নদীর নাম সীসামারা
অজন্তা সিনহা
ঘড়ি ধরে সকাল ৭টা ২০তে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন ছাড়ল শিলিগুড়ি আলিপুরদুয়ার ট্যুরিস্ট স্পেশাল, যার অন্যতম আকর্ষণ Vista Dome !! তোমাদের জানিয়ে রাখি, এই Vista Dome কামরার বিশেষত্ব হলো বিশাল বড় বড় কাচঢাকা জানালা, ওপরের ছাদও কাচঢাকা। অর্থাৎ ট্রেনে যেতে যেতে দুপাশের জঙ্গল, আকাশের নীলিমা, অজস্র নদীর অপরূপ দৃশ্যের পুরোটাই এমন ভাবে দেখতে পাওয়া যায়, যেন মনে হয়, তুমি ওই প্রকৃতির মধ্যেই রয়েছ। আর কপাল ভালো হলে, পশুপাখিদের সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতে পারে। সব মিলিয়ে এই যাত্রাপথ বড়ই রোমাঞ্চকর।
এক বর্ষণমুখর দিনে এমনই দুর্দান্ত পরিবেশকে সাথী করে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। বর্ষায় ডুয়ার্স কতটা রূপসী হয়ে ওঠে, জানোই তো তোমরা। চারিদিক একেবারে সবুজে সবুজ। নদীগুলি এককথায় জল থইথই। উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি এমনিতেই অপরূপ। এখন বৃষ্টির জলে সিক্ত গাছেদের রূপ যেন আরও খুলেছে। আমাদের গন্তব্য জলদাপাড়া–না, সরাসরি অভয়ারণ্য নয়, আমরা থাকব জঙ্গলের বাইরের এক গ্রামে, খুব সুন্দর এক নদী সীসামারার পাড়ে এক রিসর্টে। নদীর নামেই এলাকার নামও সীসামারা।
মাদারিহাট স্টেশন পর্যন্ত ছিল আমাদের ট্রেনযাত্রা। ওখানে আগে থেকেই রিসর্টের গাড়ি অপেক্ষা করছিল। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই স্টেশনে নেমে আমরা গাড়িতে উঠলাম। আর একটু যেতেই দ্বিগুণ বেগে একেবারে চরাচর কাঁপিয়ে বৃষ্টি এলো। সে হোক, পথের দুপাশের দৃশ্য দেখে সব ভুলে গেলাম। যেদিকে চোখ যায়, সবুজের উচ্ছ্বাস। হাওয়ার দাপটে আন্দোলিত বৃষ্টিধারায় সিক্ত গাছপালার দল। বাড়ি থেকে অনেক সকালে বের হয়েছি। ব্রেকফাস্ট হয়নি। অতএব পথের ধারের এক ধাবায় পুরি, সবজি আর ওমলেট দিয়ে জলযোগ সারলাম আমরা। বেশ পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থা। চা খেয়ে আবার যাত্রা।
জলদাপাড়া রাইনো কটেজে পৌঁছতে দুপুর গড়ালো। দ্রুত স্নান, তারপর লাঞ্চ সেরে ক্ষণিক বিশ্রাম, বারান্দায় বসে। বাইরে তখনও অঝোর ধারাপাত চলছে। বারান্দায় যেতেই দেখা সীসামারার সঙ্গে। নদীর জলে মিশে যাচ্ছে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। সে ভারি সুন্দর এক দৃশ্য। এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই নদীর সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানাই তোমাদের। উত্তরবঙ্গের বৃহৎ নদীগুলির অন্যতম তোর্সা হলো সীসামারার উৎস। আবার যাত্রাপথ শেষ করে সে মিলেও গিয়েছে তোর্সার সঙ্গে। অর্থাৎ একই সঙ্গে সে তোর্সার উপনদী ও শাখানদী। আমরা যে দুটি দিন ছিলাম, অবিরাম প্রবল বর্ষণে কেটেছে প্রহর। ফলে, সীসামারার একেবারে কাছে আর যেতে পারিনি। নদীর পাড় পিছল। তাই ঝুঁকি নেওয়া গেল না। অতএব দূর থেকেই দিবারাত্রি তার দর্শনলাভ।
এবার একটু আশপাশের খবর। জলদাপাড়া অরণ্য রেঞ্জের পাশে অবস্থিত নদীপাড়ের এই গ্রাম শান্ত, নির্জন এবং প্রকৃতির সমারোহে অপরূপ ! জলদাপাড়া ছাড়াও কাছাকাছি রয়েছে চিলাপাতা ও জয়ন্তী-বকসা অরণ্য রেঞ্জ। জঙ্গল সাফারির ব্যবস্থা রিসর্ট থেকেই করা হয়। এই অরণ্যে রয়েছে প্রচুর হাতি, গণ্ডার, বাইসন, হরিণ ও লেপার্ড। আছে ময়ূর !! বর্ষায় অরণ্যে প্রবেশের অনুমতি নেই। তাই অরণ্যের জীবজন্তুদের সাক্ষাৎ মেলেনি। একটি দলছুট বাইসন অবশ্য গ্রামের মধ্যে চলে এসেছিল পথ ভুলে। এবারের মতো তাকে দূর থেকে দেখেই সাধ মেটালাম আমরা। আর একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা–বর্ষাস্নাত বিকেলে মন ভালো হয়ে গেল কোকিলের ডাক শুনে। এমন ঘনঘোর বর্ষায় বসন্তের দূতের ডাকাডাকি ? একদিকে বাদলের ধারাপাত, অন্যদিকে অনবরত ডেকে চলে কোকিল। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়াল!
তবে, শুধু কোকিল নয়, পক্ষীপ্রেমীদের স্বর্গ এই অঞ্চলটি। রয়েছে বহু বিরল প্রজাতির পাখি। এছাড়াও অরণ্যকে ঘিরে বেড়ে উঠেছে শাল, শিমুল, সেগুন ইত্যাদি চেনা নামের পাশাপাশি নানা অচেনা গাছপালা। আর আছে প্রচুর বাঁশঝাড়, যা এলাকার হস্তশিল্পের অন্যতম উপকরণ। পুরোপুরি নদী অধ্যুষিত এই এলাকা। সীসামারার কথা তো আগেই বলেছি। এছাড়াও এই বর্ষায় একেবারে জল থই থই মুজনাই, মালসাই, ডুড়ুয়া, কালজেনি, বুড়ি বাসরা, বানিয়া, ডিমা ইত্যাদি নদী। এছাড়া তোর্সা তো আছেই। স্টেশন থেকে রিসর্টে যাওয়ার পথে বুড়ি তোর্সার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমাদের। মূল নদী এখন দূরে সরে গিয়েছে। কিছু তার কিছুটা রয়ে গিয়েছে অবশেষ রূপে, তিনিই হলেন বুড়ি তোর্সা।
ফেরার পালা এসে যায়। মাদারিহাট স্টেশন থেকে শিলিগুড়ি আলিপুরদুয়ার ট্যুরিস্ট স্পেশালে উঠব। যাত্রার আগে শেষবারের মতো দুচোখ ভরে দেখি নদীকে। বিদায়বেলায় বিষন্ন সে। কথা দিলাম, আবার আসব ফিরে। যেতে যেতে কিছু জরুরি কথা। তোমরা যে কোনও সময়ই যেতে পারো সীসামারার পাড়ে, জলদাপাড়া রাইনো কটেজে। তবে, বর্ষায় গেলে গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হবে। আবার এটাও ঠিক, বর্ষাস্নাত সবুজ অরণ্য প্রকৃতির কথাই আলাদা। চোখ জুড়ানো এমন সবুজের উৎসব অন্য সময় মেলে না। রুরাল ট্যুরিজম হসপিটালিটি প্রজেক্টের অন্তর্ভুক্ত এই রিসর্ট প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর। ছিমছাম, নয়নাভিরাম পরিবেশে তৈরি এই রিসর্টের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ অবশ্যই সীসামারা। সঙ্গে বাড়তি পাওনা আন্তরিক আপ্যায়ন আর সুস্বাদু খানাপিনা। বিশেষত চিরায়ত বাঙালি রান্নায় এখানকার কুকের জুড়ি মেলা ভার। ৩/৪ দিন সময় হাতে নিয়ে নদী আর অরণ্যের সান্নিধ্যে কাটিয়ে আসতে যোগাযোগ করতে পারো 72788 03993 ফোন নাম্বারে।
পাঠকদের মন্তব্য
250