ছোটোদের চাঁদের হাসি / হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা / আগষ্ট ২০২৫

পাইনের ছায়াঘন বাগোড়ায়

 

জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ, অর্থাৎ, উত্তরবঙ্গে এই সময়টায় বেশ ঠান্ডা। ফলত নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমেই টের পেলাম বাতাসের হু হু কাঁপন। কথামতো স্টেশনের বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছিল। ড্রাইভার এসে লাগেজ গাড়িতে তোলে।  স্টেশন চত্বর, শিলিগুড়ি শহর ছেড়ে গাড়ি সুখনা জঙ্গলের পথ ধরে। আর সঙ্গে-সঙ্গেই বদলে যায় দুপাশের দৃশ্য। পিচ ঢালা পথ এখন কিছুটা চড়াইমুখী, এছাড়াও দুটি দিক ঘন জঙ্গলে আকীর্ণ। এবার তোমাদের জানাই আমার গন্তব্যের কথা। যাচ্ছি কার্সিয়ং-এর নিকটবর্তী ছোট্ট গ্রাম বাগোড়ায়, যার উচ্চতা ৭১৫০ ফুট। অর্থাৎ ভালোই ঠান্ডা হবে। ড্রাইভার নেপালি গান চালিয়ে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি ছোটায়। মাঝে পথের পাশের এক দোকান থেকে গরম গরম চা আর অমলেট খেয়ে নিয়েছি।

 

 

সুখনার জঙ্গল থেকে পঙ্খাবাড়ির রাস্তায় পড়ল আমাদের গাড়ি। এরপর চড়াইগামী পথ। কার্সিয়ং শহরে যখন পৌঁছলাম, ততক্ষনে কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছে চারপাশ।  শহরের ঘিঞ্জি ছাড়িয়ে ডানদিকের অপেক্ষাকৃত একটি নির্জন রাস্তা ধরে ড্রাইভার। এই রাস্তা ধরে শুধু বাগোড়া নয়, যাওয়া যায় চিমনি, লাটপাঞ্চার ও চটকপুরেও। যত ওপরে উঠি পথের দু'পাশে ঘন হয় পাইনের ছায়া। কুয়াশা জমে গাছেদের আনাচেকানাচে। ধূসর মেঘে ঢাকা পড়ে আকাশ। এভাবেই কোনও এক সময় পৌঁছে যাই আমার বাগোড়ার ঠিকানা, ডিকি'স হোম স্টে-তে। একটু আগেই ঝাপিয়ে বৃষ্টি এসেছে। হাওয়ার তোড়ে দাঁড়ানো মুশকিল। রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা উঠে পৌঁছতে হবে হোম স্টে-র দরজায়। এরই মধ্যে বিশাল রঙিন ছাতা নিয়ে হাজির এক কিশোর। তার হাত ধরেই বৃষ্টি মাথায় করে পাহাড়ের ওই কঠিন পথে ওপরে উঠি।

 

 

ঠান্ডার দাপটে জমে যাওয়ার যোগাড়। এদিকে হাত-পা ধোওয়ার চলতি অভ্যাসে বাথরুমে গিয়ে কল খুলতেই বিপত্তি–বরফ জলে জমে যায় হাত। যাই হোক, এরই মধ্যে কেটলি করে গরম জল নিয়ে এসেছে সেই কিশোর, আমার হাত-মুখ ধোওয়ার জন্যই। তার আনা গরম জলে একেবারে স্নানই করে ফেলবো ঠিক করলাম। স্নান করে সোয়েটার, চাদর, মোজা, গ্লাভস ইত্যাদিতে শোভিত হয়ে বাইরে আসতেই মন ভালো হয়ে গেল। মেঘ সরে গেছে। ঝলমলে রোদ্দুর মেখে নিয়েছে বাগোড়া।

 

আমি চা নিয়ে বারান্দায় বসি। সামনে খোলা প্রান্তর। পাথরে বাঁধানো পথ চলে গেছে মাঝখান দিয়ে। কিচেন ও ডাইনিংরুম একধাপ নিচে। এদিন ডাল, ডিমের ঝোল, রাই শাক আর আলুর চোখা দিয়ে লাঞ্চ হলো। খুব ক্লান্ত ছিলাম। বিশ্রামের জন্য বিছানায় শরীর রাখতেই দেখলাম বালিশ ইত্যাদি সবই হিমশীতল। দুখানা ভারি কম্বল জড়িয়ে কাঁপুনি থামাবার চেষ্টা করি। কখন যেন ঘুমিয়েও পড়ি। বিকেল হতেই বাইরে। একটা মালভূমির মতো আকৃতির জায়গার ওপর বাড়িটা। তাই সামনের দৃশ্যপট বহুদূর পর্যন্ত চোখে পড়ে। পাইনের সারি ঘিরে রেখেছে অঞ্চলটি। পিছনে ঢেউয়ের মতো পাহাড়শ্রেণী। কোনাকুনি বাঁদিকটা পশ্চিম। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠি। মুগ্ধ হই অপূর্ব সূর্যাস্ত দেখে।

 

 

আলো কমলে ঘরে আসি। ততক্ষণে জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। ডিনারে চিকেন আর রুটি খেয়ে বিছানায়। রাত ন'টা বাজে মাত্র। চারিদিক চুপচাপ। ঘুম ভাঙলো অতি ভোরে, পাশের ঘরের টুরিস্টদের প্রবল চিৎকারে। দ্রুত গরম পোশাক জড়িয়ে বাইরে আসি। সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য। আকাশ যেখানে মাটির সঙ্গে মিশেছে, সেখানটায় এখনও ঘোর অন্ধকার। তার একটু ওপর থেকে অন্ধকার ফিকে হচ্ছে আর আগুনের শিখার মতো লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে দিগন্ত জুড়ে। বিস্ময়ে স্তব্ধ সবাই। একটু একটু করে আলো বাড়লো, কাটলো অন্ধকার। দশদিক সচকিত করে পূব আকাশে উদ্ভাসিত হলেন দিনমনি।

 

একটু পরে চা খেয়ে সামনে হেঁটে গিয়ে দেখি ঘাসের ওপরের সব শিশির বরফকুচিতে পরিণত হয়েছে। রাতারাতি ঘটেছে এই কান্ড। অর্থাৎ রাতে তাপমাত্রা নেমেছিল শূন্যে। এখন আকাশ ঝকঝকে। দেখা যাচ্ছে ফসলের ক্ষেত, সেখানে শাকসবজির সবুজ প্রাচুর্য। এই বাড়িটা বাগোড়ার সব থেকে উঁচুতে। অর্থাৎ একটি ভিউ পয়েন্ট। তাই যেদিকেই চাও, প্রকৃতির আঁচলে ছড়ানো মনিমুক্তা চোখে পড়ে। বর্ণনাতীত সেই সৌন্দর্য। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে দিব্যি দর্শন মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার। রাতে ছাদের উপর থেকে দেখা যায় দার্জিলিং,কালিম্পং ও কার্সিয়ং শহরের আলো।

 

 

কিছুদূর হেঁটে গেলে জিরো পয়েন্ট, আর্মি বেস ক্যাম্প। এখানেও একটি ভিউ পয়েন্ট আছে। উপত্যকায় বহতা তিস্তার অসাধারণ এক ভিউ মেলে এখান থেকে। বাগোড়া হলো রডোড্রেনডনের স্বর্গ। পাইন ছাড়াও আছে ওক।  কমলালেবু গাছও চোখে পড়ে। বসন্তে অজস্র রঙিন ফুলের বাহার। সকাল-সন্ধ্যায় কান পাতলেই শোনা যায় নানাজাতের পাখির কিচিরমিচির। ছুটি শেষ। এবার ফেরার পালা। পরের দিন হালকা লাঞ্চ করে বের হলাম। যথা সময়ে পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। অপেক্ষা ট্রেনের। কয়েক ঘন্টা ওয়েটিংরুমে।  তারপর রাতের ট্রেনে চেপে কলকাতা।

 


পাঠকদের মন্তব্য

মহুয়া দাস লিখেছেন... ১১ই আগষ্ট, ২০২৫
পড়তে পড়তে পৌঁছে যাই বাগোড়ায়। জায়গাটি সম্পর্কে আমার জানা হলো, আমি জানতামই না এমন একটি জায়গার নাম। পড়ে ঋদ্ধ হলাম।
রিংকু শূর চ্যাটার্জি লিখেছেন... ১৯শে আগষ্ট, ২০২৫
স্বপ্নের আবহাওয়া তে যেনো নিজেই ঘুড়ে এলাম, এতো সুন্দর স্পষ্ট সাবলীল বর্ননা, খুব ভালো লাগলো ❤️

আপনি কি এই লেখায় আপনার মন্তব্য দিতে চান? তাহলে নিচে প্রদেয় ফর্মটিতে আপনার নাম, ই-মেইল ও আপনার মন্তব্য লিখে আমাদের পাঠিয়ে দিন।
নাম
ই-মেইল
মন্তব্য

250

    keyboard_arrow_up