর্তে। সমুদ্রের পাড় থেকে খানিকটা দূরে ছোটো ছোটো আগাছার ঝোপ। গরুর পাল চড়ে বেড়াচ্ছে সেখানে। একটা জায়গায় জেলেরা বড় বড় জাল শুকোচ্ছে। গ্রামটিতে মূলত মৎস্যজীবীদের বাস। আসার পথে দেখা মাছের ভেড়ির কথা তো আগেই বলেছি তোমাদের। যেখানে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে, তার থেকে একটু হেঁটে সাগরপাড়ে যেতে হয়। গাড়িতে ফ্লাক্সে চা ছিল, বিস্কুট ও অন্যান্য স্ন্যাক্স সহযোগে চায়ে গলা ভিজিয়ে আমরা গেলাম সমুদ্রের একেবারে ধারে। এখন চারদিক শুনসান। শুধু বাতাসের শনশন শব্দ। উল্টোনো নৌকাগুলি ঘিরে খেলছে কচিকাঁচার দল। 

 

এখানে একটা কথা। তাজপুর বিচ এমনিতে খুবই দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু এখানে স্নান করা কিছুটা বিপদজনক। বিচের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় হ্রদ বা জলাশয়। এগুলি দেখতে দারুণ হলেও সুগভীর। বিশেষত জোয়ারের সময় জল অনেকটা ওপরে উঠে এলে বোঝাই যায় না এদের উপস্থিতি। আবার জল নেমে গেলে দারুণ সুন্দর লাগে দেখতে। তাই সমুদ্রে না নেমে দূর থেকে সৌন্দর্য উপভোগ করাই ভালো। বেলা বাড়লে গাড়ি নিয়ে একটি রিসর্টে এলাম আমরা। আগে থেকেই বুকিং করা ছিল। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গিয়েছিল। একটু ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে গেলাম। বর্ষার ইলিশ তখন উঁকি মারছে মাছের ঝোলের বাটি থেকে। রসিয়ে লাঞ্চ শেষ করে ক্ষণিক বিশ্রাম।

 

 

তাজপুরে আমরা দুই বন্ধু গিয়েছিলাম। দুজনেই প্রকৃতি ভালোবাসি। তাই বেশিক্ষণ ঘরে মন টিকলো না। গ্রামের পথ ধরে গাড়ি নিয়ে চললাম সাগরের পানে। ততক্ষণে আকাশ একেবারে পরিষ্কার। হাওয়ায় দুলছে নারকেল গাছের সারি। নির্জন পথ ধরে আবার সাগর পাড়ে। যদিও বিচে বেশ ভিড়। আরও কিছু ট্যুরিস্ট ঘোরাফেরা করছেন তখন। ছবি তুলছেন সকলেই। গরুর পাল নিয়ে ফিরছেন একজন গ্রামের মহিলা। ছাগল চড়ানো এক কিশোরও তার ছাগবাহিনী নিয়ে ঘরে ফেরার পথে। আর ফিরছে একে একে জেলে নৌকো।

 

সাগরের পাড় থেকে একটু দূরে এক চায়ের দোকান। বেজায় ভিড় সেখানে। আমরাও সেই ভিড়ে যোগ দিই। গরম চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে দূরের সমুদ্র দেখি। সেখানে ততক্ষণে কমলা-গোলাপী আভা ছড়িয়ে পড়েছে। অস্তগামী সূর্যের মায়াময় রূপের ছবি দেখি মুগ্ধ হয়ে। গোধূলির আলো মেখে নিয়েছে চরাচর। অনেকেই ক্যামেরায় সে ছবি বন্দি করে নেন। আমরাও। লোকজন এক এক করে যেতে শুরু করে। সমুদ্রের তীরে জলের আছড়ে পড়ার শব্দে মিশে যায় ঘরে ফেরা পাখির কূজন। তারপর হঠাৎই সূর্য ডুব দেয় সাগরের জলে। আবছা অন্ধকারে হোটেলে ফিরি আমরা। ডিনারে গরম গরম রুটি আর সুস্বাদু দেশি মুরগির ঝোল খেয়ে চললাম ঘুমের দেশে। পরদিন ভোরে ফেরার পথে সূর্যোদয় দেখতে আরও একবার গেছিলাম সমুদ্রের পাড়ে। সেও এক অনির্বচনীয় দৃশ্য ! সেই স্মৃতি নিয়েই ফেরা কলকাতায়।

 


পাঠকদের মন্তব্য

কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up