মুগ্ধ করে ইতিহাসের সাক্ষী কোনারকের অপূর্ব সূর্য মন্দির
অজন্তা সিনহা
একটু আগেই পূর্ব আকাশ লাল করে ঢেউয়ের রাশি ছুঁয়ে, উঠে এসেছে দিনের প্রথম সূর্য। তারও আগে হলিডে হোমের দরজায় গাড়ির হর্ন বাজিয়েছে গাড়ির ড্রাইভার। গতকালই ঠিক হয়েছিল, আজ সকালে সূর্যোদয় দেখে, তারপর আমরা কোনারকের উদ্দেশে রওনা দেব। পুরীর সমুদ্র, তার বুকে দুরন্ত জলোচ্ছ্বাস আর সূর্যোদয়–সব মিলিয়ে এক অপরূপ প্রাকৃতিক ছবি দেখে শুরু হলো মন ভালো করা একটি দিন। তোমরা অনেকেই নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশায় অবস্থিত বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী পুরীতে গিয়েছ এবং এই অপরূপ প্রাকৃতিক ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছ। তবে, আমি আজ তোমাদের পুরী নয়, কোনারক ভ্রমনের গল্প শোনাব, যেখানে রয়েছে ইতিহাস প্রসিদ্ধ সূর্য মন্দির।
এদিন ঘুমভাঙা ভোরে পুরীর সি-বিচকে পিছনে রেখে বেরিয়ে পড়েছি আমরা। ওড়িশা পর্যটন বিভাগের সৌজন্যে এখানকার সমস্ত পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে যাতায়াতের পথ খুবই সুন্দর। পুরী থেকে কোনারক যাওয়ার পথটি একেবারে ঝাঁ চকচকে। পিচ ঢালা সুগঠিত পথের দুপাশে পড়ে নানা জাতীয় গাছপালা সম্বলিত জঙ্গল, নদী এবং জনপদ। সেইসব দেখতে দেখতেই চলেছি। এভাবে বেশ খানিকটা যাওয়ার পর হঠাৎই গাছপালার আড়াল থেকে উঁকি মারলো স্বর্গীয় নীলাভ জলোচ্ছ্বাস। মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম। ড্রাইভার জানালেন, এটাই বিখ্যাত চন্দ্রভাগা বিচ। ওড়িশার মনোরম সি-বিচগুলির মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও পরিচ্ছন্ন এই বেলাভূমি থেকে চোখ ফেরানো যায় না, এমনই তার রূপরাশি। তোমরা কোনারক গেলে অবশ্যই চন্দ্রভাগা দর্শন কোরো।
এরপর আবার চলা শুরু। কিছুদূর যাওয়ার পর বেশ বড়ো একটি বাঁক। চা পান ও ব্রেকফাস্টের জন্য এখানেই থামা হলো। অনেকটা ছড়ানো জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই ধাবায় সকাল সকালই বেশ ভিড় দেখলাম। কোনারক-গামী পর্যটকদের সংখ্যাই বেশি। গরম গরম পুরি আর সবজি, সঙ্গে সুস্বাদু চা পান করে আবার যাত্রা। ততক্ষণে প্রভাত-সূর্যের নরম আলো মেখে নিয়েছে চারপাশের প্রকৃতি। আরও কিছুদূর যাওয়ার পর ড্রাইভার ভাই বললেন, দিদি, আমরা সূর্য মন্দিরে এসে গিয়েছি। বিশাল খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে কালের বহু ইতিহাসের সাক্ষী সূর্য মন্দির। তার অবর্ণনীয় স্থাপত্যকলার সামনে দাঁড়িয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। মন চলে যায় সেই প্রাচীন সময়ে, যখন অজস্র দক্ষ ও প্রতিভাবান শিল্পীর হাতের গুণে তিল তিল করে গড়ে উঠেছিল এই অপরূপ মন্দির।
ঢুকেই সামনে বিশাল এক প্রাঙ্গণ, তাকে ঘিরে সবুজ বাগান আর কিছু প্রাচীন গাছপালা। প্রচুর দর্শনার্থী। এছাড়া এদিক ওদিক ছড়িয়ে বসে মন্দিরের স্কেচ করছেন তরুণ চিত্রশিল্পীরা। মন্দিরের কাছে যেতে হলে আর একটু পথ চলতে হবে। এই যাওয়ার অবকাশে তোমাদের জানাই কোনারক ও সূর্য মন্দির সম্পর্কে কিছু তথ্য। ওড়িশার রাজধানী ভুবনেশ্বর থেকে ৬৫ কিমি দূরত্বে, বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত কোনারক। পুরী থেকে এর দূরত্ব ৩৫.৯ কিমি, যেতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা মতো। আজ থেকে বহু যুগ আগে ১৩ শতকে তৈরি হয় কোনারকের বিখ্যাত সূর্য মন্দির। মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৮৫৭ ফুট। তবে, অনেকটা অংশই এখন বালিতে ডুবে গেছে। রাজা প্রথম নরসিংহ দেবের আমলে তৈরি কালো গ্র্যানাইট পাথরের এই মন্দির এখন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত। বারবার বিভিন্ন রাষ্ট্রশক্তির আক্রমণে এবং কালের অঙ্গুলিহেলনে মন্দিরের অনেক অংশই আজ ভগ্ন। তবু, এর আকর্ষণ, গুরুত্ব ও মর্যাদা আজও বিদ্যমান। মন্দিরের অভ্যন্তরস্থ মিউজিয়ামে রয়েছে ভাস্কর্যের অসাধারণ কিছু নমুনা। মিউজিয়ামটির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রযেছে আর্কিওলজি সার্ভে অফ ইন্ডিয়া।
নির্মাণকাল থেকে অনেকদিন পর্যন্ত সমুদ্র ছিল একেবারে মন্দিরের গা ঘেঁষে। মনে হতো, একেবারে সমুদ্রের বুক থেকেই উঠে এসেছে সূর্যদেবের রথ। আজ অবশ্য সমুদ্র অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছে। ৭টি ঘোড়া টেনে নিয়ে চলেছে ১২ জোড়া চাকা সমন্বিত এই অসাধারণ বর্ণময় ও অলংকৃত রথ। ৭টি ঘোড়া হলো ৭ দিনের প্রতীক। ২৪টি চাকা অর্থাৎ ২৪ পক্ষ। পুরাণ, ভূগোল ও ইতিহাস মিলে মিশে একাকার সূর্য মন্দিরের গঠন সৌকর্যে। তবে, এ সবই পুরোনো দিনের ছবি। ৭টি ঘোড়ার মধ্যে এখন দাঁড়িয়ে অবশিষ্ট ৬টি। চাকাগুলিরও ভগ্নদশা। কথিত আছে, এই সম্পূর্ণ মূর্তির ওপরে ছিল একটি অপূর্ব হিরে। এমনই স্থাপত্য বিজ্ঞান মেনে তৈরি এই মন্দির, যে সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়ত ওই হিরের ওপরেই। পরে, খুরদার রাজার আদেশে, ১৬২৭ সালে ওই হিরেটি জগন্নাথ মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। এবার ফেরার পালা। তোমাদের জানিয়ে রাখি এখানে পুরী বা ভুবনেশ্বর দুদিক থেকেই গাড়িতে আসা যায়। আর কলকাতা বা যে কোনও বড়ো শহর থেকে পুরী ও ভুবনেশ্বর যেতে হলে আছে রেল ও বিমানপথ।
ছবি : লেখক
পাঠকদের মন্তব্য
250