বিহান ও শান্তু কাকাইয়ের কুকুর
শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ
বিহান স্কুলবাস থেকে নামতেই দেখল, তার দাদু বড়োকাকার দোকানের দুয়ারে বেঞ্চের উপর বসে আছে। এই স্টপেজটার নাম ‘বড়োকাকার দোকান’। বারোনম্বর হাইওয়ের পশ্চিমপাশের দোকানটির নাম ‘বড়োকাকা ভ্যারাইটিজ’।
বিহান ধুবুলিয়ার কোনো স্কুলে পড়ে না। বারো কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণনগর পাবলিক স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। স্কুলের বাসেই স্কুলে যায়-আসে।
হলুদ রঙের বাস থেকে নেমে, বিহান দাদুর হাত ধরে বলল চলো।
কেমন পরীক্ষা হলো?
ভালো, বলেই দাদুর হাত ধরে টান দিল বিহান। এখান থেকে বাড়ি দু মিনিটের পথ। যেতে যেতে ওর দাদু শ্যামলবাবু বললেন আর পরীক্ষা আছে?
না, আজই শেষ !
তাই! তাহলে তো ভালোই হলো। পরশু আমি আর তোর ঠামি দেশের বাড়ি বর্ধমানের ইলামপুরে যাব। বাড়ির গাড়ি করে যাব আমার বড়দাকে দেখতে। দাদার শরীর খারাপ হয়েছিল। বর্ধমান শহরে নার্সিংহোমে ভর্তি ছিল। বাড়িতে ফিরে এসেছে। বুঝতে পারছিস তো কোথায়? সেই যে গত বছর গিয়েছিলি লক্ষ্মীপুজোর সময়। আমার বড়দার ছেলে শান্তু বাড়িতে খুব জাঁক করে লক্ষ্মীপুজো করে। গতবারে গিয়েছিলাম আমরা সবাই। মনে নেই? আসলে সুযোগ পেলেই যাবার চেষ্টা করি। জন্মগ্রাম বলে কথা। সহজে ভোলা কি যায়, বল!
সেই ১৯৮৫ সালে শ্যামলবাবু ছেড়ে এসেছিলেন। গ্রামটিকে। যোগদান করেছিলেন এই কৃষ্ণনগর দু নম্বর ব্লকের একটি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষক হিসাবে। তারপর তার ছেলেরাও এখানে চাকরি পেয়ে যাওয়ায় এখানেই বাড়ি করে থেকে গিয়েছিলেন।
আমাকে নিয়ে যাবে—বাবা-মাকে বলেছ?
বলিনি এখনো, বলে নেব।
তোমার পুরনো বাড়িটা আমার খুব ভালো লাগে।
কারণ?
কারণ দুটো।
শুনি।
বর্ধমানের বাড়ি যাওয়ার সময় যখন জামালপুর আসে আর যখন দামোদর নদীর ধার দিয়ে গাড়িটা যায়, তখন খুব ভালো লাগে।
ভালো লাগার কারণ?
কারণ হচ্ছে বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর এক ঝড়জলের রাতে সাঁতরে এই ভয়ঙ্কর নদীটা পার হয়েছিলেন তো, তাই দেখার ইচ্ছে ছিল নদীটা কেমন।
দাদু বলল, তুই যা জানিস তার সবটা ঠিক নয়।
ঠিক নয় কেন?
ঠিক নয় এই কারণে যে বর্ষার দামোদর মানেই ভরা দামোদর নয়। যখন আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খন্ডে খুব বৃষ্টি হয়, এখন দুর্গাপুর ব্যারেজ জল ধরে রাখতে পারে না—বাড়তি জল ছেড়ে দেয়। তখনই দামোদর ভরে ওঠে এবং ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। সেই দামোদর সাঁতরে পার হওয়ার ক্ষমতা ভালো সাঁতারুরও থাকে না। আসল কথাটা হলো, বিদ্যাসাগর ভরা দামোদরই পার হয়েছিলেন কিনা বলা কঠিন।
এখন বল দ্বিতীয় কারণটা।
দ্বিতীয় কারণ হলো জ্যাকি।
জ্যাকি মানে–শান্তুর পোষা অ্যালসেশিয়ান, যাকে দেখতে অনেকটা নেকড়ে বাঘের মতো। কিন্তু ওকে তো সবাই ভয় পায়।
আমারও প্রথম খুব ভয় লেগেছিল। যখন প্রথম আমাকে দেখে ঘাঁক করে সামনে দুপা তুলে লাফ দিয়ে উঠেছিল, তখন ভীষণ ভয় করেছিল। ভাগ্যিস চেন দিয়ে বাঁধা ছিল।
পরে কী করে ভয় কাটল?
ভয় কাটলো তখন, যখন ছুটিদিদি বলল–শোন জ্যাকি, এ কিন্তু আমার ভাই হয়। একে চিনে রাখ। গায়ের গন্ধ নিয়ে নে।
তারপর আমায় বলল, আর কোনোদিন তোকে দেখে তেড়ে যাবে না, বুঝলি? ব্যাস তাতেই জ্যাকির সাথে আমার ভাব হয়ে গিয়েছিল।
ততক্ষণে বাড়ি এসে গেছে। শ্যামলবাবু বাড়িতে ঢুকে বললেন, যা উপরে যা–গিয়ে হাত-পা ধুয়ে খেয়ে নে।
বিহান উঠে গেল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফুরফুরে মেজাজে বিহান বাবাকে গিয়ে বলল, জানো বাবা আমি দাদু-ঠামির সাথে কাল শান্তু কাকাইয়ের বাড়ি যাবো।
বাবা হেসে বলল, তাই! বেশ ঘুরে আয়। তবে সাবধানে থাকিস। ওর কুকুর…!
বাবাকে থামিয়ে বিহান বলল, কোনো ভয় নেই বাবা, গত বছর ছুটিদিদি মানে শান্তুকাকাইয়ের ছোটমেয়ে ওদের কুকুর জ্যাকির সাথে আমার ভাব করিয়ে দিয়েছে।
এই কথা শুনে ওর মা বলল তাই নাকি রে! কিন্তু কীভাবে?
আমার গন্ধ জ্যাকিকে চিনিয়ে দিয়েছে। আর কুকুর যদি একবার কোনো গন্ধ পায়, সে গন্ধ কখনো ভোলে না। টিভিতে দেখোনি পুলিশের কুকুর কীভাবে গন্ধ শুঁকে চোর ধরে।
তোর আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে এই কুকুরের সঙ্গে দেখা করা হবে বলেই তুই যেতে চাইছিস।
না না শুধু তাই নয়, ইলামপুরের দাদুর শরীর খারাপ করেছিল না ?–বলে বিহান খুশি মনে চলে গেল।
কিন্তু ওর খুশিখুশি ভাবটা স্থায়ী হলো না। ঘন্টাখানেক পরে ওর বাবা ওকে ডেকে বলল তোর আর ইলামপুর যাওয়া হলো না রে।
শুনে বিহানের মুখটা কালো হয়ে গেল। শুকনো গলায় বলল কেন?
এই দেখ স্কুলের গ্রুপে কী লিখেছে ? কাল তোদের প্রজেক্ট পেপার জমা নেওয়ার তারিখ দিয়েছে।
একথা শুনে বিহানের কান্না পেয়ে গেল। তা দেখেও না দেখার ভান করে ওর মা বলল, তাই ! তাহলে তো তোর প্রজেক্টের কাজ শেষ করতে হবে। চল দেখি কাজ কতটা বাকি আছে। বলে, বিহানের মা ওকে নিয়ে পড়ার ঘরে চলে গেল।
বিহান দুপুরে যখন খাওয়া শেষ করল, তখন ওর মা বলল, রিন্তু যা এখন একটু ঘুমিয়ে নে। রিন্তু বিহানের ডাক নাম।
বিহান উপরে ওদের ঘরে ঘুমাতে গেল। ঘন্টাখানেক বাদে ওর বাবা এসে বলল, তোর ভাগ্য খুব ভালো রিন্তু, তোদের প্রজেক্ট জমা দেওয়ার দিন বদলে দিয়েছে। কাল তুই বাবা-মার সাথে যেতে পারবি।
পরের দিন সকালেই বিহান বাড়ির গাড়ি চেপে ইলামপুর রওনা দিলো।
গাড়ি নবদ্বীপের গৌরাঙ্গ সেতু, ধাত্রীগ্রাম, সাজগেছিয়া, মেমারি, জামালপুর পার হয়ে ইলামপুর পৌছলো বেলা দশটার সময়। কিন্তু বাড়ি পৌছেই বিহান দেখল বাড়িতে অনেক লোকজন। সবার চোখে জল। শুনল শান্তু কাকাইয়ের কুকুর জ্যাকি মরে গেছে। শুনে বিহানের বুকটাও কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল বিহান।
ওর কান্না থামল মায়ের ঠেলায়। ওর মা ঠেলা দিয়ে বলল কীরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাঁদছিস কেন? ওঠ ওঠ আর কত ঘুমাবি?
বিহান ধড়মড় করে উঠে বলল জ্যাকি…!
ওর মা বলল কী হয়েছে জ্যাকির?
বিহান কিছু না বলে কিছুক্ষণ মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বুঝলো এতক্ষণ ধরে যা ঘটল, তা স্বপ্নেই ঘটেছে। ওর মনটা আবার ভার হয়ে গেল।
এমন সময় ওর বাবা এসে উপস্থিত। বলল প্রবলেম সলভ্ড। আবার স্কুল থেকে মেসেজ এসেছে। তোদের প্রজেক্ট জমা দেওয়ার দিন বদলে গেছে। তুই কাল বাবা-মার সাথে যেতে পারবি। আগেরবার এই কথাটা বিহান শুনেছিল ঘুমের মধ্যে–স্বপ্নে। এখন জেগে উঠে বাবার মুখে শুনে বুঝলো কাল সত্যিই সে দাদু-ঠামির সাথে যাচ্ছে। তার মন আনন্দে ভরে উঠল।
পাঠকদের মন্তব্য
250